TechJano

টেলিগ্রাম সিইও পাভেল দুরভ ও তার বান্ধবীর গল্প

টেলিগ্রাম সিইও পাভেল দুরভ ও তার বান্ধবীর গল্প সবার মুখে মুখে। ২৪ আগস্ট গ্রেপ্তার হয়েছেন বার্তা আদান–প্রদানের জনপ্রিয় অ্যাপ টেলিগ্রামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পাভেল দুরভ। সেদিন সন্ধ্যায় নিজের প্রাইভেট উড়োজাহাজে করে দেশটির লো বোর্গেট বিমানবন্দরে অবতরণ করার পরই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে সেদিন তাঁর সঙ্গে উড়োজাহাজে ছিলেন আরও একজন। এক স্বর্ণকেশী তরুণী। বলা হয়, ওই তরুণী হলেন পাভেলের পরামর্শক (ক্রিপ্টো কোচ)। তবে পাভেল গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে এই তরুণীর খোঁজ পাচ্ছে না তাঁর পরিবার।

ফ্রান্সের গোপনীয় তথ্যবিষয়ক গবেষক ব্যাপ্টিস্ট রবার্ট এবং আরও অনেকের বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্টের তথ্য মিলিয়ে দেখেছেন, ২৪ বছর বয়সী জুলি ভাবিলুভা নামের ওই তরুণী গত সপ্তাহে পাভেলের সঙ্গে আজারবাইজানে ভ্রমণ করেন। ওই সময় তিনি একাধিক মোহনীয় ছবি শেয়ার করেন। এরপর অনলাইনে নানা জল্পনাকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন এই তরুণী। তিনি একজন ভিডিও গেম স্ট্রিমারও।

অনলাইন পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, গ্রেপ্তারের আগে এসব পোস্টের মধ্য দিয়েই সম্ভবত নির্বাসিত রাশিয়ান এই ধনাঢ্য ব্যক্তির গতিবিধি সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাওয়া গেছে।

রবার্ট দ্য পোস্টকে বলেন, ‘এটা বলা কঠিন, এই তরুণীর পোস্ট পাভেলের গ্রেপ্তারে সরাসরি ভূমিকা রেখেছে কি না; কিন্তু আপনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে অনুসরণ করলে খুব সহজেই পাভেলের গতিবিধি ধরতে পারবেন।’

জুলির পরিবারের পক্ষ থেকে বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলা হয়, পাভেল গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে তারা মেয়ের খোঁজ পাচ্ছেন না।

পাভেলের গ্রেপ্তার এক্সের মালিক ইলন মাস্কসহ প্রযুক্তির জগতে যাঁরা বাক্‌স্বাধীনতা চান, তাঁদের ক্ষুব্ধ করেছে। তাঁদের দাবি, পাভেল টেলিগ্রামের এনক্রিপশন প্রযুক্তিতে সরকারকে হস্তক্ষেপের করার সুযোগ না দেওয়ায় রোষানলে পড়েছেন।

উল্লেখ্য, টেলিগ্রাম অ্যাপ এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের মধ্যে নিরাপদ যোগাযোগের সুবিধা দেয়। এতে তৃতীয় পক্ষ ঢুকতে পারে না।

তবে পাভেলের সঙ্গে জুলির কী সম্পর্ক তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থাকা এই তরুণীর সব অ্যাকাউন্ট তাঁর মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণের ছবি ও ভিডিওতে ভরা। জুলির যে সময় ভ্রমণ করেন, দেখা যায় টেলিগ্রামের সিইও পাভেলও ঠিক ওই সময়গুলোতে সেসব জায়গায় ভ্রমণ করেছেন।

রবার্ট এক্সে পোস্ট করা দুজনের এ ধরনের বেশ কিছু ছবি ও ভিডিও একত্র করেছেন। এর মধ্যে গ্রীষ্মের আগে উজবেকিস্তানে দুজনের একসঙ্গে থাকা কিছু ভিডিও রয়েছে, যেগুলো ধারণ করেছিল রাশিয়ান একজন ব্লগার।

অন্য একটি পোস্টে দেখা যায় ২১ আগস্ট আজারবাইজানে গাড়িতে যাত্রীর আসনে জুলি বসা আর পাভেল গাড়ি চালাচ্ছেন। সেগুলোর সঙ্গে আরও দুটি ছবি পোস্ট করা ছিল। সেগুলোতে দেখা যায় একই জায়গায় দুজনের ছবি এবং পরে দেখা যায়, দুজনেই দেশটির রাজধানীর একই হোটেলের ছবি পোস্ট করছেন।

জুলি ও পাভেলের কীভাবে দেখা হয়েছে এটি এখনো অজানা। তবে দুজনই দুবাইয়ে থাকেন। সেখান থেকে এখন টেলিগ্রাম পরিচালনা হচ্ছে। সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালে পাভেল ও তাঁর ভাই নিকোলাই টেলিগ্রাম অ্যাপটি চালু করেন। এখন এই অ্যাপের গ্রাহকসংখ্যা ৯৫ কোটির বেশি বলে গত মাসে পাভেলের দেওয়া এক পোস্টে দাবি করা হয়।

তবে ক্রেমলিনকে টেলিগ্রামের এনক্রিপটেড তথ্য দিতে রাজি না হওয়ায় ২০১৪ সালে তাঁকে রাশিয়া ছাড়তে হয়েছিল।

টেলিগ্রামের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘পাভেল লুকিয়ে ছিলেন না, পালিয়েও ছিলেন না। তাঁর রাশিয়া ও ফ্রান্সের নাগরিকত্ব রয়েছে। তাই তিনি প্রায়ই ইউরোপ সফর করতেন।’

টেলিগ্রাম ব্যবহার করে শিশু পর্নোগ্রাফি ছড়িয়ে পড়ার অভিযোগের তদন্তের অংশ হিসেবে ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাভেলের বিরুদ্ধে সার্চ পরোয়ানা জারি করে। তাঁর এই গ্রেপ্তার নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ কৌতূহল ও প্রশ্ন উঠেছে।

ফ্রান্সের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, টেলিগ্রামকে ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী মাদক পাচার, শিশু পর্নোগ্রাফি ও যে প্রতারণার ঘটনা ঘটে, সেগুলোর একজন সহযোগী পাভেল। আর এসব হয় টেলিগ্রামে কনটেন্ট সম্পাদনা খুব একটা হয় না বলেই। এই অ্যাপের মাধ্যমে ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহারও হয় লাগামছাড়া।

ফ্রান্সের অফমিন পুলিশ সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেল জিন-মিশেল বার্নিগড এক বিবৃতিতে বলেন, এই ঘটনার মূল বিষয় হলো প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা করা হচ্ছে না। সেই সঙ্গে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই।

বিবিসির তথ্যমতে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সরকারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এখনো অস্পষ্ট। ২০১৮ সাল থেকে রাশিয়ায় টেলিগ্রামের ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুই বছর পর আবার অবশ্য অনুমতি দেওয়া হয়। রাশিয়ার সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি দেশটির সেনা সদস্যদের কাছে এটি অন্যতম প্রধান সামাজিক যোগাযোগের প্ল্যাটফর্ম।

কিছু কিছু অনলাইন কোনো প্রমাণ ছাড়াই ধারণা করছে, পাভেলের আজারবাইজান সফরের উদ্দেশ্য ছিল পুতিনের সঙ্গে দেখা করা। তবে এমন দাবি ক্রেমলিন অস্বীকার করেছে।

এটি অস্পষ্ট যে পাভেল কেন নিজের উড়োজাহাজে করে প্যারিস ফিরলেন, যেখানে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি পরোয়ানা ছিল যে ফ্রান্সের মাটিতে পা রাখলেই তিনি গ্রেপ্তার হতে পারেন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারই টেলিগ্রামের সমালোচনা করে। তাদের ভাষ্য, এই প্ল্যাটফর্ম জঙ্গি, সন্ত্রাসী ও অপরাধীরা নিরাপদে ব্যবহার করে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। কারণ এই অ্যাপটি ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা রক্ষায় সর্বোচ্চ জোর দেয়।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন ফোর্বসের তথ্যমতে পাভেল দুরভের সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৫৫০ কোটি মার্কিন ডলার। পাভেল বরাবরই বলে এসেছেন টেলিগ্রাম নিরপেক্ষ সামাজিক যোগাযোগের প্ল্যাটফর্ম। রাশিয়ার আদেশ-নিষেধ থেকে বাঁচতে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।

টেলিগ্রামের ব্যবহারকারীদের তথ্য সরকারকে হস্তগত করতে আদালত আদেশ দেন; কিন্তু পাভেল আদালতের সেই আদেশ মানতে রাজি হননি। এরপর রাশিয়া ২০১৮ সাল থেকে টেলিগ্রাম ব্লক করতে শুরু করে। পরে ২০২০ সালে সরকার এই অ্যাপের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।

পাভেলের গ্রেপ্তারের পর গত সোমবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বলেন, এটি কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়। ইমানুয়েল মাখোঁ বলেন, এটি বিচারব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে, যা সম্পূর্ণ স্বাধীন।

গতকাল বুধবার পাভেল দুরভ পুলিশের হেফাজত থেকে ছাড়া পান। তবে তাঁকে আদালতের হেফাজতে দেওয়া হয়েছে। প্যারিসের প্রসিকিউটরের কার্যালয় জানিয়েছে, এখন ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের একটি আদালতে পাভেল দুরভ ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ এবং সম্ভাব্য অভিযোগের’ মুখোমুখি হবেন।

কে এই টেলিগ্রাম সিইও পাভেল দুরভ

পাভেল দুরভ অনেক লোকের কাছে অনেক কিছু। কারও কাছে তিনি প্রোগ্রামিং দুনিয়ার বিস্ময় তো কারও কাছে বিলিয়নিয়ার উদ্যোক্তা। কেউ তাঁকে ভাবেন ক্রেমলিনের পুতুল, কেউবা বাক্‌স্বাধীনতার যোদ্ধা। এই পাভেল দুরভের সঙ্গে অন্তত ১০০ শিশুর জিনগত সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ জৈবিক দিক বিচারে তিনি ১০০ সন্তানের বাবা।

দুরভের বড় পরিচয়, তিনি বার্তা আদান–প্রদানের অ্যাপ টেলিগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা। গত সপ্তাহে ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে করে ফ্রান্স সফরের সময় তাঁকে আটক করা হয়েছে। তাঁকে মেটা ও ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের মতো অসাধারণ বিবেচনা করা হয়। একই সঙ্গে বর্তমান এক্স (সাবেক টুইটার) প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডরসির অদ্ভুত জীবনযাপনের সঙ্গে তাঁর মিল পাওয়া যায়।

টেসলার প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্কের স্বাধীনচেতা হওয়ার বৈশিষ্ট্যও রয়েছে দুরভের মধ্যে। ইলন মাস্কের যেমন অনেক সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, সেটি দুরভের মধ্যেও রয়েছে। ১৫ বছর ধরে শুক্রাণু দান করে আসছেন দুরভ। গত জুলাইয়ে। তিনি স্বীকার করেন, তাঁর শুক্রাণু থেকে ১০০ সন্তান জন্ম নিয়েছে।

ব্লুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী, পাভেল দুরভের মোট সম্পদের পরিমাণ ৯১৫ কোটি মার্কিন ডলার। তাঁর অনেক দেশের পাসপোর্ট ও আবাস রয়েছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে তিনি সীমানাহীন এক জীবন যাপন করছেন। তাঁকে প্রায়ই খালি গায়ে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণে যেতে দেখা যায়। গণতান্ত্রিক হোক আর অন্য যেকোনো দেশের সরকারি বিভিন্ন সংস্কার নজরদারি এড়িয়ে মুক্ত যোগাযোগের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন তিনি।

তবে দুরভকে আটকের বিষয়টি এখন নতুন একটি বিতর্ক তৈরি করছে। তাঁর তৈরি টেলিগ্রাম অ্যাপ এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের মধ্যে নিরাপদ যোগাযোগের সুবিধা দেয়। এতে তৃতীয় পক্ষ ঢুকতে পারে না। ধারণা করা হচ্ছে, দুরভকে আটকে টেলিগ্রামের এনক্রিপশন প্রযুক্তিতে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করা হতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আয়ত্তে আনার জন্য যে চেষ্টা চালাচ্ছে, দুরভকে আটক করে বিষয়টি হাসিলের চেষ্টা করা হতে পারে।

এ বছরের শুরুতে ডানপন্থী বিশেষজ্ঞ টাকার কার্লসনকে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন দুরভ। এ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা নিজের সম্পর্কে বলেন, ১৯৮৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে তাঁর জন্ম। চার বছর বয়সে তাঁর পরিবার ইতালি চলে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তাঁর পরিবার রাশিয়ায় ফিরে আসে। তখন দুরভের বাবা সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেট ইউনিভার্সিটিতে কাজের সুযোগ পান।

দুরভ বলেন, তিনি ও তাঁর বড় ভাই নিকোলাই ছোট বয়স থেকেই গণিতে খুব ভালো ছিলেন। তবে ছোট হলেও তিনিই ছিলেন তারকা। তবে তাঁর ভাই ইতালির টেলিভিশনে গণিত প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পান। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডেও তিনি পুরস্কার পান। তবে দুরভ তাঁর স্কুল ও এলাকায় সেরা ছাত্র ছিলেন।

দুরভ বলেন, ‘আমরা দুজনেই কোড ও নকশা তৈরির ক্ষেত্রে খুবই আন্তরিক ছিলাম। তিনি বলেন, তাঁর পরিবার রাশিয়াতে ফেরার সময় আইবিএম পিসি এক্সটি কম্পিউটার এনেছিল। ওই সময় খুব কম রুশ পরিবারে প্রোগ্রামিং শেখার সুযোগ ছিল।

দুরভের কোডিং সক্ষমতা ও উদ্যোক্তা হওয়ার স্পৃহা তাঁকে ভিকোনটাকটে (ভিকে) নামের একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তৈরিতে উৎসাহ দেয়। ২১ বছর বয়সে ২০০৬ সালে তিনি ভিকে তৈরি করেন। অল্প সময়ে রাশিয়ার ফেসবুক হিসেবে পরিচিত পায় ভিকে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের সমকক্ষ হিসেবে রাশিয়ায় পরিচিত পান দুরভ।

কিন্তু ক্রেমলিনের সঙ্গে দুরভের সম্পর্ক খুব দ্রুত খারাপ হতে শুরু করে। ইউক্রেনের কিয়েভের বিক্ষোভকারীরা ভিকে ব্যবহার করে রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইভানোভিচের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেন। দুরভ বলেন, ২০১৩ সালের ওই সময়ে ক্রেমলিন তাঁকে ইউক্রেনীয় ব৵বহারকারীদের তথ্য তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য চাপ দেয়।

কার্লসনকে দুরভ বলেন, ‘আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি। এতে রুশ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়।’

দুরভের ওই সিদ্ধান্ত কোম্পানির ভাগ্য বদলে দেয়। দুরভ ভিকের সিইও পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। ওই পদে আসেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘনিষ্ঠ লোক। দুরভ তখন ভিকের সব শেয়ার বিক্রি করে রাশিয়া ছেড়ে যান। বর্তমানে ভিকে রুশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়।

দুরভ বলেন, ‘আমি কখনো ধনী হতে চাইনি। আমার জীবনের সবকিছু ছিল মুক্ত ও স্বাধীন থাকা। এ লক্ষ্য থেকে আমার মিশন হয়ে দাঁড়ায় অন্য ব্যক্তিদেরও মুক্ত বা স্বাধীনতার স্বাদ দেওয়া। তিনি বলেন, ‘আমি কারও কাছ থেকে আদেশ গ্রহণ করতে চাই না।’

বর্তমানে মেটা নামে পরিচিত সামাজিক মাধ্যমের সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে জাকারবার্গ যখন হোয়াটসঅ্যাপ কেনেন, তখন নিজের বার্তা আদান–প্রদানের অ্যাপ চালু করার সিদ্ধান্ত নেন দুরভ। ওই সময় এ ধরনের অনেক অ্যাপ বাজারে চালু ছিল। তবে যেগুলো চালু ছিল, সেগুলো তার কাছে যথেষ্ট ছিল না। ২০১৫ সালে প্রযুক্তিবিষয়ক ওয়েবসাইট টেকক্রাঞ্চকে দুরভ বলেন, ‘বাজারে কত বার্তা আদান–প্রদানের অ্যাপ আছে, সেটি বিষয় নয়; কারণ, ওইগুলো সবই বাজে।’

দুরভ আরও বলেন, টেলিগ্রাম তৈরির পেছনে ক্রেমলিনের অভিজ্ঞতা উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছে। পরে তিনি দুবাইভিত্তিক অ্যাপ হিসেবে টেলিগ্রাম চালু করেন। তিনি ও তাঁর ভাই মিলে সরকারি শিকারি চোখের আড়ালে থাকবে এমন অ্যাপ তৈরি করতে চেয়েছিলেন।

টেলিগ্রামের শক্তিশালী এনক্রিপশন প্রযুক্তি ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার নীতিমালার কারণে শুরু থেকেই লাখো মানুষ টেলিগ্রামে যুক্ত হয়। তবে একই সঙ্গে টেলিগ্রাম দুর্বৃত্তদেরও টেনে আনে। এর মধ্যে ২০১৫ সালের নভেম্বের প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে যুক্ত সন্ত্রাসীরাও টেলিগ্রাম ব্যবহার করেই তাদের যোগাযোগ করেছিল বলে অভিযোগ ওঠে।

দুরভ এর আগে অনেকটাই লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও এ ঘটনার পর থেকে তিনি বাইরে এসে প্রচার শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেন। তিনি সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, টেলিগ্রাম সন্ত্রাসীদের কোনো আখড়া নয়।

দুরভ দাবি করেন, বর্তমানে বাজারে থাকা যোগাযোগের অ্যাপগুলোর মধ্যে টেলিগ্রাম সবচেয়ে নিরাপদ। এই অ্যাপ থেকে সরকারকে পেছন দরজা দিয়ে তথ্য দিলে এর প্রতি জনগণের আস্থা কমবে ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষায় টেলিগ্রামের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হবে।

২০১৬ সালে দুরভ সিএনএকে বলেন, আপনি একে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ও সরকারের জন্য খুলে দিয়ে নিরাপদ করতে পারবেন না। এটি হতে হবে হয় নিরাপদ, নয় অনিরাপদ।

সরকারি অনুরোধে সাড়া না দেওয়ায় বিভিন্ন দেশের সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অ্যাপটি। এ তালিকায় সবার ওপরে রয়েছে রাশিয়া। ২০১৮ সালে এনক্রিপশন ভাঙার সুবিধা প্রত্যাখ্যান করায় মস্কো টেলিগ্রামকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ দিয়েছিল। নিষেধাজ্ঞার হুমকিতেও টলেননি দুরভ। ২০২০ সালে ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।

এর পরের কয়েক বছরে নিষেধাজ্ঞাহীনভাবে রাশিয়ায় চালু থাকা কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি হয়ে দাঁড়ায় এটি। এখন এটি রুশ সরকারের অনেক বিভাগের স্বীকৃত যোগাযোগ চ্যানেল।

দুরভের সমালোচকদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্ন তুলে আসছেন। তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, ক্রেমলিনকে ছাড় না দিয়ে কীভাবে টেলিগ্রাম এভাবে বাধাহীন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে? তবে দুরভ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি ২০১০ সালে রাশিয়ার সঙ্গে ঝগড়া করে দেশ ছাড়ার উদাহরণ দেন।

প্যারিসে আটক হওয়ার আগে দুরভ আজারবাইজান গিয়েছিলেন। প্রায় একই সময় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও দুই দিনের সফরে সেখানে যান। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ অবশ্য বলেন, দুজনের সাক্ষাৎ হয়নি।

দুরভ যদিও জনসম্মুখে রাশিয়া বিমুখ হওয়ার বিষয়টি দেখান, তারপরও প্যারিসে তাঁকে আটকের ঘটনায় রুশ সরকার দুরভের পক্ষে কাজ শুরু করে দিয়েছে। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন, প্যারিসে রুশ দূতাবাস দুরভের আইনি সমস্যা কথা জেনেই দ্রুত কাজ শুরু করে দিয়েছে।

অর্থ ও মাদক পাচারকারী এবং শিশুর প্রতি যৌন সহিংসতা ছড়ানো ব্যক্তিদের দ্বারা টেলিগ্রামের অপব্যবহারের বিষয়টি পশ্চিমা সরকারগুলোকে অস্থির করে তুলেছে।

সিএনএন-অধিভুক্ত বিএফএমটিভি জানিয়েছে, দুরভকে আটকের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগসূত্র নেই। টেলিগ্রামে কনটেন্ট মডারেশন (আধেয় মডারেশন বা ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি) সংক্রান্ত একটি পরোয়ানা থাকায় তাঁকে আটক করা হয়েছে।

এ ঘটনায় টেলিগ্রামের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, একটি প্ল্যাটফর্ম বা তার মালিককে সেই প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহারের জন্য দায়ী বলে দাবি করা অযৌক্তিক। টেলিগ্রাম ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আইন মেনে চলে। এ ছাড়া দুরভের লুকানোর কিছু নেই।

 

Exit mobile version