সরকারি হিসাবে গত বছর ৮শ’ মিলিয়ন (৮০ কোটি) ডলারের সফটওয়্যার রফতানি করেছে বাংলাদেশ। আগামী ডিসেম্বর নাগাদ এক বিলিয়ন ডলারের সফটওয়্যার রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে সফটওয়্যার নির্মাতাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এবার আনুষ্ঠানিকভাবে সফটওয়্যার ও সেবা পণ্যের রফতানি আয় নিয়ে একটি জরিপ বা গবেষণা করতে যাচ্ছে। এতে দেশ থেকে আসলেই কত টাকার সফটওয়্যার বা সেবাপণ্য রফতানি হয় সেই হিসাব বের হয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সরকারের টার্গেট ২০১৮ সালের মধ্যে এক বিলিয়ন এবং ২০২১ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলারের সফটওয়্যার ও সেবাপণ্য রফতানি করা। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারসহ বিভিন্ন পক্ষের ঘোষিত ৮০০ মিলিয়ন ডলার রফতানি আয় নিয়ে অনেকের মধ্যেই সংশয় রয়েছে। কারণ, এই ঘোষণার সঙ্গে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবের বিশাল ফারাক। ফলে অনেকেই বিষয়টি ঠিক বিশ্বাস করতে চান না। আর এসব বিবেচনায় নিয়েই বেসিস আনুষ্ঠানিক জরিপ বা গবেষণার উদ্যোগ নিয়েছে।
বেসিসের সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীরের ভাষ্য, ‘ইপিবি যে হিসাব দেয় তার বাইরে ফ্রিল্যান্সার, সফটওয়্যার ডেভেলপার ও কল সেন্টারগুলোর সেবা রফতানি আয়ের সঙ্গে যুক্ত করে ৮০০ মিলিয়ন ডলারের কথা বলা হয়। আমাদের ইনফরমাল সার্ভে রয়েছে। তাতে দেখা যায় সফটওয়্যার ও সেবাপণ্যের রফতানির পরিমাণ ৮০০ মিলিয়ন ডলার। তবে আমরা এবার একটি ফরমাল সার্ভে (আনুষ্ঠানিক জরিপ) করতে যাচ্ছি। ওই সার্ভের রিপোর্ট পেলেই আমরা সবাইকে জানাতে পারবো আমাদের রফতানির পরিমাণ কত। শিগগিরই টেন্ডারের মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠানকে বেছে নিয়ে সার্ভের দায়িত্ব দেওয়া হবে। চলমান ‘বেসিস সফটএক্সপো-২০১৮’ শেষ হওয়ার পরে আনুষ্ঠানিক জরিপের কাজ শুরু হতে পারে।
ইবিপি সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) দেশ থেকে সফটওয়্যার রফতানি (তথ্যপ্রযুক্তি রফতানি) হয়েছে ২০০ মিলিয়ন বা ২০ কোটি ডলারের। ইপিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি রফতানি আয় ১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। আর পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সফটওয়্যার রফতানির হিসাব দিয়েছে ২৫ কোটি ৮০ লাখ ডলারের। এর মধ্যে ফ্রিল্যান্সার, সফটওয়্যার ডেভেলপার ও কল সেন্টারগুলোর আয় অন্তর্ভুক্ত নয়। ফ্রিল্যান্সারদের আয় যোগ করে বলা হয়েছে ৮০০ মিলিয়ন বা ৮০ কোটি ডলার।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ২২ ফেব্রুয়ারি সফটওয়্যার মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমরা সফটওয়্যার তথা তথ্যপ্রযুক্তি রফতানিতে ৮০০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছি। চলতি বছরের বাকি সময়ে এক বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাব। আমাদের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলারের সফটওয়্যার রফতানি করা।’
বেসিস সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো ২৮ লাখ (২.৮ মিলিয়ন) ডলারের সফটওয়্যার রফতানি হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০৩ সালে বাংলাদেশ সফটওয়্যার রফতানি শুরু করে। ওই বছর রফতানির পরিমাণ ছিল ৭২ লাখ ডলার। এরপর ২০০৪-২০০৫ অর্থবছরে এক কোটি ২৬ লাখ ডলার, ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে ২ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ২ কোটি ৬০ লাখ ডলার, ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে ২ কোটি ৪৮ লাখ ডলার, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৩ কোটি ২৯ লাখ ডলার, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৩ কোটি ৫৩ লাখ ডলার, ২০১০-১১ অর্থবছরে চার কোটি ডলার, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১০০ মিলিয়ন (১০ কোটি) ডলার অতিক্রম করে। ওই অর্থবছরে মোট রফতানির পরিমাণ ছিল ১০ কোটি ১৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এই আয় বেড়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১২ কোটি ৪৭ লাখ ২০ হাজার ডলার ও ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে প্রায় ১৩ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই খাত থেকে সর্বোচ্চ ৭০০ মিলিয়ন ডলার রফতানি আয় হয়।
বেসিস সূত্রে জানা যায়, সফটওয়্যার রফতানি খাতে বাংলাদেশ যে পরিমাণ আয় করে তার বেশিরভাগই ব্যক্তি উদ্যোগে। বিদেশের বাজারে বাংলাদেশের সফটওয়্যার নির্মাতাদের তৈরি ইআরপি সলিউশনের চাহিদা বেশি। এর পাশাপাশি চ্যাটধর্মী অ্যাপ্লিকেশন, বিলিং সফটওয়্যার, মোবাইল অপারেটর ও নেটওয়ার্ক পরিচালনার সফটওয়্যারের চাহিদা রয়েছে। সফটওয়্যার রফতানির পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারি পর্যায়ের ডিজিটালাইজেশনের কাজে বাংলাদেশের একাধিক প্রতিষ্ঠান ভালো কাজ করছে। দোহাটেক নেপালে ই-প্রকিওরমেন্টের কাজ করছে, সাউথটেক একটি দেশের সরকারের ডিজিটালাইজেশনের কাজ করছে। টাইগার আইটি বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। এমনকি রিভ সিস্টেম ভালো কাজ করছে। ডাটাসফটের কথাও উল্লেখ করেন তিনি। তার নিজের প্রতিষ্ঠানও মালয়েশিয়া ও ভারতে কাজ করছে বলে তিনি জানান। সিস্টেক ভুটানে বিডিংয়ের মাধ্যমে ডিজিটালাইজেশনের কাজ পেয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বে আউটসোর্সিং তালিকায় বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচ লাখ কাজ করেন মাসিক আয়ের ভিত্তিতে। বেসিস সফটএক্সপো ২০১৮ এর দ্বিতীয় দিন শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের সেলিব্রিটি হলে ‘ফ্রিল্যান্সার কনফারেন্স’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানানো হয়।
সেমিনারে ফ্রিল্যান্সিং খাতের বিভিন্ন অবস্থা তুলে ধরেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর। উপস্থিত ছিলেন ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আরফান আলী, গুগল লোকাল গাইডস কমিউনিটি মডারেটর সুমাইয়া জাফরিন চৌধুরিসহ বিভিন্ন খাতের ব্যক্তিরা।
সৈয়দ আলামাস কবীর বলেন, শুধু ফ্রিল্যান্সার হলেই শর্ত সাপেক্ষে বেসিস সদস্য হওয়া সম্ভব। মুনাফা অর্জিত হলেই তাকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলে তা তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। সরকার স্টার্টআপদের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। ব্যাংকও এ খাতে কাজ করছে। অর্থাৎ, বাজার তৈরি আছে। বেসিস থেকে ফ্রিল্যান্সারদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী বলেন, ফ্রিল্যান্সারদের সুবিধা দিতে বেসিসের সঙ্গে মিলে স্বাধীন নামে প্রি পেইডকার্ড চালু করা হয়েছে। এ কার্ডের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সাররা বিদেশ থেকে দেশে লেনদেন করতে পারবেন। আউটসোর্সিং এখন বাংলাদেশ তরুণদের কাছে দারুণ একটি ক্যারিয়ার হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে। দেশি তরুণেরা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, নির্দিষ্ট কাজে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে যে কেউ ফ্রিল্যান্সার হতে পারে। তবে কাজে দক্ষ হয়ে তবে এ পেশায় আসা উচিত। দেশে বিল্যান্সার নামে একটি ফ্রিল্যান্সিং মার্কেট রয়েছে। এ ছাড়াও পেওনিয়ার ফ্রিল্যান্সারদের আন্তর্জাতিক অর্থ প্রাপ্তিতে দারুণ কাজ করছে। ফ্রিল্যান্সারদের উৎসাহ দিতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সরকার।