TechJano

দাঁত ভাঙা ‘৩২’

১ আর ০ (শূন্য)। দশমিক, অক্টা ও হেক্টাকে পরাভূত করে বিশ্ব শাসন করছে এই দ্বিমিক সংখ্যা। মর্ত্যের দুনিয়ায় সঙ্গম ঘটেছে ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে। তবে এই ডিজিটাল মাধ্যমকে উটকো কায়দায় বশে আনতে চলছে সরকারের নানা আয়োজন। এই আয়োজনের সর্বশেষ সংস্করণ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। তথ্যপ্রযুক্তি আইনকে ঘঁষে মেজে প্রণীত হয়েছে এই আইনের খসড়াটি।

এটা অনেকেরই জানা আছে, আইন পাসের পরই নিবর্তনমূলক ডিজিটাল আইন হয়ে ওঠে তথ্যপ্রযুক্তির ৫৭ ধারা। অনেক বিতর্কের পর তা এবার নেমে এসেছে ৫৭ থেকে ৩২। কমেছে ২৫ ধাপ। কিন্তু ঝাঁজ বেড়েছে ৫২ গুণ। মনে করিয়ে দিচ্ছে- বাঘে ছুঁলে এক ঘা আর পুলিশে ছুঁলে ১৮ ঘা প্রবাদ।

ডিজিটাল মাধ্যমে অনুসন্ধান হয়ে উঠছে (যেকোনও ধরনের ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড) গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ! ৫৭’র চেয়ে এই ৩২ এখন আর সংখ্যায় আটকে নেই। ৩২ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ অগ্রযাত্রায় চরম ‘উদ্বেগ’ এর নাম।

অবশ্য স্বাধীন বাংলদেশের অভ্যুদয়ে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর এখন সমান আবেগের স্থান হিসেবে বিবেচিত। কেননা এখানেই ঘাতকের বুলেটে নির্মমভাবে নিহত হন বাংলাদেশে প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কাকতালীয় হলেও বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের এলাকা কিন্তু ‘বত্রিশ (৩২)’ কিশোরগঞ্জ।

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিকভাবেও এই ৩২ কিন্তু একেবারেই অসার নয়। সেনাপতি জুলিয়াস সিজারের প্রণীত জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী এই ৩২তম বছরেই ঐতিহ্যবাহী রোম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। আর ভারতীয় সংস্কৃতির প্রচলিত লোককথার কিংবদন্তি চরিত্র রাজা বিক্রমাদিত্য বিখ্যাত হয়ে আছেন তার ‘৩২ সিংহাসন’ নিয়েই। আবার ফুটবলের সবচে বড় আসর বিশ্বকাপেও কিন্তু অংশ নেয় ৩২টি দেশ।

৫৭ ধারার পর এবার ‘৩২’ দিয়ে যে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ৩২ দাঁত ভেঙে ফেলার পাশাপাশি ডিজিটাল গণমাধ্যমের টুটি চেপে ধরা হচ্ছে সেই শঙ্কার যথেষ্ট কারণ লুকিয়ে আছে ৩১ ধারায়। এই ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ অরাজকতা সৃষ্টি করলে সাত বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। অর্থাৎ অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত কোন সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তার দায়ও বর্তাবে সাংবাদিক/সংবাদপত্রের ওপর! না কি এই দায় যে শেয়ার করবে তার ওপর! আইনের এই অস্পষ্টতা ডিজিটাল গণমাধ্যমের জন্য মোটেই কাম্য নয়।

এর বাইরেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৭ ও ২৫ ধারাটাও বেশ গোলমেলে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত খসড়া আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ যদি জনগণকে ভয়ভীতি দেখায় এবং রাষ্ট্রের ক্ষতি করে, তাহলে ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের দণ্ডিত হবেন। অন্যদিকে ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে আক্রমণাত্মক ভয়ভীতি দেখায়, তাহলে তাকে তিন বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানাসহ উভয় দণ্ডের দণ্ডিত হবেন। তাই ধারা দুটিকে একই অপরাধের দ্বিমিক বিধান মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

অবশ্য এসব ছাড়িয়ে নতুন এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারার ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ শব্দটি অনুসন্ধান সাংবাদিকতার ডিজিটাল রূপান্তরেই কেবল বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি সাক্ষাৎ বিষফোঁড় হয়ে দেখা দিয়েছে। শব্দ আর আইনের কানাগলিতে কণ্ঠরোধের গিঁটকে আরও জটিল থেকে কুটিল করা হয়েছে। এই যেমন ২০০৬ সালে প্রণীত ৫৭ ধারার বিকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত চারটি ধারাই যের ‘দুধারি তলোয়ার’ হয়ে উঠেছে। আইনের ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪ ধারাকে অপরাধকে আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অজামিনযোগ্য এ বিষয়টি দোষ প্রমাণের আগেই শাস্তি হিসেবেই বিবেচিত। একইসঙ্গে এই আইনের শাস্তি বিধানের আগে অপরাধ বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়নি। এটা প্রকারন্তরে জনমনে ডিজিটাল ভীতির সঞ্চারই করবে।

তাই নতুন করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চেয়ে বিদ্যমান আইনের ডিজিটাল রূপান্তরই হবে যৌক্তিক। আর শাস্তির বিধানের চেয়ে ডিজিটাল সুরক্ষার কৌশল রপ্ত করার পাশাপাশি এ খাতে দক্ষ কর্মী গড়ে তোলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। তাই অনতিবিলম্বে দেশে ডিজিটাল অপরাধ অনুসন্ধান, সনাক্তকরণ ও বিচারের মতো অবকাঠামো তৈরির দিকটাতেই এখন সবার আগে নজর দেয়া দরকার। কেননা চুরি/ডাকাতি তা শাবল দিয়ে লকার ভেঙেই হোক কিংবা হ্যাক করেই হোক না কেন তা কিন্তু চুরি/ডাকাতিই। বুদ্ধি ও কৌশলের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের মাধ্যম বা রূপ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও তা মোকাবেলার জন্য সমান বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা অর্জন করা দরকার। ব্রিটিশ কায়দায় নিবর্তনের পথ ধরে নয়। কেননা অধিক মাত্রার আইন কেবল চোরা পথেরই খোঁজ দেবে না; এটা একপর্যায়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের ৩২ দাঁতও ভেঙে দিতে পারে।

লেখক_ইমদাদুল হক: সাংবাদিক ও বিশ্লেষক

Exit mobile version