TechJano

ফ্যাশন পণ্য ডিজিটাল মার্কেটিং : বিক্রি বাড়ানোর সহজ ৭ কৌশল

জিন্স কেনার উদ্দেশে একদিন একটা ফ্যাশন স্টোরে ঢুকলাম | তো অনেকক্ষণ খোজাখুজির পর একটা দারুন জিন্স পাইলাম-কমফরটেবল এবং পরে দেখলাম বেশ ভালো লাগছে | যাইহোক মোটামুটি মাইন্ডসেট নিয়ে নেব, এমন সময় দেখলাম জিন্স টা হাটুর কাছে একটু ছেড়া | সেলস পারসনকে বললাম ভাই এটা ছেড়া আপনি আরেকটা দেখান | সে এই কথা শোনা মাত্র কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো – তারপর বলল স্যার এটা ছেড়া না এটা ফ্যাশন, এটাকে বলে টর্ন জিন্স | আমি বললাম ওহ: আচ্ছা | মনে পরে গেল রবিন্দ্রনাথের সেই মহান উক্তি – ‘ফ্যাশন হলো মুখোশ আর স্টাইল হলো মুখশ্রী’|

উপরের কথা গুলা আসলে বলার উদ্দেশ্য হলো একজন ফ্যাশন মার্কেটারকে ফ্যাশন, স্টাইল, বর্তমান সময়ের ফ্যাশন ট্রেন্ড, টার্গেট অডিয়েন্স ইত্যাদি সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে | কারণ নরমাল মার্কেটিং এবং ফ্যাশন মার্কেটিংয়ের মধ্যে একটু পার্থক্য আছে যেমন ধরুন ২২ বছর বয়সের একজন সাধারণ মেয়ে এবং একই বয়সের একজন ছাত্রীর ফ্যাশন বা স্টাইল এক না | সুতরাং একজন ফ্যাশন মার্কেটারকে, সে যে পোশাকের জন্য মার্কেটিং করতে যাচ্ছে সেইটাকে মাথায় রেখে টার্গেট অডিয়েন্স সেট করতে হবে|

বাংলাদেশে সারা বছরে প্রায় আট হাজার কোটি টাকার মার্কেট ধরতে ছুটে চলেছে প্রায় সাড়ে পাচ হাজারের উপরে ফ্যাশন ও বুটিক হাউস গুলো সাথে আছে এক হাজারের উপরে ই-কমার্স সাইট ও ১০ হাজারের মত ফেইসবুক পেজ (ফেইসবুকের মাধ্যমে পণ্য বেচার পেজ). এখন প্রশ্ন হলো এত বড় ফ্যাশন মার্কেটের ভিড়ে কিভাবে নিজের ব্র্যান্ডকে একটু আলাদা করবেন, উত্তর একটাই – ফ্যাশন ডিজিটাল মার্কেটিং |

এবার আসা যাক – ফ্যাশন ডিজিটাল মার্কেটিং-এর মাধ্যমে কিভাবে আপনার ব্র্যান্ড প্রেজেন্সকে আরও শক্তিশালী এবং বিক্রয় বৃদ্ধি করতে পারবেন |

১. রিটার্গেটিং – সাধারণতঃ মানুষ একবার কোনো অ্যাড বা ওয়েবসাইট ভিজিট করেই পণ্য কেনার ডিসিশন নেয় না বা নিতে পারে না | কারণ অনলাইনে মানুষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মুডে থাকে | এই ক্ষেত্রে সমাধান হলো আপনার ওয়েবসাইটের ভিজিটরদের কে রিটার্গেটিং করা | গুগল অ্যাডওয়ার্ডস এবং ফেইসবুক উভয়ই রিটার্গেটিংয়ের জন্য ব্যবহার করতে পারেন | রিটার্গেটিং হলো কোনো ভিজিটর আপনার ওয়েবসাইট একবার ভিজিট করার পর সে অনলাইনে যেখানেই যাক আপনার অ্যাড দেখতে পাবে | এভাবে যদি সে প্রতিদিন ১০-১৫ বার আপনার ব্র্যান্ডের বিভিন্ন অ্যাড দেখে কোনো এক সময় সে প্রোডাক্ট কিনে ফেলবে আর যদি নাও কিনে অনন্ত আপনার ব্র্যান্ড সম্পর্কে জেনে গেল |
২. ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং – ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিংকে বলা হয় ফিউচার মার্কেটিং কিন্তু এটা এখন আর ফিউচার না বর্তমানে এর সাকসেস রেট অনেক বেশি তাছাড়া এটা সামগ্রিক মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রেও গুরুত্ব বহন করে | ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং হলো একটা ব্র্যান্ডকে ইন্ডাস্ট্রির ‘কী পিপুল’ যাদের ইন্ডাস্ট্রিতে একটা ভ্যালু আছে তাদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে পৌছে দেয়া | বাইরের দেশে অনেক ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটার পাওয়া যায় কিন্তু বাংলাদেশে এটা নেই বললেই চলে | সেক্ষেত্রে আপনার একটা স্ট্রাটেজি হতে পারে ফ্যাশন মডেলদের কে ব্যবহার করা | ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং-এ সাধারনত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা হয় | তাই সেই সব মডেলদেরকেই ব্যবহার করা ভালো যাদের ফেইসবুক বা ইনস্টাগ্রামে অনেক ফলোযার আছে | এদেরকে ব্যবহার করতে পারেন এই ভাবে যে আপনি আপনার ব্রান্ডের ড্রেস পরিয়ে শুট করে তাদের পেজ থেকে শেয়ার করা অথবা তাদের পেজ থেকে আপনার ব্র্যান্ডকে রিভিউ বা এনডোর্স করা | এতে যেটা হয় নতুন অডিয়েন্স পাশাপাশি এক্জিস্তিং কাস্টমারদের কাছে আপনার ব্রান্ডের বিশ্বাস যোগ্যতা বাড়ে |

৩. ইমেইল বা এস.এম.এস রিমাইন্ডার – আপনার ওয়েবসাইটে এমন কিছু ভিজিটর আছে যারা কদাচিত অথবা নিয়মিত কেনাকাটা করে আপনার ওয়েবসাইট অথবা স্টোর থেকে| এই ক্ষেত্রে যেটা হয় অনেক সময় তারা ওয়েবসাইটের বিভিন্ন পেজে বিভিন্ন সময়ে ভিজিট করে এবং তাদের পছন্দসই পণ্য গুলো ‘ফেভারিট’ বা ‘অ্যাড টু কার্ট’ লিস্টে রেখে দেয় পরে কিনবে তাদের সুবিধামত সময়ে এই সব চিন্তা করে | একজন মানুষের কাছে আসলে অনেক ব্র্যান্ডই ভালো লাগতে পারে তো সেই কারণে সে সব ব্রান্ডের ওয়েবসাইট ভিজিট করে এবং তার পছন্দসয় পণ্য গুলা ‘ফেভারিট’ বা ‘অ্যাড টু কার্ট’-এ রেখে দিতে পারে | এই ক্ষেত্রে যেটা হয় সে অনেক সময় ভুলে যেতে পারে আপনার ব্র্যান্ডকে কারণ সে তার প্রিয় ব্র্যান্ড গুলোর সব ওয়েবসাইটেই এগুলা করে থাকে | সুতরাং তাদেরকে মানে যারা আপনার ওয়েবসাইটে ‘ফেভারিট’ বা ‘অ্যাড টু কার্ট’-এ পণ্য পছন্দ করে রেখেছে তাদেরকে টার্গেট করে ইমেইল বা এস.এম.এস রিমাইন্ডার দিতে পারেন | এতে আপনার বিক্রয় বৃদ্ধি পাবে |

৪. বার্থডে উইশিং – বার্থডে বা জন্মদিন সব সময়ই সবার কাছে একটা আবেগের বিষয় | আর একজন মার্কেটারকে সেটাই পুঁজি করে তার কাস্টমারকে নার্চার করতে হয় | বার্থডেতে আসলে একজনকে অনেক জায়গা থেকে উইশ করে – তার পরিবার থেকে, বন্ধুদের কাছ থেকে, প্রিয়জনের কাছ থেকে ইত্যাদি এবং সে এটা আশাও করে | এখন যদি আপনি আপনার কাস্টমারকে বার্থডেতে উইশ করেন, তখন তার কাছে এটা একটু আলাদা মনে হবে, আশ্চর্য হবে এবং ভাববে আপনি তাকে আলাদা কেয়ার করছেন বা ভ্যালু দিচ্ছেন কারণ এটা সে আশায় করে না | এভাবে আপনার ব্র্যান্ডের লয়ালটি পাশাপাশি বিক্রিও বাড়বে | এখন প্রশ্ন হলো এটা আপনি কিভাবে করবেন ? খুব সিম্পল | যারা আপনার শপ বা অনলাইনে এসে পণ্য কেনে তাদের কাছ থেকে তাদের নাম, মোবাইল নম্বর, ইমেল আইডি এবং জন্মদিন সংগ্রহ করে ডাটাবেসে রেখে দিন | এবার প্রতিদিন ঐ ডাটাবেসকে ব্যবহার করে তাদেরকেই ইমেল ও এস.এম.এস পাঠিয়ে উইশ করুন যাদের ঐদিনে জন্মদিন | এই ক্ষেত্রে আপনি তাদেরকে বিশেষ অফারও (যেমন ১০% ডিসকাউন্ট) দিতে পারেন | এতে আপনার বিক্রয় বৃদ্ধি পাবে |

৫. স্টাইল গাইড – স্টাইল গাইড হলো একটা ব্রান্ডের যে বিভিন্ন রকম পোশাক যেমন শার্ট, টি-শার্ট, ডেনিম, বটম, সালোয়ার-কামিজ, টিউনিক ইত্যাদি সংগ্রহ থাকে সে গুলোকে নিয়ে একটা বই বা গাইড তৈরী করা যেখানে গল্প আকারে বর্ণনা করা হয় কিভাবে পোশাক গুলা পরতে হয়, কোনটার সাথে কোনটা ম্যাচিং করে পরতে হবে, কখন এবং কোন সিজনে পরলে ভালো হবে, পোশাকের তৈরিতে কি কি উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে, কেন এই উপাদান গুলা ব্যবহার করা হয়েছে পাশাপাশি এটা কিভাবে একজন ব্যবহারকারীর দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলবে ইত্যাদি |
এটা হতে পারে বিভিন্ন অকেশন বা সিজনকে টার্গেট করে যেমন স্প্রিং, সামার, উইন্টার, ফল, ওয়েডিং, পার্টি, ওয়ার্ক, ট্রাভেল, হলিডে ইত্যাদি | এটা আপনি আপনার ওয়েবসাইটে রেখে প্রমোশন করতে পারেন সোশ্যাল মিডিয়া, এস.এম.এস বা ইমেইল মার্কেটিং-এর মাধ্যমে অথবা লিফলেট আকারে বিলি করতে পারেন যেটা আপনার বিক্রয় বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে |

৬. নার্চারিং পিপল – যারা প্রথম আপনার স্টোর বা ওয়েবসাইটে আসে সাধারনত সব সময় তারা কোনো প্রোডাক্ট কিনতে প্রস্তুত থাকে না | ওই সমস্ত কাস্টমারের কাছ থেকে খুব কৌশলে নাম, মেইল আইডি বা ফোন নম্বর নিয়ে রাখতে পারেন | তারপর তাদেরকে টার্গেট করে এস.এম.এস বা ইমেইল মার্কেটিং করে তাদেরকে জানাতে পারেন আপনার নতুন নতুন কালেকশন, এক্সক্লুসিভ কালেকশন, সিজনাল কালেকশন ইত্যাদি এবং যখন আপনি এটা করবেন তখন সে এর মাধ্যমে আপনার ব্র্যান্ডকে রি-কল করতে পারবে এবং এক সময় সে কিছু কেনার জন্য আপনার স্টোরে আসবে এবং কিনবে |

৭. গিফট গাইড – ১২ মাসে ১৩ পার্বনের দেশ বাংলাদেশ | তাই বছর জুড়েই আসলে কোনো না কোনো অনুষ্ঠান লেগেই থাকে বাংলালির জীবনে যেমন জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী, ভেলেন্টাইন ডে, মাদারস ডে, ঈদ, পূজা ইত্যাদি এবং মানুষ বছর জুড়েই এই সব সামাজিক অনুষ্টানকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন গিফট কিনে থাকে তার প্রিয় মানুষদের জন্য | মানুষ সব সময় কাউকে কোনো কিছু গিফট করতে গিয়ে একটু দ্বিধাদন্দে ভোগে-কি দেব, কেমন জিনিস দিলে ভালো হবে, কোথায় পাব ইত্যাদি | আর সুজোগটাকেই ফ্যাশন মার্কেটাররা ব্যবহার করতে পারে যেমন তারা জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী, ভেলেন্টাইন ডে, মাদারস ডে, ঈদ, পূজা ইত্যাদি বিষয় গুলা মাথায় রেখে গিফট গাইড তৈরী করতে পারে | গিফট গাইড হলো আসলে কিছু আইটেম-এর সমষ্টি যেটা আপনি আপনার স্টোর বা অনলাইনে বিক্রি করতে চান | এবং এই গিফট গাইড টা আপনি আপনার ওয়েবসাইটে রেখে প্রমোশন করতে পারেন সোশ্যাল মিডিয়া, এস.এম.এস বা ইমেইল মার্কেটিং-এর মাধ্যমে যেটা আপনার বিক্রয় বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে |

লেখক: শামীম হুসাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং পরামর্শক।
ফেসবুক আইডি: https://www.facebook.com/iceshamimiu

Exit mobile version