TechJano

গরীব স্কুল শিক্ষক জ্যাক মা যেভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক হন

আলিবাবা গ্রুপের সহপ্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মার অবসর নিয়ে নানা গুঞ্জন ছড়াচ্ছে। শুক্রবার বিশ্ব গণমাধ্যমে জ্যাক মার অবসর নেওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। পরে আলিবাবা গ্রুপের পক্ষ থেকে জানানো হয়, উত্তরসূরিবিষয়ক একটি পরিকল্পনা দেবেন জ্যাক। আর কিছুদিনের জন্য প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী চেয়ারম্যানের চেয়ারেও থাকবেন তিনি।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, উত্তরসূরিবিষয়ক পরিকল্পনা প্রকাশ করবেন জ্যাক মা। প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে পালাবদলের ক্ষেত্রে এই পরিকল্পনা যথেষ্ট সময় নিয়েই কার্যকর করা হবে। এই সময়সীমা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আলিবাবার নির্বাহী চেয়ারম্যান পদে থাকবেন জ্যাক মা।
অবসর নেওয়ার পর তাঁর প্রধান কাজ হবে শিক্ষাব্যবস্থায় জনসেবাকে প্রাধান্য দেওয়া। প্রতিবেদনে জ্যাক মার উদ্ধৃতিও ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এখন উল্টো সুরে গাইছেন চীনের তৃতীয় ধনী ব্যক্তি।

১৯৯৯ সালে জ্যাক মা কয়েকজনের সঙ্গে মিলে আলিবাবা প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে। এর মধ্যে অনলাইন বিক্রি, চলচ্চিত্র তৈরি, ক্লাউড কম্পিউটিং ব্যবসা রয়েছে।

মনের ইচ্ছে থাকলে জীবনে অসম্ভব কিছুই না ৷ কোনও বাধাই আপনাকে আটকাতে পারবেন না ৷ আর সেটাই প্রমাণ করেছিলেন ই কমার্স আলিবাবা-র ফাউন্ডার জ্যাক মা ৷ জেনে নিন কীভাবে একজন গরীব শিক্ষক থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে উঠেছেন তিনি।

জ্যাক মার জীবন নিয়ে লেখা ‘আলিবাবা: দ্যা হাউস দ্যাট জ্যাক মা বিল্ট’ বইয়ে বলা হয়েছে ১৯৯৯ সালে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে জ্যাক যখন আলিবাবা নামে সংস্থা খুলেছিলেন তখন সকলে তাকে সন্দেহের চোখে দেখতেন ৷ প্রতারক ভাবতেন অনেকেই ৷ পরে অবশ্য মানুষ বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি প্রতারক নয় ৷ বরং তার উদ্যোগে সাধারণ মানুষের জীবনে অনেক কিছু আরও সহজ হয়ে উঠতে চলেছে৷

বিল গেটস বা স্টিভ জোবসের মত কম্পিউটার সায়েন্সের কোনও ব্যাকগ্রাউন্ড নেই ৷ ছোটবেলায় কোনওদিন তিনি কম্পিউটার ব্যবহার করেননি ৷ অঙ্কে একবার তিনি ১২০ তে ১ পেয়েছিলেন ৷১৯৮০ সালে স্কুল শিক্ষকের চাকরি করতেন ৷

ব্যবসার কারণে ১৯৯৪ সালে তিনি যখন আমেরিকায় গিয়েছিলেন তখন ইন্টারনেট পরিষবা দেখে চমকে গিয়েছিলেন ৷ হয়রান হয়ে গিয়েছিলেন কীভাবে মানুষ বাড়িতে বসেও বন্ধু ও আত্মীয়দের সঙ্গে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতে পারেন ৷

এরপর ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ সালে জ্যাক মা আলিবাবা শুরু করেন ৷ এর জন্য ১৭ জন বন্ধুকে তৈরি করেছিলেন ৷ এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি জ্যাক মাকে ৷ গোটা বিশ্বে ই কামর্স সাইটের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে জ্যাক মার সংস্থা ৷

স্বনামধন্য চীনা ব্যবসায়ী জ্যাক মা। তিনি অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। দারুণ বক্তা জ্যাক। বিভিন্ন উদ্যোক্তা সম্মেলনে তাঁর কথায় অনুপ্রাণিত হয়েছেন বহু তরুণ। ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি হংকংয়ে অনুষ্ঠিত ‘অ্যান ইভিনিং উইথ জ্যাক মা’ অনুষ্ঠানে তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি।
তিনি বলেন-
আমি যেটা ভাবি, সেটাই যে সব সময় ঠিক তা নয়। তরুণদের আমি কিছু শেখাতে চাই না। কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়, আমি মনে করি এই পরামর্শ তাদের প্রয়োজন নেই। আমি বরং তোমাদের আমার কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলব, স্রেফ একজন বড় ভাইয়ের মতো।

১৫ বছর আগে আমি ব্যবসা শুরু করেছি। প্রথমত কখনোই ভাবিনি, এ রকম একটা মঞ্চে নিজের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলার সুযোগ হবে। যখন আমি ব্যবসা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার ২৪ জন বন্ধুকে বাসায় নিমন্ত্রণ করেছিলাম। পাক্কা দুই ঘণ্টা আমার ভাবনাটা ওদের বোঝানোর পর আমি বুঝতে পারলাম, ওরা কিছুই বোঝেনি! ২৪ জনের মধ্যে মাত্র ১ জন আমার পাশে থাকতে রাজি হয়েছিল।

আজকালকার তরুণদের যেসব যোগ্যতা থাকে, আমার সেসবের কিছুই ছিল না। লোকে আমাকে বলত, ‘কী যোগ্যতা আছে তোমার? তুমি কখনো অ্যাকাউন্টিং শেখোনি, ম্যানেজমেন্ট শেখোনি। এমনকি কম্পিউটার সম্পর্কেও তেমন কিছু জানো না। তুমি কেন ব্যবসা করবে?’ সবাই জানে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথমবার গণিতে আমি ১ পেয়েছিলাম। তিনবার পরীক্ষা দিয়েও ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাইনি। শেষ পর্যন্ত যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, সেটার তেমন কোনো নাম ছিল না—হ্যাংঝোউ নরমাল ইউনিভার্সিটিকে তখন ‘চতুর্থ শ্রেণির’ বিশ্ববিদ্যালয় ধরা হতো। কিন্তু এখন অনুভব করি, হ্যাংঝোউ আমার কাছে হার্ভার্ডের চেয়েও বড়! এসবই প্রমাণ করে, ব্যবসা করার তেমন কোনো যোগ্যতা আমার ছিল না। যারা শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে, অনেক সময় তাদের জন্যই উদ্যোক্তা হওয়া সহজ।

সে জন্যই আমাদের মতো কিছু মানুষ, যাদের অন্য অনেক কিছু করার যোগ্যতা নেই, তারা উদ্যোক্তা হয়। অনেকে ভেবেছিল আমরা ভাগ্যক্রমে সাফল্য পেয়ে গেছি। ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। ১৫ বছর ধরে আমরা টিকে আছি। এটা ঠিক আলিবাবা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে চার বছর আমি চায়না ইয়েলো পেজেস-এ কাজ করেছি। বৈদেশিক বাণিজ্য ও অর্থনীতি মন্ত্রণালয়েও ছিলাম প্রায় ১৩ মাস। আমি যে পরিমাণ ভুল করেছি, তা তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না।

১৮ জন সহপ্রতিষ্ঠাতাকে সঙ্গে নিয়ে আমার বাসায় আলিবাবার যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেদিন আমি খুব পরিষ্কারভাবে বলেছিলাম, আমরা যদি সফল হই, এর অর্থ হলো চীনের শতকরা আশি ভাগ তরুণের পক্ষেই সফল হওয়া সম্ভব। কেউ আমাদের পেছনে বিনিয়োগ করেনি। না ছিল ক্ষমতা, না কোনো সামাজিক অবস্থান। সম্বল বলতে তেমন কিছুই ছিল না। আমরা ১৮ জন ৫ লাখ আরএমবি করে বিনিয়োগ করেছিলাম। ঠিক করেছিলাম, অন্তত ১২ মাস এই টাকায় ব্যবসাটা চালিয়ে নেব। এর মধ্যে যদি কিছু আয় হয়, তবে ব্যবসা চলবে। নতুবা অন্য কিছু ভাবতে হবে। কিন্তু অষ্টম মাসেই আমাদের হাত খালি হয়ে গেল। আমাদের নিয়ে কারও কোনো আশা ছিল না।

স্পষ্ট মনে আছে, বর্তমান নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট জো সাইকে নিয়ে যখন সিলিকন ভ্যালিতে গেলাম, ৩০ জন বিনিয়োগকারী আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা ছাড়া আর কারও কাছেই পরিকল্পনাটা ভালো মনে হচ্ছিল না। একটা পরিকল্পনা করাই মুখ্য নয়। মুখ্য হলো, তুমি যা করছ সেটার ওপর তোমার বিশ্বাস আছে কি না। আলিবাবার সঙ্গে এই যাত্রায় অনেকেই জেনেছে স্বপ্ন, সত্য আর কল্পনার মধ্যে পার্থক্য কী।

তরুণ বয়সে সবার একটা স্বপ্ন থাকে। অনেক মা-বাবা আমাকে বলেন, ‘জ্যাক, আমার ছেলে বা মেয়েটার স্বপ্ন কদিন পরপরই বদলে যাচ্ছে। আজ সে হতে চায় এক, কাল আরেক।’ আমি বলি এটাই তো স্বাভাবিক। কোনো স্বপ্ন না থাকার চেয়ে অন্তত কদিন পর পর স্বপ্ন বদল হওয়া ভালো। আমার ইচ্ছে ছিল পুলিশ হব কিংবা আর্মিতে যোগ দেব। এমনকি কেএফসিতে কাজের জন্যও আবেদন করেছিলাম। ২৪ জন আবেদনকারীর মধ্যে ২৩ জনই নিয়োগ পেয়েছিল। ১ জন পায়নি—সেই মানুষটা আমি। যখন পুলিশের চাকরির জন্য আবেদন করলাম, প্রতি ৫ জনে ৪ জন চাকরি পেয়েছিল, আমি পাইনি।

স্বপ্ন থাকা ভালো। কিন্তু বাস্তবতা কী? বাস্তবতা হলো, একদল লোক ভিন্ন ভিন্ন পরিকল্পনা, অনুশীলন আর কার্যক্রম নিয়ে এগোতে এগোতে একসময় বুঝতে পারে, তারা সবাই আসলে একই লক্ষ্যের পেছনে ছুটছে। যখন আলিবাবার যাত্রা শুরু হয়, এটা স্বপ্ন বা কল্পনা কোনোটাই ছিল না। আমি এমন বহু মানুষ দেখেছি যারা কল্পনায় ডুবে থাকে। অবাস্তব, অসম্ভব সব কল্পনা। তবু তারা ভাবে যে অন্য সবাই ভুল, শুধু তারাই ঠিক। আলিবাবায় আমরা ১৮ জন মানুষ শুধু এটাই ঠিক করেছিলাম, আমরা আমাদের বিশ্বাসে অটল থাকব। চড়াই-উতরাইগুলো একসঙ্গে পাড়ি দেব। আমাদের স্বপ্ন বা কল্পনা ছিল না, ছিল আশা।

অতএব নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করো, তোমার যদি কোনো স্বপ্ন থাকে, তুমি তোমার স্বপ্ন পূরণে অটল কি না। তোমার যদি কোনো লক্ষ্য থাকে, সেই লক্ষ্য পূরণের সাথি হতে তুমি আরও একদল মানুষকে আমন্ত্রণ জানাবে কি না। নিঃসঙ্গ যাত্রা খুবই ক্লান্তিকর। নিজের কাজটা ঠিকভাবে করলেই একটা ব্যবসা দাঁড়িয়ে যায় না। এর জন্য একদল মানুষের মধ্যে একটা ভালো বোঝাপড়ার দরকার হয়।

Exit mobile version