TechJano

ই-অরেঞ্জ অনলাইন শপ মালিকানা পরিবর্তন করে লাপাত্তা

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ অনলাইন শপ।  প্রায় ২০০ কোটি টাকার অর্ডার নেওয়ার পর এখন লাপাত্তা। এর মধ্যে মালিকানাও পরিবর্তন করেছে ই-অরেঞ্জ। সে মালিকও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি আদেশ অনুযায়ী লকডাউন শিথিল হওয়ায় ১১ আগস্ট থেকে সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় খোলার অনুমতি থাকলেও ই-অরেঞ্জের গুলশান কার্যালয়ের সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন গ্রাহকরা।

সূত্রে জানা যায়, গত ১১ জুলাই মালিকানা পরিবর্তন করা হয়েছে। বর্তমান মালিক বিথী আক্তার। কিন্তু বর্তমান ও সাবেক মালিক সোনিয়া মেহজাবিন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে শোনা যাচ্ছে সাবেক মালিক সোনিয়া মেহজাবিন মালিকানা পরিবর্তন করে বিদেশে চলে গেছেন। তবে গ্রাহকরা এর কিছুই জানেনা। জানা যায়, ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত অরেঞ্জ বাংলাদেশ লিমিটেডের একটি অন্যতম ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ অনলাইন শপ। এটি ২০১৮ সাল থেকে ঢাকা শহরে অনলাইনে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যসেবা দিয়ে আসছে। চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষ থেকে বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকা সিটিতে করোনা পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে এবং এর কয়েকদিন পরই সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে, তখন অনেক প্রতিষ্ঠানই তাদের অপারেশন বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মালিক পক্ষের কাউকে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে গত বৃহস্পতিবার সকালে প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পেজে একটি পোস্টের মাধ্যমে অফিস বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। এর আগে, গতকাল ই-অরেঞ্জের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৫০ জন গ্রাহক বিক্ষোভে অংশ নেন। পরবর্তীতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ।

সূত্রে জানা গেছে, ই-কমার্স ব্যবসার আড়ালে ইওরেঞ্জ অনলাইন শপ মূলত এমএলএম কার্যক্রম পরিচালনা করত। দেশে এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসা একেবারেই নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রতারণার ধরন পাল্টে ই-কমার্স মাধ্যমে এমএলএম ব্যবসা করত ই-অরেঞ্জ অনলাইন শপ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ই-অরেঞ্জ অনলাইন শপ গুলশানে অফিস নিয়ে রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করছে ই-অরেঞ্জ অনলাইন শপ। তাদের প্রতারণার ফাঁদে পা দিলেই ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন প্যাকেজের পণ্য। এসব প্যাকেজে আছে গৃহস্থালি পণ্য, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য, হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য, প্রসাধন ও টয়লেট্রিজ পণ্য এবং হারবালসহ নানা ধরনের পণ্য। দেশে প্রচলিত ব্যবসা-বাণিজ্য, রীতিনীতির সঙ্গেও কোনো মিল নেই। সরকারের অনুমোদন ছাড়াই কার্যক্রম পরিচালনা করে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এরা। অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো সদস্য বানাচ্ছে সহজ-সরল তরুণ-তরুণীদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর মধ্যেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি তাদের মালিকানা পরিবর্তন করছে। ই-অরেঞ্জের ফেসবুক পেজে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বীথি আক্তার নামে একজনকে কোম্পানিটির নতুন মালিক ঘোষণা করা হয়। অভিযোগ আছে, প্রতিষ্ঠানটির আগের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন দেশ ছেড়েছেন। ই-অরেঞ্জের এক প্রাক্তন কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করে আন্দোলনকারী গ্রাহকরা জানতে পারেন, গত মাস থেকে বেতন আটকে থাকায় প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীরা কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। ওই কর্মচারী দাবি করেন, তার চাকরি আছে কি না কিংবা প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা বদলেছে কি না, সে ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না।

ই-অরেঞ্জের দাবি, তারা ১৬ আগস্ট ডেলিভারি তালিকা প্রকাশের লক্ষ্যে ১১ আগস্ট অফিসের কার্যক্রম শুরু করলেও কয়েকজন রিসেলার অফিসে এসে বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধামকি ও কর্মকর্তাদের রুমে বন্দি করে রাখাসহ গায়ে হাত তোলার চেষ্টা করে। ফেসবুক পোস্টে তারা জানায়, রিসেলারদের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও তারা অফিস ত্যাগ করেননি। পরে, গুলশান থানাপুলিশের উপস্থিতিতে রিসেলারগণ অফিস ত্যাগ করেন। তবে, অফিস বন্ধ থাকলেও ১৬ তারিখ ডেলিভারির তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ডেলিভারির তারিখও অপরিবর্তিত রাখা হবে।

সাগর নামের এক গ্রাহক জানান, আমি গত এপ্রিল মাসে ই-অরেঞ্জে তিনটি বাইক অর্ডার করি, তাদের নিয়মঅনুযায়ী ৩৫ দিনের ভেতরে আমার বাইক পাওয়ার কথা থাকলে ও ১০০ দিনের বেশি হয়ে গেলেও আমি আমার পণ্য পাইনি। এখন তাদের অফিসে এসে কোনো সঠিক তথ্য পাচ্ছি না। এছাড়া পণ্যটি কবে পাবো সে ব্যাপারেও তারা কোন কিছু বলছে না। শুনেছি তাদের মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু বর্তমানে তাদের মালিককে আমরা এই বিষয়ে কিছুই জানি না, এমনকি তাদের কর্মচারীরা ও জানে না মালিক কে। আমি আর দুই দিন অপেক্ষা করবো এরপর পণ্য না পেলে মামলা করবো তাদের বিরুদ্ধে।

হাবিবুর রহমান নামে একজন জানান তিনি ৭টি বাইক অর্ডার করেছেন। গত জুলাই মাসে অর্ডার ডেলিভারি দেওয়ার কথা থাকলেও তারা তা করেনি। তারা লকডাউন এই সেই বলে যাচ্ছে। এখন তাদের অফিসে এসে তাদের কাছ থেকে কোন সদুত্তরপাচ্ছি না। তিনি আরো বলেন আমরা জানি ই-অরেঞ্জ ই-ক্যাবের নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান সেই ভরসায় এতগুলো বাইক অর্ডার করেছি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য কিন্তু বর্তমানে তাদের কার্যক্রম দেখে বুঝতে পারছি না কার কাছে যাবো। তিনি আরো জানান তারা তাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে মাশরাফিকে রেখেছে দেখে আমরা ভরসা পেয়ে এত এত পণ্য অর্ডার করেছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমাদের ফাঁদে ফেলতে তারা এই কাজ করেছে।

ইশতিয়াক নামে আরো এক গ্রাহক জানান, আমি দুইটি বাইক অর্ডার করেছিলাম এপ্রিল মাসে কিন্তু তারা বর্তমানে আমাদের নানা অজুহাত দিয়ে যাচ্ছে। তারা সর্বশেষ ১৭ আগস্ট পর্যন্ত সময় নিয়েছে এর পর আমি আমার পণ্য না পেলে আমি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করবো। এছাড়া বিক্ষোভে আসা গ্রাহক তানভীর কালাম বলেন, ই-কমার্স কোম্পানিটির গত এপ্রিলের অর্ডার ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল মে মাসে। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়ে ওদের কর্তৃপক্ষ আমাকে ঘোরাতে শুরু করে, সেইসাথে বিলম্বের জন্য নানা অজুহাত দিতে থাকে। বিক্ষোভে আসা আরেক গ্রাহক মো. আতাউল্লাহ আরজু বলেন, কোম্পানিটি প্রতিশ্রুতিমাফিক ১৭ আগস্টের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে না পারলে- ওদের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা ভাবছি।

এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ই-কমার্স মার্চেন্টদের ব্যাংক হিসাবের বিবরণ চাওয়ার পর বেশ কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক ও একটি মোবাইল ব্যাংকিং পরিষেবা ই-অরেঞ্জসহ ১০টি ই-কমার্স সাইটের লেনদেনের জন্য তাদের কার্ডের ব্যবহার সাময়িককভাবে স্থগিত করেছে। এ ব্যাপারে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) জিএম জাহাঙ্গীর আলম শোভন বলেন, ই-অরেঞ্জ সাবেক ও বর্তমান উভয় মালিককে আমরা নোটিস করেছি। তাদের মলিকানা পরিবর্তনের ব্যাপারে আমরা কিছুই জানতাম না। অনেক পরে জানতে পেরেছি। এছাড়া যতোগুলো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি সবগুলোর প্রতিষ্ঠানে আমরা নোটিস করেছি। তাদের জবারের পর আমাদের সিন্ধান্ত নিবো। ই-অরেঞ্জ, আলিশা, কিউকমসহ মোট ১৬টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমাদের কাছে অভিযোগ আসছে। এগুলোর সবাইকে নোটিস করেছি।

Exit mobile version