দেশে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (এমএফএস) ক্ষেত্রে আন্তঃসংযোগ ব্যবস্থা চালু করে গ্রাহকদের আন্তঃলেনদেন সুবিধা প্রদানে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।
সোমবার সকালে রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁ হোটেলে মেটলাইফ ফাউন্ডেশন ও মাইক্রোসেভ এর যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে আই থ্রি কর্মসূচি উদ্বোধন হয়। সেখানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রী এসব কথা বলেন। আয়োজকরা জানান আই থ্রি কর্মসূচির ফলে ব্যাংক হিসাবহীন ৫০ শতাংশ মানুষের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে।
আয়োজকরা জানান, পৃথিবীতে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর ৮ শতাংশ বাংলাদেশি। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আর্থিক সেবায় যুক্ত আছে বাংলাদেশের ৫ কোটি মানুষ। ব্যাংক এখনো মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছতে পারেনি। ৬০ শতাংশ মানুষ ব্যাংকিং সুবিধার আওতার বাইরে। নারীদের ক্ষেত্রে এটি ৬৫ শতাংশ।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. হুমায়ুন কবিরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী বলেন, “মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আন্তঃলেনদেন সুবিধা দ্রুত চালু করা উচিত। তাহলে এক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক অন্য প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে টাকা লেনদেন করতে পারবেন, যেমনটা আমরা এখন ব্যাংকগুলোর মধ্যে করতে পারি।”
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আরো ছিলেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) প্রেসিডেন্ট সৈয়দ আলমাস কবির ও মেটলাইফ বাংলাদেশের মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ হাম্মাদুল করিম। এছাড়াও ব্যাংকার, ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, মোবাইল ফোনভিত্তিক আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, ফিনটেক (ফিনান্সিয়াল টেকনোলজি) উদ্যোক্তাসহ এই খাতের শতাধিক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
মোস্তাফা জব্বার বলেন, দেশের তৃণমূল পর্যায়ে ডিজিটাল সেবা পৌঁছে দিচ্ছে সরকার। ২০১৯ সালের জুনে এমন কোনো ইউনিয়ন পাওয়া যাবে না যেখানে ইন্টারনেট সংযোগ থাকবে না। প্রযুক্তিতে দেশের উদ্যোক্তাদের উদ্ভাবনী বিষয়গুলোকে যেন স্থায়ী রূপ দেয়া যায় সেটি নিয়ে সরকার কাজ করছে।
অনুষ্ঠানে মাইক্রোসেভের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে আই থ্রি কর্মসূচির অধীনে বিদ্যমান উদ্যোগগুলোর ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়। সম্ভাব্য সুযোগ সনাক্ত, প্রযুক্তি ব্যবহার, বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্র্ভুক্তির কর্মসূচিতে অবদান রাখার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করেন।
আই থ্রি কর্মসূচি:
আই থ্রি কর্মসূচি ইনোভেট (উদ্ভাবন), ইমপ্লিমেন্ট (বাস্তবায়ন) এবং ইম্প্যাক্ট (প্রভাব) এই তিনটি শব্দ নিয়ে গঠিত, যার উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশে অর্থবহ আর্থিক অন্তর্ভূক্তি অব্যাহত রাখা। এই উদ্যোগ ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার, নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের প্রয়োজন, আশা-আকাক্সক্ষা, আচরণ প্রকাশ করতে, উত্তম উপায়ে ডিজাইনকৃত পণ্য এবং সেবার মাধ্যমে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষদের প্রভাবিত করবে।
“বাংলাদেশ, চীন, মালয়েশিয়া এবং ভিয়েতনামে অর্থবহ আর্থিক অন্তর্ভূক্তির জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার” শীর্ষক ৩৬ মাস মেয়াদী কর্মসূচিতে মেটলাইফ ফাউন্ডেশন অর্থায়ন করেছে। বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনামে কর্মসূচিটি মাইক্রোসেভ দ্বারা এবং চীন ও মালয়েশিয়ায় ইউএনসিডিএফ দ্বারা বাস্তবায়িত হয়েছে। বাংলাদেশে এ ধরণের কর্মসূচি এবারই প্রথম।
যদিও দারিদ্র্য বিমোচনে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রচেষ্টা অসাধারণ এবং এজন্য এই দেশের মানুষ অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। এখানকার ৫ কোটি ১০ লাখ (৫১ মিলিয়ন) মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। ব্যাংকিং সেবা এবং পণ্যে মৌলিক অভিগমন বাংলাদেশে একটি চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া সরকার সুবিধাজনক নীতির মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভূক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দেখিয়েছে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে আশা করা হচ্ছে কমপক্ষে দুই লাখ ৫০ হাজার বঞ্চিত নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আসবে এবং বাংলাদেশজুড়ে ২০ লাখ (দুই মিলিয়ন) মানুষ পরো¶ভাবে উপকৃত হবে।
মেটলাইফ বাংলাদেশের মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ হাম্মাদুল করিম বলেন, “নিম্ন আয়ের বাংলাদেশিদের জন্য আর্থিক ¯^াস্থ্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উদ্ভাবনী সমাধান খুঁজছে বাংলাদেশ। আমি বলতে গর্ববোধ করছি যে, মেটলাইফ ফাউন্ডেশনে নিম্ন থেকে মধ্য আয়ের মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের অগ্রাধিকারের সঙ্গে আমার সুসংবদ্ধ। ডিজিটাল পরিবর্তনের ওপর গুরুত্ব প্রদানকারী আই থ্রি কর্মসূচি এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমরা আশা করি এ উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের ২০ লাখ মানুষের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে।
আই থ্রি কর্মসূচির উদ্যোগের সঙ্গে মাইক্রোসেভের ভূমিকার প্রসঙ্গ তুলে ধরে মাইক্রোসেভ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক মি. মনোজ শর্মা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, “মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় বাংলাদেশ নেতৃত্ব প্রদানকারী দেশ। তবে ব্যাংকিং সেবা এবং পণ্যে মৌলিক অভিগমন এখনো একটি চ্যালেঞ্জ। নিম্ন থেকে মধ্য আয়ের মানুষ এবং মৌলিক আর্থিক সেবার মধ্যে যে ফারাক রয়েছে তার মধ্যে আই থ্রি কর্মসূচির মাধ্যমে মাইক্রোসেভ মেলবন্ধন তৈরির চেষ্টা করছে। আমরা বিশ্বাস করি অর্থবহ আর্থিক অন্তর্ভুক্তি গ্রহণ করার জন্য প্রযুক্তি একটি চালিকাশক্তি। আর্থিক সেবা প্রদানকারী এবং ফিনটেক (ফিনান্সিয়াল টেকনোলজি) প্রযুক্তি ৫০ শতাংশ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছতে সাহায্য করবে, যাদের কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ব্যাংক হিসাব নেই।”
দেশে মোবাইল ফোনের দ্রুত প্রসারের ফলে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা (এমএফএস) গ্রহণকারী এবং মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রদানকারী এজেন্ট সংখ্যা উল্লেখ্যযোগ্য হারে বেড়েছে। কিন্তু মৌলিক লেনদেন যেমন: ক্যাশ-ইন, ক্যাশ-আউট এবং পেমেন্ট ছাড়া বাংলাদেশে এমএফএস মার্কেট এখনো বিস্তৃত হয়নি। এসব সেবা অধিকাংশ অভার-দ্য-কাউন্টারে সম্পন্ন করা হয়। বাংলাদেশে আর্থিক-প্রযুক্তি সেবায় ব্যবসায়ীরা এগিয়ে আসছে এবং মূল বাধা-বিপত্তি মোকাবেলায় বড় ভূমিকা পালন করবে। এসব বাধা-বিপত্তি আর্থিক অন্তর্ভূক্তি এবং আনুষ্ঠানিক আর্থিক সেবাখাতে সেবাবঞ্চিত অংশের সমš^য়কে আটকে রাখে। আই থ্রি কর্মসূচির মাধ্যমে মাইক্রোসেভ ব্যাংক, এমএফএস সেবা প্রদানকারী, ফিনটেক এবং অন্যান্য আর্থিক সেবা প্রদানকারীদের সঙ্গে অংশীদারের ভিত্তিতে বাংলাদেশের আর্থিকভাবে বাদপড়া এবং বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সেবা প্রদানে কাজ করবে।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে শিল্প উদ্যোক্তা এবং রেগুলেটর, ব্যাংক, এমএফএস প্রদানকারী, ফিনটেক এবং দাতাগণ বাংলাদেশ অর্থবহ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য কীভাবে প্রযুক্তি ব্যবাহার করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করেন।
মেটলাইফ ফাউন্ডেশন সম্পর্কে
১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মেটলাইফ ফাউন্ডেশন দীর্ঘ কর্পোরেট অবদান এবং কমিউনিটির অন্তর্ভুক্তি অব্যাহত রেখেছে। ২০১৭ সাল নাগাদ মেটলাইফ ফাউন্ডেশন ৭৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি অনুদান হিসেবে এবং ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কর্মসূচি-সম্পর্কিত বিনিয়োগে প্রদান করেছে এমনসব প্রতিষ্ঠানকে যারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে যেগুলোর ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে তাদের নিজ নিজ কমিউনিটির ওপর। ২০১৩ সালে ফাউন্ডেশন আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং ফাউন্ডেশনের সেবা ইতোমধ্যে ৪২ টি দেশের ৬ মিলিয়ন নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে পৌঁছেছে। মেটলাইফ ফাউন্ডেশন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন: সবঃষরভব.ড়ৎম
বাংলাদেশে ৮টি নেতৃত্বস্থানীয় আর্থিক অন্তর্ভূক্তি অংশীদার নিয়ে এমন সমাধানের অংশ হয়ে গর্বিত, যা দেশের নিম্ন থেকে মধ্যম আয়ের লাখো মানুষের কাছে পৌঁছবে।
মাইক্রোসেভ সম্পর্কে
মাইক্রোসেভ একটি আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। নিম্ন এবং মধ্য-আয় শ্রেণীকে আর্থিক সেবা প্রদান সংক্রান্ত বাস্তব এবং বাজারচালিত সমাধান প্রদান করে এই প্রতিষ্ঠানটি। মাইক্রোসেভ ডিজিটাল আর্থিক সেবা (ডিএফএস), অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থ এবং ব্যাংকিং, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ব্যবসা এবং বেসরকারি খাত উন্নয়ন সংক্রান্ত পরামর্শ সেবা প্রদান করে।
মাইক্রোসেভ এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার ৫০টির বেশি দেশে ৪৫০ এর বেশি গ্রাহক রয়েছে। একটি স্থানীয় আন্তর্জাতিক পরামর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুই দশকের বেশি সময় প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গ্রাহকের সঙ্গে কাজ করছে। এই প্রতিষ্ঠান বাস্তুসংস্থান উন্নয়নের জন্য নীতি প্রণয়ন এবং অংশীদারিত্ব সহজতর করতে সহায়তা করে, বিস্তৃত, কাস্টমাইজড (অনুকুলিত) পরামর্শ প্রদান করে এবং আর্থিক অন্তর্ভূক্তির জন্য কার্যকর, অন-সাইট অপারেশনাল সহযোগিতা প্রদান করে। মাইক্রোসেভ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন: http://www.microsave.net/