বর্তমানে দৈনন্দিন জীবনে মোবাইল ফোন আমাদের নিত্য সঙ্গী। সারাদিনের সঙ্গী মোবাইল? রাতের অন্ধকারেও চলে মোবাইলে খুটখাট? কিন্তু এই আলো-আঁধারিতে বারোটা বাজছে আপনার চোখের? যুক্তরাজ্যের চক্ষু বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে জানিয়েছেন, মুঠোফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারে দৃষ্টি বৈকল্য সৃষ্টি হতে পারে। এতে করে মায়োপিয়া বা ক্ষীণ দৃষ্টির সমস্যা দেখা দিতে পারে। স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা সাধারণত চোখ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার দূরত্ব রেখে তা ব্যবহার করেন। তবে, অনেকের ক্ষেত্রে এ দূরত্ব মাত্র ১৮ সেন্টিমিটার।
পরিসংখ্যান বলছে ২৫-৩৫ বছর বয়সিদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় বালিশের পাশে মোবাইল ফোন রাখেন। আর ঘুম যতক্ষণ না আসছে, ততক্ষণ হোয়াটস অ্যাপ অথবা ফেসবুকে চলতে থাকে ঘাটাঘাটি। আপনিও কি এমনটা করেন? যদি করেন তাহলে আজ থেকেই বন্ধ করুন এই অভ্যাস। ‘রাতে মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে কী কী ক্ষতি হয় তা আজকের এই ফিচারটি জেনে নিন।
আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি’র সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, স্মার্টফোনের নীল আলোর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব মারাত্মক। মেলাটোনিন হরমোন উত্পাদনে বাধা দেয় এই আলো। এই হরমোনের প্রভাবে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। ফলে ঘুমের দফারফা। মস্তিষ্ক তখন ভাবতে শুরু করে, সকাল হয়ে গেছে। এছাড়া, রাতের অন্ধকারে দীর্ঘসময় স্মার্টফোনের ব্যবহারের ফলে রেটিনার ওপর প্রভাব পড়তে শুরু করে। রেটিনা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেলে পরিনাম অন্ধত্ব।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় চোখের পলক কম পড়ে। স্বাভাবিকের তুলনায় স্মার্টফোন চোখের খুব কাছে এনে ব্যবহার করা হয়। এর থেকে নির্গত আলো শুধু ক্ষতিকরই নয়, বিষাক্তও। অন্ধকারে স্মার্টফোনের নীল আলো বেশিমাত্রায় চোখে ঢুকলে ঘাড়ে ব্যথা, মাথাব্যথা বা মাইগ্রেনের মতো সমস্যা বাড়ে। এ ছাড়া মুঠোফোনে দীর্ঘসময় মেসেজ টাইপ করতে থাকলে আঙুলের জয়েন্টগুলোতে ব্যথা হতে পারে। আর্থ্রারাইটিসের মতো রোগ হতে পারে।
অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারে নিজেদের আরো যে ক্ষতি করছি আমরা, তা জেনে নিই-
অনিদ্রার সমস্যা দেখা দেয় মোবাইল ফোনের আলো নানা ভাবে শরীরে মেলাটনিন হরমোনের ক্ষরণ কমিয়ে দেয়। ফলে সহজে ঘুম আসতে চায় না। কারণ আমাদের ঘুম কতটা ভাল হবে, তা অনেকাংশেই নির্ভর করে মেলাটোনিন হরমোনের ক্ষরণের উপর। তাই শুতে যাওয়ার আগে ভুলেও হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুকে ঘুর ঘুর করবেন না যেন!
মস্তিষ্কের মারাত্মক ক্ষতি হয় মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল ফোন ঘাঁটলে ঘুম ঠিক মতো হয় না। আর ঘুম যদি ঠিক মতো না হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই মস্তিষ্কের কাজ করার ক্ষমতা কমতে শুরু করে। ফলে স্মৃতিশক্তি যেমন লোপ পায়, তেমনি মনযোগ এবং বুদ্ধির ঘাটতিও দেখা দেয়। সেই সঙ্গে ব্রেণে রক্তের প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে নানাবিধ ব্রেন ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
রেটিনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় অন্ধকারে মোবাইল ফোন ব্য়বহার করলে তার নীল আলো রেটিনার কার্মক্ষমতা কমাতে শুরু করে। দীর্ঘ দিন ধরে যদি এমনটা চলতে থাকে তাহলে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়। তাই যদি কম বয়সে অন্ধ হতে না চান, তাহলে আজ থেকেই ফোনটা নিজের থেকে দূরে রেখে শুতে যাওয়ার অভ্যাস করুন।
ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে মোবাইলের নীল আলোর কারণে শুধু মেলাটোনিন হরমোন নয়, সেই সঙ্গে আরও সব হরমোন ক্ষরণে বাধা আসে। ফলে শরীরে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের ঘাটতি দেখা দেয়। যা ক্যান্সার রোগে, বিশেষ করে ব্রেস্ট এবং প্রস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ায়।
কানে কম শোনা মুঠোফোন ব্যবহারের ফলে কানের সমস্যা তৈরির বিষয়টি অভ্যাসের ওপর নির্ভর করে। হেডফোন ব্যবহার করে উচ্চশব্দে গান শুনলে অন্তকর্ণের কোষগুলোর ওপর প্রভাব পড়ে এবং মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক আচরণ করে। একসময় বধির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
ব্যাকটেরিয়াও থাকে মুঠোফোনে মার্কিন গবেষকেরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, টয়লেট সিটের তুলনায় ১০ গুণ বেশি ব্যাকটেরিয়া থাকে মুঠোফোনে। মুঠোফোন নিয়মিত পরিষ্কার না করায় এটি জীবাণুর অভয়ারণ্য হয়ে ওঠে। গবেষকেরা বলেন, মুঠোফোনে ব্যাকটেরিয়াগুলো ব্যবহারকারীর জন্য খুব বেশি ক্ষতিকারক না হলেও এটি থেকে সংক্রমণ বা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। নিয়মিত মুঠোফোন পরিষ্কার করলে এ সমস্যা থেকে দূরে থাকা যায়।
মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময় তার শরীর থেকে ‘নন-আয়োনাইজিং রেডিয়েশন’ নামক এক তরঙ্গ বেরতে থাকে। এই তরঙ্গ এতটাই শক্তিশালী হয় যে অ্যাটোম মলিকিউলকেও এক স্থান থেকে অরেক স্থানে নারাতে সক্ষম হয়। একবার ভাবুন এতটা শক্তিশালী এনার্জি যদি আমাদের শরীরের উপর আঘাত করতে শুরু করে তাহলে কতটাই না ক্ষতি হয়!গবেষকেদের দাবি, মুঠোফোন থেকে নির্গত ক্ষতিকর তরঙ্গ শুক্রাণুর ওপর প্রভাব ফেলে এবং শুক্রাণুর ঘনত্ব কমিয়ে দিতে পারে। তবে মোবাইল ফোনের শরীর থেকেই যে কেবল এমন রেডিয়েশন সৃষ্টি এমন নয়, ল্যাপটপ এবং ওয়াইফাই ডিভাইস থেকেও সম প্রকৃতির তরঙ্গ বের হতে থাকে। সেই কারণেই তো গর্ভাবস্থায় এইসব ডিভাইস থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা।
তাহলে আপনিই সিদ্ধান্ত নিন, সুস্থ থাকতে চান নাকি মোবাইলকেই জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ভাবতে চান? না কি প্রতিকার পেতে চান? মোবাইলের নীল আলোর কারণে যাতে চোখের কোনও ক্ষতি না হয়, তা সুনিশ্চিত করতে নিচের নিয়মগুলো মানতে পারেন-
বার বার চোখ খুলুন আর বন্ধ করুন
একাধিক স্টাডিতে দেখা গেছে বারে বারে চোখ পিটপিট করলে চোখের ভেতরে জলের মাত্রা কমে যাওয়ার আশঙ্কা হ্রাস পায়। আর চোখ আদ্র থাকলে নীল আলোর কারণে চোখের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা যে কমে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই! তাই অনেকক্ষণ মোবাইল ফোন যদি ব্যবহার করতে হয়, তাহলে চোখকে বাঁচাতে বারে বারে চোখ পিটপিট করতে ভুলবেন না যেন!
মোবাইলের ব্রাইটনেস
ব্যাটারি লাইফকে বাড়াতে ভুলেও মোবাইল স্ক্রিনের ব্রাইটনেস একেবারে কমিয়ে ফলবেন না যেন! কারণ অতিরিক্ত ব্রাইটনেস যেমন চোখের পক্ষে ভাল নয়, তেমনি কম আলোও মারাত্মকভাবে রেটিনার ক্ষতি করে থাকে। তাহলে এখন প্রশ্ন হল ব্রাইটনেস কতটা থাকা চোখের পক্ষে ভাল? এক্ষেত্রে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, তা হল যেখানে রয়েছেন, সেখানকার আলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মোবাইল স্ক্রিনের ব্রাইটনেস ঠিক করে নেবেন, তাহলেই দেখবেন কেল্লা ফতে!
মোবাইল স্ক্রিন পরিষ্কার রাখবেন
মোবাইল স্ক্রিনের উপর জমতে থাকা ধুলো পরিষ্কার করে না নিলে স্ক্রিন দেখার সময় চোখের উপর মারাত্মক চাপ পরে। ফলে রেটিনার ক্ষতি হয়ে যেতে সময় লাগে না। এই কারণে তো কিছু সময় অন্তর অন্তর একটা ড্রাই কাপড় দিয়ে স্ক্রিনটা পরিষ্কার করে নেওয়া উচিত।
গবেষকেরা দীর্ঘক্ষণ ধরে স্মার্টফোনে চোখ না রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন। দৈনিক কিছু সময় মোবাইল ফোন থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন তাঁরা। চিকিৎসকদের পরামর্শ, রাতের অন্ধকারে স্মার্টফোন ব্যবহার ছাড়তেই হবে। খুব প্রয়োজনে আলো জ্বেলে মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।স্মার্টফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে বয়স বিবেচনার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের গবেষকেরা।