TechJano

৬ উড়ুক্কু গাড়ি

রাস্তায় জ্যামে বসে থাকতে থাকতে কতো কথায় মনে আসে! যদি গাড়ি আকাশে ওড়ানো যেত কতোই না ভালো হত! এ শুধু আর স্বপ্ন বা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি নয়। অনেক দেশেই যানজট এক মহা সমস্যার নাম। যানজটে আটকে থাকতে থাকতে অনেকেরই হয়তো মনে আসে, এ মুহূর্তে যদি উড়াল দেওয়া যেত! মানুষের সে আকাঙ্ক্ষাই বাস্তব রূপ দিতে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উড়ুক্কু গাড়ি বিক্রির ঘোষণা দিয়েছে। চলতে চলতে যানজট আর ট্রাফিক সিগন্যাল পড়লেই এই যান আরোহীকে নিয়ে উড়াল দিতে পারবে। খুব সহজেই পৌঁছে দিতে পারবে গন্তব্যে। চলুন জেনে আসি কয়েকটি উড়ুক্কু গাড়ি সম্পর্কে:

কোরা
মার্কিন প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গুগলের সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ উড়ুক্কু ট্যাক্সি তৈরিতে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। গুগলের পৃষ্ঠপোষকতার কিটি হক নামের একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে উড়ুক্কু ট্যাক্সি। সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডে এ উড়ুক্কু গাড়ি পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হচ্ছে। কিটি হকের তৈরি ওই উড়ুক্কু গাড়ির নাম হবে ‘কোরা’। এ যানের উন্নয়নে আট বছর ধরে কাজ করেছেন গবেষকেরা। ধারণা করা হচ্ছে, নতুন এই উড়ুক্কু যান ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রে বিপ্লব আনবে। কারণ, এ গাড়িগুলো চালকবিহীন। ল্যারি পেজের কোম্পানি কিটি হকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান জেফায়ার এয়ারওয়ার্কসের পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে নিউজিল্যান্ড কর্তৃপক্ষ। এর পাখায় এক ডজন ছোট রোটর রয়েছে। এর ফলে এটি হেলিকপ্টারের মতো খাঁড়াভাবে ওঠানামা করতে পারবে। তবে এর নির্মাতারা বলছেন, কোরাতে হেলিকপ্টারের মতো শব্দ হয় না। অর্থাৎ কম শব্দের এ উড়ুক্কু গাড়ি শহরাঞ্চলে যাত্রী পরিবহনে ব্যবহার করা যাবে। বাড়ির ছাদ বা গাড়ি রাখার জায়গায় এটিকে নামানো যাবে। সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ডে কোরার একটি নমুনা নিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়। এতে যানটির ভেতর তিনটি কম্পিউটার রাখা ছিল, যা এর পথ নির্ধারণ করে। এ ছাড়া এতে দুজন যাত্রী বহন করা হয়। এ যন্ত্রটি নিজ থেকেই চলতে পারে। তবে কোনো বিপদের শঙ্কা থাকলে নিরাপত্তাব্যবস্থা হিসেবে প্যারাস্যুট ব্যবহার করা হয়। এ যানটি আগে ‘জি ডট অ্যারো’ নামে পরিচিত ছিল। এটি ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে। লেজ ও যাত্রীদের জন্য বসার জায়গা মিলিয়ে ১১ মিটার জায়গা আছে। সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার। সর্বোচ্চ তিন হাজার ফুট উঁচুতে উঠতে পারে। জেফায়ার দাবি করেছে, তাদের তৈরি উড়ুক্কু যান চালানো খুব সহজ। এটি যাত্রীদের জন্য সাধারণ অভিজ্ঞতা দেবে। এ যান চালাতে কিছু জানা লাগবে না। এটি পুরোপুরি বৈদ্যুতিক হওয়ায় পরিবেশবান্ধব। রাইড শেয়ারিং সেবা উবারের মতো করে এ উড়ুক্কু যান চালানো হবে। তারা একটি অ্যাপ তৈরি করছে, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারী চাইলে মোবাইল ফোন থেকে এ যান ভাড়া করতে পারবেন। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ এলাকায় এ উড়ুক্কু যান পরিচালিত হবে।

স্কাই ড্রাইভ
স্কাই ড্রাইভ নামে উড়ুক্কু গাড়ি তৈরি করছে টয়োটা। দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই আকাশে উড়তে দেখা যাবে গাড়ি। ২০২০ সাল নাগাদ ছোট গাড়ির আকারের উড়ুক্কু যান বাজারে আনার লক্ষ্যে টয়োটা বিনিয়োগ শুরু করেছে। কার্টিভেটর রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট নামের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানে ৩ লাখ ৮৬ হাজার মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে টয়োটা। ওই প্রতিষ্ঠানটি ‘স্কাই ড্রাইভ’ নামের একটি উড়ুক্কু গাড়ি তৈরিতে কাজ করছে। সম্প্রতি ব্যাটারি ও অ্যালুমিনিয়াম কাঠামোর একটি উড়ুক্কু গাড়ির পরীক্ষা চালিয়েছেন উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানটির প্রকৌশলীরা। পরীক্ষা চলার সময় ওই গাড়িটি প্রচুর ধুলা উড়িয়েছে এবং শব্দ করেছে। এ ছাড়া কয়েক সেকেন্ডে কাঁপতে কাঁপতে মানুষ সমান উচ্চতায় উঠে আবার পড়ে গেছে। কার্টিভেটরের উড়ুক্কু গাড়ি প্রকল্পে নেতৃত্ব দেওয়া সুবাসা নাকামুরা বলেন, ‘চলচ্চিত্রের কোনো দৃশ্যের মতোই রাস্তায় চলার পাশাপাশি আকাশে ওড়ার সুবিধাযুক্ত গাড়ি তৈরির লক্ষ্য কার্টিভেটরের। আমি ব্যক্তিগতভাবে গাড়ি ও উড়োজাহাজ পছন্দ করি। অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল ব্যক্তিগত গাড়িতে উড়ে বিভিন্ন স্থানে যাব। টয়োটার কাছ থেকে পাওয়া বিনিয়োগ নিয়ে আরও উন্নত নকশার উড়ুক্কু গাড়ি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে কার্টিভেটরের। ২০১৯ সাল নাগাদ এ গাড়িতে মানুষ চড়তে পারবে।

ফ্লায়ার
কিটি হক উড়ুক্কু মোটরসাইকেলসদৃশ একটি যান তৈরি করছে। নাম দেওয়া হয়েছে ফ্লায়ার। সিলিকন ভ্যালির উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান কিটি হকের পক্ষ থেকে একটি ভিডিও উন্মুক্ত করা হয়। কিটি হক কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, ব্যক্তিগত উড়ুক্কু গাড়ির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়া তাদের লক্ষ্য। যখন সবার এ ধরনের গাড়ি চালানোর সুযোগ আসবে, তখন অমিত সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে। কিটি হকের তৈরি উড়ুক্কু গাড়ির প্রোটোটাইপটিতে মাত্র একটি সিট রয়েছে। এতে দুটি পন্টুন ও মাকড়সার জালের মতো প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। পানির ওপরে ওই গাড়িটি উড়ে বেড়াতে পারে। যানটিতে আটটি পাখা আছে। এটি হেলিকপ্টারের মতো মাটি থেকে উঠতে পারে। এর ওজন ১০০ কেজির মতো। ঘণ্টায় ২৫ মাইল গতিতে ১৫ ফুট ওপর দিয়ে এটি উড়তে পারে। কিটি হক বলছে, ফ্লায়ার নতুন ইলেকট্রিক যান। এটি নিরাপদ, পরীক্ষিত। যুক্তরাষ্ট্রের হালকা উড়ুক্কু যানের নিয়ম মেনে ঘনবসতিহীন এলাকায় এটি চালানো বৈধ। এতে চালকের জন্য কোনো লাইসেন্স লাগে না। মাত্র দুই ঘণ্টার প্রশিক্ষণ যথেষ্ট।

পাল-ভি লিবার্টি
ডাচ প্রতিষ্ঠান পাল ভি আনছে উড়ুক্কু গাড়ি পাল-ভি লিবার্টি। লাল রঙের এই গাড়িতে বসা যাবে দুজন। তবে এখনই এটি বাজারে পাওয়া যাবেনা। কেননা এর চূড়ান্ত পরীক্ষামূলক চালনা এখনও বাকি আছে। আশা করা যাচ্ছে, পাল-ভি লিবার্টি ২০১৯ নাগাদ বাজারে পাওয়া যাবে। ডাচ কোম্পানি তাদের প্রথম উড়ন্ত গাড়ি বাজারে ছেড়েছে। জেনেভা মোটর শোতে প্যাল-ভি নামের এই কোম্পনি তাদের তৈরি এই তিন চাকার গাড়ি-কাম-হেলিকপ্টার প্রদর্শন করেছে। এর মাথার ওপর হেলিকপ্টারের মতোই রোটর বা পাখা রয়েছে, যা ভাঁজ করে রাখা যায়। পেছন দিকে রয়েছে আরও একটি প্রপেলার। মাটির ওপর গাড়ি হিসেবে চলার সময় এই যানটির সর্বোচ্চ গতি হবে ঘন্টায় ৯৯ মাইল। আর ওড়ার সময় সর্বোচ্চ গতি হবে ঘন্টায় ১১২ মাইল। প্যাল ভি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী রবার্ট ডিঙ্গেমান্স বলেন, লিবার্টিকে নিয়ে আপনি আপনার গ্যারেজ থেকে যাত্রা শুরু করতে পারবেন এবং সোজা আপনি যেখানে যেতে চান সেখানে গিয়ে নামতে পারবেন।

পোরশে
ফক্সভাগেন স্পোর্টস কার নির্মাতা এবার আগ্রহ দেখাচ্ছে উড়ুক্কু গাড়ি তৈরিতে। ফ্লাইং ট্যাক্সি ও রাইড শেয়ারিং সেবার সম্ভাবনাময় বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেই এ খাতে নামার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বিপণন কর্মকর্তা ডেটলেভ ভন প্ল্যাটেন। জার্মান ম্যাগাজিন অটোমোবিলওশকে এক সাক্ষাৎকারে এ কথা জানিয়েছেন প্ল্যাটেন। প্ল্যাটেন বলেন, ‘এটা সত্যিই দারুণ হবে! আমি যদি জুফেনহাউসেন (পোরশে প্ল্যান্ট) থেকে স্টুডগার্ট এয়ারপোর্টে যাই, আমার অন্তত আধা ঘণ্টা সময় লাগে। যদি আমি সৌভাগ্যবান হই। উড়ে গেলে মাত্র সাড়ে তিন মিনিট লাগতে পারে।’ রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, উড়ুক্কু গাড়ির নকশার জন্য অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে পারে পোরশে। প্রচলিত গাড়ি থেকে শুরু করে স্বচালিত গাড়িকে অ্যাপের মাধ্যমে শেয়ার ব্যবস্থার আওতায় আনতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, পোরশের পরিকল্পনা অনুযায়ী উড়ুক্কু গাড়িটির কিছু নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হবে যাত্রীকে। কিন্তু এর জন্য কোনো পাইলট লাইসেন্স লাগবে না, কারণ এটির অনেক নিয়ন্ত্রণ হবে স্বয়ংক্রিয়।

ভাহানা
যাত্রাপথের সমস্যার সমাধানে নিজেদের ডিজাইন করা উড়ুক্কু গাড়ির পরীক্ষা চালিয়েছে ইউরোপীয় প্লেন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ‘এয়ারবাস’। মোট দু’বার ৫৩ সেকেন্ডের জন্য প্রোটোটাইপ এয়ারক্রাফট ভাহানাকে ওড়াতে সক্ষম হয় নির্মাতা এ প্রতিষ্ঠানটি। পরীক্ষামূলক এ উড়ুক্কু গাড়িটির উড্ডয়ন করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের অরেগনের পেন্ডলটন আনম্যানড অ্যারিয়াল সিস্টেম রেঞ্জে। উড়ুক্কু গাড়িউড়ুক্কু গাড়িটি যেন অল্প জায়গা নিয়ে খাঁড়াভাবে ল্যান্ড করতে পারে সেভাবে করে তৈরি করা। এটি ২০.৩ ফুট দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ ১৮.৭ ফুট। এয়ারক্রাফটটির বডি হেলিকপ্টারের মতো। বডির দু’পাশে দুই সেট পাখা আছে। মোটরসাইকেল হেলমেটের মতো দেখতে একটি কক্ষে গাড়িটি শুধু একজন যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। প্রযুক্তি এবং প্রোটোটাইপের পরিবর্তন করে ভাহানাকে আরও শক্তিশালী ও ব্যবহার উপযোগী করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। যাতে জনবহুল শহরের বহুতল ভবনের ছাদ থেকে ও যাত্রী তুলতে পারে তাদের উড়ুক্কু গাড়ি। ২০২০ সালের মধ্যেই এটি বাজারজাতকরণ করতে পারবেন বলে জানান ভাহানা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ২০১৬ সালে এয়ারবাস কর্তৃপক্ষ ‘আরবান এয়ার মোবিলিটি’ নামে আলাদা একটি বিভাগ চালু করে। এই বিভাগ থেকে হেলিকপ্টারের মতো যাত্রীবাহী উড়ুক্কু গাড়ি নির্মাণের ধারণা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।

Exit mobile version