TechJano

সাধারণ থেকে নাহিদ হাসানের অসাধারণ মানুষ হয়ে ওঠার গল্প

হাসিখুশি মুখ তাঁর। বিনয়ী আর কর্মদক্ষতায় পটু। নাম নাহিদ হাসান। সহজেই চিনবেন তাঁকে। আমাদের মতোই সাধারণ একজন। কিন্তু তিনিই আবার অসাধারণ। তাঁর গল্প শুনলে জীবনে আপনিও ইতবিাচক কাজে উৎসাহ পাবেন। টেকজানোর পাঠকদের জন্য তাঁর গল্পটি তুলে আনা হল:

নাম তাঁর নাহিদ হাসান, আগেই বলেছি, বিজকোপ নামের একটি ডিজিটাল মার্কেটিং ফার্ম পরিচালনা করছেন ২০১০ সাল থেকে। শুরুর দিকে শুধু মাত্র দেশের বাহিরের মার্কেটে কাজ করলেও ২০১৭ সাল থেকে লোকাল মার্কেটেও সার্ভিস দিচ্ছে তাঁর প্রতিষ্ঠান। মুলত সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশন, সোশ্যাল মিডীয়া মার্কেটিং, কন্টেন্ট রাইটিং এবং ওয়েব ডিজাইন এবং ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস দিয়ে থাকে বিজস্কোপ। চলুন নাহিদ হাসানের জবানিতেই শুনে আসি তাঁর অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প।

ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে বিজনেসের সাথে কানেক্টেড হব, তাই অন্য কিছু নিয়ে আর তেমন একটা ভাবা হয় নি। আমি জানতাম বড় কোন গোল এচিভ করার জন্য ছোট থেকেই শুরু করতে হয়, তাই ছোট শুরু নিয়ে আমার কখনই খারাপ লাগা কাজ করতো না। আমার এখনো মনে পড়ে আমাদের শুরু বলতে ছিল শুধু মাত্র একটা কম্পিউটার এবং একটি টেবিল।

যদি দ্রুত যেতে চাও, তাহলে একা যাও। যদি অনেক দূর যেতে চাও, তাহলে দলগত ভাবে যাও। এটা একটা আফ্রিকান প্রবাদ এবং এটি আমার পছন্দের প্রবাদ গুলোর মধ্যে একটি। তাই শুরু থেকেই টিম বিল্ড করার দিকে মনযোগ ছিল আমার। একসাথে বড় কিছু করার স্বপ্ন ছিল। আমরা তখন ভার্চুয়াল টিম তৈরি করেছিলাম। যে যার যার বাসা থেকে যার যার কম্পিউটার দিয়েই কাজ করতো। যার ফলে আমাদের আন নেসেসারি সেট আপ জনিত স্ট্রেস সেই মুহুর্তে নিতে হয় নি, যা আমাদের পরবর্তি গ্রোথে অনেক ভুমিকা রেখেছি।

২০১২ সালের দিকে আমরা আসলে ফিসিকাল অফিস সেট আপ করি, আমার এখনো মনে আছে, তখনো আমরা যার যার ল্যাপটপ নিয়ে আসতাম। এর মধ্যে একজন ছিলেন, যিনি প্রতিদিন তার সিপিইউ নিয়ে আসতেন, এবং নিয়ে যেতেন। তাদের এই ডেডিকেশন আসলে আজকের এই অবস্থানে আসতে সহায়তা করেছেন। অনেকেই আমার সাথে এখনো আছেন, আবার অনেকেই নেই। কিন্তু তাদের ডেডিকেশন ছাড়া কোন ভাবেই আজকের এই অবস্থানে আশা যেত না। তাই ইন্টারভিউয়ের শুরুতেই তাদের কে ধন্যবাদ দিতে চাই।

চিন্তার দুনিয়া:
কাইজেন (KAIZEN) একটি জাপানি শব্দ, যাকে বাংলাতে রুপান্তরিত করলে দাঁড়ায়, প্রতিনিয়ত উন্নয়ন। আমাদের প্রফেশনাল কাজ গুলোতে যদি প্রতিনিয়ত ছোট ছোট উন্নতি ঘটানো যায়, তাহলে একটা সময় তা অনেক বিড়াট ভাবে রিটার্ন জেনারেট করতে সাহায্য করে। আবার আমরা যদি আমাদের স্কীল গুলোতে প্রতিদিন ছোট ছোট নতুন কিছু যোগ করতে পারি, তাহলেও অনেক বড় সফলতা জেনারেট করা সম্ভব।

আমি আমার এবং আমার টিমের সব কিছুতে এই ফর্মুলাটাই মেইন্টেইন করার চেষ্টা করি। প্রতিদিন ছোট একটা কিছু এড করা, ডেভেলপ করা, সংসোধন করা। এবং যার ফলাফল আমরা প্রতিনিয়ত পেয়ে যাচ্ছি একের পর এক।

ভিশন:
আর বেশি কর্ম সংস্থান তৈরি করতে ভুমিকা রাখা। একটা প্রফেশনাল ইকো সিস্টেম ডেভেলপ করা। এক সাথে অনেক দূর যাওয়া। গ্লোবাল মার্কেটে যখন কাজ করি, তখন একটা ভাল লাগা কাজ করে, তা হচ্ছে দেশকে রিপ্রেসেন্ট করার সুযগ পাওয়া যায়। তাই সব সময় প্রান পন চেষ্টা করি যাতে দেশের ব্র্যান্ডিং এ ভুমিকা রাখতে পারি।

স্পেসিফিক ভাবে বললে বলতে হয়, একটি প্রতিষ্ঠান, যা আরো কর্ম সংস্থান তৈরি করতে সহায়তা করবে। যা আরো বেশি মানুষের ফাইনাইশিয়াল গ্রোথে ভুমিকা রাখবে। একটি দক্ষ, কর্ম বান্ধব পরিবেশ তৈরি করা, যাতে মানুষ দায়িত্বের মারপ্যাচে পরে অফিসে আসবে না, বরংচ অফিসের টাইমটাকেই উপভোগ করতেই অফিসে আসবে।

মিশন:
আমাদের বর্তমান মিশন হচ্ছে স্কীলটাকে আরো বেশি করে ঝালিয়ে নেয়া। একটি প্রতিষ্ঠানের গ্রোথের পেছনে আসলে অনেক গুলো যায়গা থাকে, এক এক জনের এক এক রকমের রোল থাকে। আমরা সেই যায়গা গুলোতেই আরো বেশি কাজ করছি। যার যার যেই রোল সেই যায়গাটাতে কিভাবে আরো বেশি দক্ষতা অর্জন করা যায় সেখানে কাজ করছি। প্রফেশনাল বিভিন্ন কোর্স এ এনরোল করছি, বই পড়ছি, অডিও বুক শুনছি এবং সেই ভাবে ইমপ্লিমেন্ট করে ফীডব্যাক এনালাইসিস করছি। আমরা জানি, একটি টিম যদি তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারে এবং তা ইমপ্লিমেন্ট করতে পারে, তাহলে তাদের গোল এচিভ করাটা সহজ হয়ে যায়।

আরলি লাইফ:
আমার আরলি লাইফে আসলে বলার তেমন কিছু নেই, পড়ালেখা শেষ করার পর পরই আমি আসলে প্রফেশনাল লাইফে এংগেইজ হয়ে যাই। একটি একাডেমিক কোচিং সেন্টার দিয়েছিলাম, এবং এর সাথে সাথে তখন ওডেস্ক মার্কেটপ্লেসে কাজ করতাম। এক সময় দেখলাম দুইটাই গ্রো হচ্ছে, কিন্তু রিয়েলাইজ করলাম দুই নৌকাতে পা দিয়ে রাখাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাই একটা ছেড়ে দিব। তাই কোচিং সেন্টারটাকেই ছেড়ে দিলাম এবং অনলাইন প্রফেশনের সাথে পুরাপুরি ভাবে এংগেইজ হয়ে গেলাম।

তবে আমার এই সফলতার পেছনে আমার বাবা, মা এবং স্ত্রীর অবদান অনেক। সাধারনত এই সাব কন্টিনেন্টে বাবা মা ঠিক করে দেয়, তাদের ছেলে মেয়েদের কী করা উচিত? কোথায় জব করা উচিত ইত্যাদি। কিন্তু আমার বাবা সব সময় আমাকে সাপোর্ট করেছে। আমার যা ভাল লাগে, তা করতে উৎসাহ দিয়েছে। আমার আজকের এই ক্ষুদ্র সফলতার পিছনে সবটুকু অবদান তাদের এবং তাদের দোয়া ছিল বলেই হয়ত আল্লাহ আমার কাজ টুকু সহজ করে দিয়েছেন। এছাড়াও পুরো ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আমার স্ত্রী আমাকে সহযোগিতা করছেন। পরিবার এবং প্রফেশনাল লাইফের ব্যালান্স করার সব ধরনের সহযোগিতাই আমি ওর কাছ থেকে পেয়ে থাকি।

স্টার্ট আপ:
আমরা যখন ডিজিটাল মার্কেটিং সার্ভিস নিয়ে আমাদের স্টার্টআপটাকে সাজাতে লাগলাম, তখন আসলে আমরা বেশ কিছু সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম।
প্রথমত এই কাজ গুলো সম্পর্কে সাধারন মানুষের তেমন একটা ধারনা ছিল না, তাই তারা আসলে বুঝতেন না আমরা কি করতাম। কেউ কেউ মনে করতেন এগুলো হয়ত পিটিসি টাইপের কিছু। কেননা সেই সময় পিটিসি সাইটের মার্কেটটা রম রমা ছিল। আবার কেউ কেউ মনে করতেন সম্ভবত এগুলো ফেসবুক লাইক বিক্রি টাইপের কিছু।
আবার টেকনিকাল সেক্টরে যারা কাজ করতেন তাদের অনেকের ধারনা ছিল, টেকনিকাল সেক্টরটাই আসল সেক্টর, ডিজিটাল মার্কেটিং টাইপের কাজ গুলো হাইপ, অথবা দক্ষতার দরকার হয় না।
আবার অনেকেই বলতো, এইগুলো ছেড়ে চাকরি কর, এই কাজ থাকবে না বেশিদিন। মজার বেপার হচ্ছে উনি হয়ত জানেনই না আমরা কী কাজ করি 😀

তাই এই সময়টাতে আমাদেরকে নিজেদের স্টার্টয়াপ টাকে একটা ফরমেটে আনার সাথে সাথে এই এক্সটার্নাল আইডেন্টিটি ক্রাইসিস নিয়েও ভাবতে হয়েছে। তবে আমরা তত বেশি স্ট্রেসও নেই নি কেননা আমরা জানতাম, এই ক্রাইসিসটা সাময়িক।

আরো একটা বড় সমস্যা যেটা ছিল তা হচ্ছে অভিজ্ঞতার অভাব। আমার কোন চাকুরী করার অভিজ্ঞতা ছিল না, তাই প্রফেশনাল লাইফ সম্পর্কে আমি অনেকটাই অজ্ঞ ছিলাম বলতে পারেন। অভিজ্ঞতার ঝুলিতে যা ছিল, তা হচ্ছে টিউশন করানো। আর টিম লিডিং এর অভিজ্ঞতা বলতে যা ছিল, তা হচ্ছে ক্রিকেট খেলার ক্যাপ্টেন্সি আর বন্ধু সার্কেলের মধ্যে ইনফ্লুয়েন্সিং পাওয়ার। এই গুলো নিয়েই শুরু করা। ভুল করা, শেখার ক্ষুধা। আমি অনেক রিসার্চ করতাম। নতুন কিছু চেষ্টা করতে ভয় পেতাম না। বরং সবসময় নতুন কিছু ট্রাই করতেই আমার ভাল লাগতো।

দিন যত এগোতে থাকলো, তত দক্ষ হতে থাকলাম, অরগানাইজড হতে থাকলাম। অনেক কিছুই তখন বুঝতে পারি। অনেক ক্লায়েন্ট, ইন্ডাস্ট্রির বড় ভাইয়া এবং আপুদের শেয়ার করা নলেজ, অভিজ্ঞতা থেকে শেখা শুরু করলাম। যা সামনে এগিয়ে যেতে আরো বেশি সাহায্য করেছে। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে অন্যদের সাহায্য করার জন্য বাংলা ব্লগিং শুরু করলাম (GrowWithNahid.com ) যা অনেককেই সাহায্য করছে।

এছাড়াও ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড, সফট এক্সপো, বিজনেস ইনোভেশন সামিট সহ বিভিন্ন ইভেন্টে নিজের নলেজ শেয়ার করছি যাতে আমার অভিজ্ঞতা অন্যদের কাজে লাগে।

স্টার্টআপের বাইরে
স্টার্ট আপের বাইরে আমি আসলে বেশ কিছু প্রতিষ্টানের সাথে কানেক্টেড আছি, তাদের কনসালটেন্সি করছি। যেমন দেশের বৃহত্তর ইকমার্স প্লাটফর্ম রকমারির সাথে কানেক্টেড আছি তাদের এসইও কন্সালটেন্ট হিসেবে। এছাড়াও বেশ কিছু কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল মার্কেটিং সার্ভিস দিচ্ছি।
এছাড়াও গ্রো উইথ নাহিদের ব্যানারে কিছু মেন্টরশীপ সাপোর্ট দিচ্ছি। মুলত ডিজিটাল মার্কেটিং সেক্টরে যারা ক্যারিয়ার তৈরি করতে চাচ্ছে তাদের জন্য ডিজাইন করে তৈরি করা হয়েছে কোর্স গুলো।

টিপস
আসলে টিপস বলতে তেমন কিছু নেই, আবার অনেক কিছু আছে। বিজনেস যেমনই হোক না কেন, এর সাথে কানেক্টেড থাকে মানুষ। মানুষ ইমোশনাল হয়। তাই আমাদেরকে দক্ষতা অর্জন করতে হবে যাতে আমরা তাদের সাইকোলজি বুঝতে পারি। কমিউনিকেট করতে পারি পুরাপুরি। মানুষ কী পছন্দ করে, কী অপছন্দ করে, কোথায় সমস্যা ফেস করে, এই যায়গা গুলো গুরুত্ব পুর্ন। যেমন চিপ ফোন এবং বাজেট ফোন এই দুইটা যায়গাতে একটু খেয়াল করেন, দেখবেন কথা হয়ত একই, কিন্তু ফিলিং দুই রকম। চিপ শব্দটা শুনলেই মাথায় কাজ করে খুবই বাজে টাইপের কিছু একটা। আবার বাজেট শুনলে কাজ করে, কম দামের মধ্যে হয়ত ভাল কিছু।
আমি দেখেছি ছোট ছোট যায়গা গুলো বড় বড় ভুমিকা রাখে, তাই ছোট ছোট যায়গাতে যদি উন্নতি করা যায়, ভাল রেসাল্ট জেনারেট করা যাবে। হোটেলের রিসিপশনের ওয়েলকাম ড্রিঙ্কস খুবই ছোট একটা অংশ, কিন্তু বড় ভুমিকা রাখে।
তাই আপনারাও কাইজেন ফর্মুলা নিয়ে ভাবতে পারেন, প্রতিদিন ছোট একটু উন্নতি, ১ বছর পর দেখবেন আপনি অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছেন।

Exit mobile version