TechJano

ভবিষ্যৎ কম্পিউটার কী কনট্যাক্ট লেন্স

কম্পিউটারের পর্দায় যেমন তথ্য ভেসে ওঠে তেমনি চোখের সামনে তথ্য তুলে ধরবে স্মার্ট কনট্যাক্ট লেন্স। ধরুণ আপনি কোন কিছু উপস্থাপনা করছেন, বার বার আপনার নোটের দিকে তাকাতে হচ্ছে। এতে আপনার জন্য তা বিরক্তিকর। কিন্তু এর বদলে যদি চোখে বসানো স্মার্ট কনট্যাক্ট লেন্সেই যেদিকেই তাকান না কেন, প্রয়োজনীয় শব্দ ও তথ্য ভেসে ওঠে তবে কেমন হবে? স্মার্ট কনট্যাক্ট লেন্স নির্মাতারা দাবি করছেন, তাঁরা এমনই এক উন্নত প্রযুক্তির লেন্স তৈরি করতে যাচ্ছেন যাতে অসংখ্য দরকারি ফিচার থাকবে। এর মধ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত দেখা নেওয়ার ফিচারটিও জায়গা করে নেবে। শিগগিরই হয়তো এ ধরনের স্মার্ট লেন্স হাতের নাগালে চলে আসবে।

অত্যাধুনিক প্রযুক্তির স্মার্ট লেন্স তৈরিতে কাজ করছে মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মজো। তাঁদের নিয়ে বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিবিসিকে মজোর বিপণন বিভাগের কর্মকর্তা স্টিভ সিনক্লেয়ার বলেন, ‘আপনি সংগীতশিল্পী হিসেবে চোখের সামনে লিরিকস, কর্ড দেখে নিতে পারবেন। অ্যাথলেট হিসেবে দেখে নিতে পারবেন শারিরীক বিভিন্ন তথ্যসহ দরকারি তথ্যের সবকিছু।’

সিনক্লেয়ারের প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখনো তাদের তৈরি স্মার্ট লেন্স পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করা হচ্ছে না। তাদের তৈরি এই লেন্স মানুষের চোখে পরীক্ষার পর অনুমোদন পেতে হবে। এই লেন্স যিনি পরবেন তাঁর সামনে একটি ডিসপ্লে ভেসে ওঠবে এবং তা চোখের সামনেই থাকবে।

মজোর তৈরি এই লেন্সকে বলা হচ্ছে স্কেলার লেন্স। এটি মূলত চোখের সাদা অংশের চেয়ে বড়। এটি একদিকে যেমন মানুষের দৃষ্টিশক্তি ঠিক করবে। তেমনি এতে যুক্ত থাকা মাইক্রো এলইডি ডিসপ্লে, স্মার্ট সেন্সর ও বিশেষ  সলিড স্টেট ব্যাটারি।

সিনক্লেয়ার বলেন, ‘ফিচারসম্পন্ন প্রটোটাইপ কনট্যাক্ট লেন্স তৈরি করা হয়ে গেছে। এটি কাজে লাগানো ও চোখে পরা যায়। আমরা অভ্যন্তরীণভাবে এটি পরীক্ষা শুরু করেছি। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা চালানো হবে। তা হচ্ছে এর দক্ষতা ও কার্যক্ষমতা দেখার পরীক্ষা। এটি সারাদিন চোখে পরে থাকা যাবে কিনা সে পরীক্ষা করে দেখা হবে।’

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অপটোমেট্রিক সায়েন্সের প্রশিক্ষক রেবেকা রোজাস বলেছেন, লেন্সগুলোতে নিজে থেকে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা এবং ইন্ট্রা-অকুলার প্রেসার বা গ্লুকোজ ট্র্যাক করার ক্ষমতা অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। যাঁদের ডায়াবেটেস সমস্যা আছে তাদের গ্লুকোজের মাত্রা জানা জরুরি। এতে বিশেষ ওষুধ প্রয়োগের সক্ষমতাও যুক্ত হতে পারে। এতে একদিকে যেমন রোগ নির্ণয় করা যাবে তেমনি রোগের প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করাও যাবে। এখন দেখার বিষয় প্রযুক্তি কতোটা অগ্রসর হয়েছে এবং রোগীর সুস্থতার জন্য কতোটা সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

গবেষকেরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন সমস্যা শনাক্ত ও চিকিৎসার জন্য স্মার্ট লেন্স তৈরির কথা বলেছেন। এর মধ্যে রয়েছে চোখের সমস্যা, ডায়াবেটিস এবং ক্যানসারের ফলে সৃষ্ট নানা জটিলতা শনাক্তের জন্য লেন্স।

সম্প্রতি চীনের একদল গবেষক এক ধরনের  নমনীয় কনট্যাক্ট লেন্স তৈরির কথা বলেছেন যা চোখের চাপ শনাক্ত করতে পারে। এরপর এই লেন্স থেকে বিশেষ ধরনের ওষুধ বের হয়ে চোখের চাপ কমাতে সাহায্য করে। গবেষকেরা বলছেন, নতুন স্মার্টলেন্সটি নিয়ে এখনো পরীক্ষা চলছে। এটি এখনো মানুষের ক্ষেত্রে পরীক্ষা করা হয়নি। এই লেন্স কেবল শূকর ও খরগোশের চোখে পরীক্ষা করা হয়েছে।

একে অবশ্য প্রযুক্তিগত দিক থেকে যুগান্তকারী উদ্ভাবন হিসেবেই দেখছেন গবেষকেরা। এর আগে বেশ কিছু গবেষক চোখের চাপ পরিবর্তন বা চোখে ওষুধ সরবরাহের বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেন। কিন্তু কখনোই দুটি সমস্যা একত্রে সমাধানের বিষয়টি নিয়ে কাজ করা হয়নি। চীনের গবেষকেরা এবারে উভয় প্রযুক্তি একত্রে যাতে কাজ করে তা নিয়ে গবেষণা করেন। এতে স্মার্ট লেন্স আগে চোখের চাপ শনাক্ত করে সে অনুযায়ী ওষুধ প্রয়োগ করতে পারবে।

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা এক ধরনের স্মার্ট কনট্যাক্ট লেন্স তৈরি করেছেন যাতে বিশেষ ফটো ডিটেক্টর রয়েছে। এটি অপটিক্যাল তথ্য গ্রহণ করতে পারে। এতে কর্ণিয়া সমস্যা সমাধান করার জন্য বিশেষ তাপমাত্রা মাত্রার সেন্সর রয়েছে। এ ছাড়াও চোখের তরল থেকে গ্লুকোজ মাপার সেন্সর রয়েছে। এ লেন্স ব্যবহার করে চোখের সার্বিক অবস্থা বুঝতে পারবেন চিকিৎসকেরা।

সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি স্টোরেজ ও বায়োইলেকট্রনিকস বিভাগের প্রভাষক ইউনলং ঝাও বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত সমতল, পাতলা মেশের স্তর তৈরি করেছি যাতে কনট্যাক্ট লেন্সের কয়েক স্তরে সেন্সর বসানো হয়। এটি সরাসরি চোখ ও চোখের তরলের সংস্পর্শে থাকে। এটি নমনীয় বলে এটি চোখে পরাও আরামদায়ক। চোখের সংস্পর্শে থাকায় এ থেকে নিখুঁত ফলাফলও পাওয়া সম্ভব।’

তবে কনট্যাক্ট লেন্স থেকে অনেক আলোচনা থাকলেও মূলধারার প্রযুক্তি পণ্য হিসেবে বাজারে আসতে একে অনেক বাধা এখনো পেরোতে হবে। একটি সমস্যা হচ্ছে এটি চালানোর জন্য দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারি। এর ব্যাটারি হতে হবে ছোট কিন্তু এ থেকে প্রয়োজনীয় সবকিছু করার ক্ষমতা থাকতে হবে।

মজো বলছে, তারা চার্জ ছাড়াই যাতে সারাদিন এই স্মার্ট লেন্স পরে থাকা যায় তা নিয়ে পরীক্ষা শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানটির একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘এর ব্যাটারির আয়ু নির্ভর করবে এটি কিভাবে এবং কতবার ব্যবহার করা হবে। এটি অনেকটাই এখনকার স্মার্টফোন বা স্মার্টওয়াচের মতোই।’

এই স্মার্টলেন্স ঘিরে আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে প্রাইভেসি বা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়টি। ২০১৪ সালে গুগলের তৈরি স্মার্টগ্লাস ঘিরেও এই উদ্বেগ ছিল। এ কারণে প্রযুক্তিটি সফলতার মুখ দেখেনি। এই লেন্সে সরাসরি ছবি তোলা বা রেকর্ড করার মতো সুবিধা থাকবে বলে তা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বড় উদ্বেগ তৈরি করতে পারে বলে জানিয়েছেন অ্যাকসেস নাউ নামের একটি ডিজিটাল অধিকার নিয়ে কাজ করার পট্রতিষ্ঠান নীতি বিশ্লেষক ড্যানিয়েল লুসিফার।

এর বাইরে এই লেন্স জনপ্রিয় করতে ব্যবহারকারীর তথ্য সুরক্ষার বিষয়ে নিশ্চয়তা থাকার কথাও বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া এ যন্ত্র স্বাস্থ্যের ওপর কতোটা প্রভাব ফেলবে তা নিশ্চিত হওয়ায় জরুরি।

তবে স্মার্টফোন ঘিরে যেমন নানা প্রশ্ন ও উদ্বেগ থাকলেও মানুষের এখন দরকারি পণ্যে পরিণত হয়েছে তা। স্মার্ট কনট্যাক্ট লেন্সও হয়তো একদিন ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু হবে। এর উদ্যোক্তাদের আশাও তাই। কিন্তু সবকিছুই নির্ভর করছে ব্যবহারকারীর সন্তুষ্টির ওপর। আর তা দেখতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

Exit mobile version