TechJano

ফেসবুকের ২% মালিক হওয়ার গল্প

মার্কিন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা মার্ক হিউজেস নামটি খুব পরিচিত নয়। কিন্তু ফেসবুকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গকে অনেকেই চেনেন। বর্তমানে ২১০ কোটির বেশি ব্যবহারকারীর ফেসবুক প্রতিষ্ঠার সময় মার্ক জাকারবার্গের সঙ্গে ছিলেন মার্ক হিউজেস। জাকারবার্গ তাঁকে ফেসবুকের ২ শতাংশ শেয়ার দেন। কিন্তু কীভাবে ওই দুই শতাংশের মালিক হলেন তিনি, আর কীভাবেই বা গড়ে উঠল আজকের ফেসবুক, তা গল্প শুনিয়েছেন হিউজেস।
প্রযুক্তি বিষয়ক ওয়েবসাইট বিজনেস ইনসাইডারের প্রতিবদনে বলা হয়েছে, ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা করতে মার্ক জাকারবার্গ অনেক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। ফেসবুককে আজকের জায়গায় আনতে অনেক পরিশ্রম করেছেন তিনি। তাঁকে এ কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন কিছু কাছের মানুষ। মার্ক হিউজেস তাঁদেরই একজন। জাকারবার্গসহ তাঁদের ফেসবুকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মার্ক জাকারবার্গের সঙ্গে একই কক্ষে থাকতেন কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ের ছাত্র এডওয়ার্ডো সেভারিন, ডাস্টিন মস্কোভিস এবং ক্রিস হিউজেস। চারজন মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ফেসবুক।
কে এই ক্রিস হিউজেস? তাঁকে অনেকেই চেনেন মার্কিন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা হিসেবে। বর্তমানে কাজ করছেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের আর্থিক বৈষম্য কমানোর প্রকল্পে। তাঁর পুরো নাম ক্রিস্টোফার ক্রিস হিউজেস। ১৯৮৩ সালের ২৬ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। নর্থ ক্যারোলাইনারা হিকোরিতে তিনি বেড়ে ওঠেন। ম্যাসাচুসেটসের ফিলিপস অ্যাকাডেমি ইন অ্যান্ড্রোভার থেকে স্নাতক হন তিনি। ২০০২ সালে হার্ভার্ডে ভর্তি হন তিনি। জাকারবার্গের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ফেসবুকের শুরুর দিনগুলোতে ফেসবুকের জন্য কাজ করেন। ওই সময় ফেসবুকের পরীক্ষামূলক সংস্করণ পরীক্ষা করা ও পণ্য সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়া ছিল তার কাজ। ফেসবুকের অনেক জনপ্রিয় ফিচার এনেছেন তিনি। তার হাত ধরেই ফেসবুকের বিশ্বমঞ্চে আসার যাত্রা শুরু। ২০০৪ সালে হিউজেস, জাকারবার্গ ও মস্কোভিজ গ্রীষ্মের ছুটিতে পালো আলটো ভ্রমণ করেন। ওই ছুটির পর জাকারবার্গ ও মস্কোভিজ পালো আলটোতে থেকে যান আর হিউজেস হার্ভার্ডে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ঠিক করেন। ২০০৬ সালে ইতিহাস ও সাহিত্যে স্নাতক হন তিনি। এরপর তিনি আবার জাকারবার্গের সঙ্গে যুক্ত হন। তবে ২০০৭ সালে হিউজেস ফেসবুক ছেড়ে দেন এবং বারাক ওবামার ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট প্রচারের সঙ্গে যুক্ত হন। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দ্য নিউ রিপাবলিকের সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। সম্প্রতি তিনি ‘ফেয়ার শট: দ্য রিথিংকিং ইনইকুয়ালিটি অ্যান্ড হাউ উই আর্ন’ নামের বই লিখেছেন।
ওই বইটি নিয়ে সম্প্রতি বিজনেস ইনসাইডারের সঙ্গে আলোচনায় বসেন ক্রিস। সেখানেই তিনি ফেসবুকের ২ শতাংশের মালিক হওয়ার কাহিনি বর্ণনা করেন। ক্রিস জানিয়েছেন, অনলাইন সোশ্যাল ডিরেক্টরি হিসেবে পরিচিত ছিল ফেসবুক। তিনি সাইটটির প্রথম দিককার মুখপাত্র ছিলেন। জাকারবার্গ, মস্কোভিজ, স্যাভেরিন ও অ্যান্ড্রু ম্যাককলামের সঙ্গে হার্ভাডের ডরমিটরির একই কক্ষে থাকতেন। ওই কক্ষ থেকেই যাত্রা শুরু হয় ফেসবুকের। বর্তমানে তাঁর কাজের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে ২০০৪ সালের মার্চ মাসের এক বর্ষণমুখর রাতে জাকারবার্গের সঙ্গে তার একান্ত কাটানো কিছু সময় ওই গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলাপ। ওই আলাপের পর থেকেই তার জীবন অন্যদিকে মোড় নিতে শুরু করে। ওই রাতের আলোচনার ফল পান ৮ বছর পরে এসে। ২০১২ সালেই কোটিপতি হয়ে যান ক্রিস। প্রায় অর্ধ কোটি ডলারের মালিক বনে যান ক্রিস।
ক্রিস তার বইতে লিখেছেন, যে চারজন জাকারবার্গের ফেসবুক স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সাহায্য করেছিলেন তাঁদেরই একজন ছিলেন তিনি। ফেসবুকে মাত্র তিন বছর সময় দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু ওই তিন বছরে ফেসবুকের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হয়েছিল তাঁকে। ফেসবুকের মার্কেটিং ও মিডিয়া দেখার দায়িত্ব ছিল তাঁর।
হিউজেস বলেন, ছোট ছোট অনেক সিদ্ধান্ত ও ছোট ছোট আলাপ মানুষকে অন্যদের চেয়ে পৃথক করে ফেলতে পারে। জাকারবার্গের সঙ্গে এক আলাপে এমনটাই ঘটেছিল। ফেসবুক প্রতিষ্ঠার কয়েকমাস পরে তিনি ও জাকারবার্গ একসঙ্গে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। ফেসবুকের শেয়ার ভাগাভাগি নিয়ে আলাপ করেছিলেন। ওই রাতের আলোচনার আগে হিকস হাউজ লাইব্রেরিতে ঘণ্টায় ১০ ডলার চুক্তিতে কাজ করতেন হিউজেস। তার কাজ ছিল শিক্ষার্থীদের আইডিগুলো ঠিকঠিক আছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা। এ সময় তারা এওএল ইনস্ট্যান্ট মেসেঞ্জারে ফেসবুকের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। হার্ভার্ড ছাড়িয়ে স্কুলগুলোতে ফেসবুককে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া ফেসবুকে মালিকানা চেয়ে বসেন হিউজেস।
মুখোমুখি আলাপের জন্য হিউজেসকে ডাকেন জাকারবার্গ। বৃষ্টি হওয়ায় ছাতা নিয়ে বের হন হিউজেস। সেসময় হার্ভাডের ডরমিটরির ঢোকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন জাকারবার্গ। দুজনই চাইছিলেন তাদের আলাপ যাতে কেউ না শোনে। তাই একই ছাতার নিচে দুজন বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে শুরু করেন। গেট থেকে বের হতে হতে হিউজেস বলেন, ফেসবুকের ১০ শতাংশ মালিকানা তাকে দিতে হবে। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে শুরু হয় দর কষাকষি। ওই সময় ফেসবুকের ইউজার এক্সপেরিয়েন্স বিষয়ে সাহায্য করছিলেন হিউজেস। এ ছাড়া ফেসবুকের মার্কেটিং ও মিডিয়া প্রসারে কাজ করেন। তার কাছে মনে হয়েছিল, ফেসবুকের ১০ শতাংশ মালিকানা চাওয়া উচ্চাকাঙ্খী হতে পারে তবে অযৌক্তিক নয়।
বইতে হিউজেস লিখেছেন, তার দাবি জাকারবার্গ মেনে নেননি। বলেন, তোমার কাজের প্রশংসা করি আমি। তবে ফেসবুক বড় হলে আরও বেশি আয়ের নিশ্চয়তা দিয়ে বলেন, ফেসবুকে তাঁর নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি। কারণ, অন্যান্য সহ-প্রতিষ্ঠাতাদের ন্যায্য ভাগ দেওয়ার পক্ষে তিনি। জাকারবার্গের কথায় চুপ হয়ে যান হিউজেস। তিনি কথোপকথনে অন্য মোড় ঘুরাতে চাননি। আলোচনার গুরুত্ব বুঝে জাকারবার্গের কথা মেনে নেন।
হিউজেস এ সময় দ্বিধায় পড়ে যান। জাকারবার্গের কাছে করা অনুরোধ নিয়ে খুব বেশি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না। কারণ ফেসবুকে তার সরাসরি ভূমিকা ছিল না, এ কথা জানতেন তিনি। তাই জাকারবার্গের কাছে মালিকানা নিয়ে জোর করতে পারেননি। জাকারবার্গকে হাঁটতে হাঁটতেই বলেছিলেন, ফেসবুকে শেয়ার হিসেবে যেটা জাকারবার্গ ভালো বলে বিবেচনা করবে সেটাই যেন তাকে দেওয়া হয়। জাকারবার্গ এর উত্তরে বলেন, বিষয়টি ভেবে দেখার কথা বলেন। এর কিছুদিন পরে হিউজেস দেখলেন, জাকারবার্গ তাকে ফেসবুকের ২ শতাংশ মালিকানা দিয়েছেন। ফেসবুকের সহ-প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে হিউজেসের ভাগটিই ছিল সবেচেয়ে কম।
তবে ফেসবুকের ওই ২ শতাংশই বা কম কিসে? ২০১২ সালে ফেসবুক যখন আইপিও ছাড়ে তখন ৫০ কোটি মার্কিন ডলারের মালিক বনে যান হিউজেস। তাই সেদিনের ওই ছোট আলাপকে হিউজেস বলেন, দর কষাকষিতে ওই ঘটনা সাময়িক ব্যর্থতা হলেও তার জীবনে সফল একটি ঘটনা।

Exit mobile version