TechJano

ই-কমার্স খাতের বর্তমানে কি হাল?

‘বিজনেস টু ই-বিজনেস’ প্রতিপাদ্য ধরে ৭ এপ্রিল থেকে ১৩ এপ্রিল পালিত হল ই-কমাস সপ্তাহ। এর আগে ৭ এপ্রিল পালন করা হয় ই-কমাস দিবস। ই-কমার্স খাতের বিকাশ, প্রসার ও প্রচারণার লক্ষ্যে এ উদ্যোগ নেয় ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ই-ক্যাব। ই-ক্যাবের সদস্য সংখ্য ৭২১। সারাদেশের ই-কমাস খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠন দিবসটি পালন করে। এ আয়োজন উপলক্ষ্যে সংগঠনটির ৫০টির বেশি সদস্য প্রতিষ্ঠান সপ্তাহজুড়ে বিভিন্ন পণ্যে ছাড়, ডিসকাউন্ট ও অফার চালু রাখে।

ই-কমাস সপ্তাহ পালন উপলক্ষে ব্যাপক আয়োজন করে ই-ক্যাব। ৫ এপ্রিল আয়োজন জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজন করে সংবাদ সম্মেলন। এ ছাড়া ৭ এপ্রিল আগারগাঁওয়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের মিলনায়তনে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করে।

ই-ক্যাব সভাপতি শমী কায়সার বলেন, ‘বিজনেস টু ই-বিজনেস’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আমরা এবার ই-কমার্স সপ্তাহ ও দিবস পালন করা হয়। দেশে গত চার বছরের এই খাতে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। ভবিষ্যতে দেশের বিদ্যমান ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা বড় অংশ ই-বাণিজ্যের আওতায় চলে আসবে। সামনের দিনগুলোয় ই-কমার্স খাতের ব্যাপ্তি তৈরি পোশাক খাতকেও ছাড়িয়ে যাবে।’

ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, দেশের ই-কমার্স খাতের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে আমরা সরকারের সঙ্গে নিরলস কাজ করে যাচ্ছি। সারাদেশে ই-কমার্স বান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে আমাদের এ আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ই-ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছর ধরেই ঢাকা ও এর বাইরে ই কমাস ব্যবহারকারী বেড়েছে। ঢাকার বাইরে ই-কমার্স এর ক্রেতা সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অ্যাসোসিয়েশন হিসেবে ইক্যাব আরো বড় হয়েছে। এ বছর বাংলাদেশে ই-কমার্স এর আরও প্রসার ঘটবে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ই-কমার্সের প্রসার আরও বাড়বে। ই-ক্যাব মূলত অ্যাসোসিয়েশন সদস্যদের স্বার্থ সমন্বয়, বাংলাদেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করায় সরকারকে উৎসাহিত করা, দেশ-বিদেশে ই-কমার্সভিত্তিক বিভিন্ন প্রচারণা ও প্রসারমূলক কাজ করে।

কয়েকজন্য ই-কমাস উদ্যোক্তা জানান, ই-কমাস খাত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ই কমাস সপ্তাহর মত আয়োজন এ খাতকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের কাঙ্খিত উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে প্রতি বছরের মতো পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ‘ই-কমার্স দিবস’ এবং ‘ই-কমার্স সপ্তাহ’ উদযাপন করা হয় । কারণ, এ সময় ই-কমার্স খাতে মানুষ বেশি কেনাকাটা করেন।

ই কমার্স সপ্তাহ পালন উপলক্ষে খাতের বিকাশ ও প্রসারে দেশের প্রায় ৭০ লাখ নিবন্ধিত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে ডিজিটাল ব্যবসায় রূপান্তর এখন সময়ের দাবি বলে উল্লেখ করেন ই ক্যাব সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘শুরু থেকেই ই-ক্যাব দেশের ই-কমার্স খাতের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত ও ত্বরান্বিতকরণে সরকারের সাথে একযোগে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশন সদস্যদের সার্বজনীন স্বার্থ সমন্বয় ও অগ্রগায়ন এবং বাংলাদেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে সরকার, ই-কমার্স উদ্যোক্তা ও সংশ্লিষ্ট সবার সাথে একযোগে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’

ই-ক্যাব হলো দেশের একমাত্র বেসরকারি ই-কমার্সবিষয়ক অ্যাসোসিয়েশন, যা ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন হিসেবে তাদের স্বার্থ সুরক্ষায় সরকারের পরামর্শকের ভূমিকা পালন করে থাকে। ২০১৫ সালে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) যাত্রা শুরু হয়েছিল।

ই-ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী দেশে ই-কমার্স খাতের বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ ১০০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। দেশে ই-কমার্স খাতে ওয়েবসাইটভিত্তিক ১ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা এবং ওপর এফ কমাস বা ফেসবুকে ৫ হাজার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উদ্যোক্তা রয়েছেন। এছাড়া খাতে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রতি বছর খাতটিতে ২০ শতাংশ গ্রোফ রেট থাকায় আগামী কয়েক বছরে আরও অনেক কমসংস্থান সৃষ্টি হবে।

বাংলাদেশে ই-কমার্স খাতের বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণকারী কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুন ২০১৬ নাগাদ বাংলাদেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬৩.২৯ মিলিয়ন। বিটিআরসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট ১৩১.৩৭ মিলিয়ন মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ যেখানে ভারত এবং পাকিস্তানে এই পরিসংখ্যান যথাক্রমে ৭৮% এবং ৬৬%।

দেশে ই-কমার্স কর্মকান্ড দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি মাসে নতুন নতুন সাইট এর আগমন ঘটছে। যদিও এ খাতের বর্তমান অবস্থা এবং ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রীর সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে খুব একটা গবেষণা পরিচালিত হয়নি; তবে কেইমু ডটকমের কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশের ই-কমার্স ট্রেন্ড শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ই-কমার্স খাত ধীরে ধীরে উন্নতি করছে। ই-কমার্স খাতে লেনদেন প্রতিবছর কমপক্ষে ১০% বৃদ্ধি পাবে।

ই-কমার্স এর ক্রেতারা মূলতঃ শহর-কেন্দ্রিক; তন্মধ্যে ৮০% ক্রেতার ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের। এদের মধ্যে ৩৫% ঢাকার, ৩৯% চট্টগ্রামের এবং ১৫% গাজীপুরের অধিবাসী। অন্য দুটি শহর হলো ঢাকার অদূরে নারায়নগঞ্জ এবং অন্যটি আরেকটি মেট্রোপলিটান শহর সিলেট। ৭৫% ই-কমার্স ব্যবহারকারীর বয়স ১৮-৩৪ এর মধ্যে।

গুগল ব্যবহারকারীদের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, বেশীরভাগ ব্যবহারকারীই বয়সে তরুন। ২০১৩-২০১৫ সালের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় মোবাইল ফোন এবং ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর অনুসন্ধান সবচেয়ে বেশী বলে পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া, ফ্যাশন আইটেম যেমন পোষাক, ঘড়ি ইত্যাদি বেশী অনুসন্ধান করা হয়। তথ্য মতে, মোবাইল এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রচলিত থাকলেও ৯৫% ভোক্তা এখনও ক্যাশ অন ডেলিভারী পদ্ধতিকে বেশী পছন্দ করে।

সমস্যা ও ঝুঁকি

কথা হচ্ছিল, অনলাইনে তথ্যপ্রযুক্তি বিক্রি করেন এমন প্রতিষ্ঠানের কমকর্তার সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করে তিনি বললেন, এ খাতের বড় সমস্যা হচ্ছে আস্থার অভাব। এ ছাড়া পণ্য পৌঁছে দেওয়ার সঙ্কট। একজন ৫০ হাজার টাকার দামের ল্যাপটপ অনলাইনে ফরমাশ দেবে এরপর সেই টাকা অগ্রিম পরিশোধ করার ক্ষেত্রে নানা চিন্তা মাথায় আসবে। এ ছাড়া অনেকে ফান্ডিং এর অভাবে ঝরে পড়েন। কেউ কেউ কেউ পণ্যের মান ঠিক রাখেন না। ফলে ক্রেতারা অনলাইনে কেনাকাটা নিয়ে আস্থা রাখতে পারেন না। অনেকেই ধৈয্য না রেখে দ্রুত লাভ করতে গিয়ে ক্রেতা ঠকান। পণ্যের মান যাচাই বাছাই করা হয়না। এ ছাড়া এ খাতের এখনো নীতিমালা নেই।

বাংলাদেশে যারা ই-কমার্স উদ্যোক্তা হতে চান, তাদের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অনেকে মনে করেন, ই-কমার্স মানে শুধু একটি অনলাইন শপিং সাইট বানানো। ই-কমার্স আসলে অনেক বেশি কিছু। অবশ্যই অনলাইন শপিং সাইট বানানোর মতো টেকনিক্যাল জ্ঞান থাকা দরকার। কিন্তু এর সাথে আরও কয়েক ধরনের জ্ঞান ও দক্ষতা দরকার। এ ছাড়া এ খাতে নেই বিনিয়োগ। ঋণ পাওয়া কঠিন। তাই ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ৫১ শতাংশ দেশীয় বিনিয়োগের দাবি করছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।

সমস্যার সমাধান

তমাল জানান, ই-ক্যাব ইতোমধ্যে একটি যুগোপযোগী জাতীয় ই-কমার্স নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে সরকারকে সাথে নিয়ে জাতীয় ই-কমার্স নীতিমালার খসড়া তৈরি করেছে এবং তা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য পৌঁছানোর সমস্যা দূর করতে ই-ক্যাব চালু করছে ই-পোস্ট নামের অনলাইন ডেলিভারি প্ল্যাটফর্ম। অনলাইন প্ল্যাটফর্মটিতে ডেলিভারি ট্র্যাকিং, মনিটরিং এবং স্বয়ংক্রিয় সাপোর্ট প্রদানের লক্ষে দেশের ই-কমার্সব্যবসায়ী এবং ডেলিভারি সার্ভিস প্রদানকারীদের আনবে ই-ক্যাব।

বাংলাদেশ পোস্ট অফিস ই-পোস্ট এর প্রধান লজিস্টিক পার্টনার হওয়ায় ই-পোস্ট দেশের গ্রাম অঞ্চল পর্যন্ত প্রোডাক্ট ডেলিভারির নিশ্চয়তা প্রদান করবে বলে জানান ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ। তিনি বলেন, ই-পোস্ট এর সাথে সংযুক্ত যেকোন ই-কমার্স সাইট হতে ক্রেতা প্রোডাক্ট অর্ডার দেয়ার পর প্রোডাক্ট ক্রেতার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত ডেলিভারি ট্র্যাকিং এর ব্যবস্থা রয়েছে। দেশের উপজেলা পর্যায়ে ডেলিভারি পৌঁছে দেয়ার জন্য বাংলাদেশ পোস্ট অফিসকে যুক্ত করা হয়েছে।এর ফলে ই-পোস্ট প্রোডাক্ট ডেলিভারির জন্য ক্রেতার এবং ই-কমার্সব্যবসায়ীদের কাছে নির্ভরযোগ্যপ্ল্যাটফর্মহিসেবে ব্যবরিত হবে। প্রতি ডেলিভারি একটি আইডি নাম্বার দিয়ে নির্ধারিত যাতে করে প্রতি ডেলিভারি সংক্রান্ত তথ্যাদি ডাটাবেজে সংরক্ষীত থাকে। এই তথ্য পরবর্তীতে দেশের ডেলিভারি সার্ভিস এর মান উন্নয়ন, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের লজিস্টিক অবকাঠামো উন্নয়ন এবং অনলাইন ব্যবহারকারীদের স্বয়ংক্রিয় সাপোর্ট প্রদানসহ নানা কাজে প্রয়োজন হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ পোস্ট অফিস এর সহযোগিতায় ই-পোস্ট পাইলট প্রকল্প হিসেবে ঢাকা বিভাগে ২০টি পোস্ট অফিসে কর্মচারিদের ব্যবহার করা প্রশিক্ষ দেওয়া হয়েছে। পরে ৬৪ জেলা শহরে এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এছাড়াও ৬৪জেলা শহরের সকল পোস্ট অফিসকে এর আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে। পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে সমগ্র দেশে ডেলিভারি সার্ভিস সহজ, সুলভ, নির্ভরযোগ্য এবং মানোন্নত হবে, সেই সাথে দেশের ই-কমার্স সেক্টর এক ধাপে অনেক দূর এগিয়ে যাবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায়।

ই-ক্যাব সূত্রে জানা গেছে, তাঁরা ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। ইকমাস ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা তৈরি, আর্থিক ও কারিগরি সহায়তাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালানোর জন্য বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের (বিএফটিআই) সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ই-ক্যাব।

ই-ক্যাব সভাপতি শমী কায়সার বলেছেন, জনসাধারণকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান ব্যতিরেকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর সুফল বয়ে আনতে ‘ডিজিটাল অর্থনীতি’ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা যাবে না। সারাদেশে ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশ শুধু তখনই সম্ভব হবে, যখন সারাদেশের জনগণকে ডিজিটাল সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। তাই, আইসিটি এবং ই-কমার্স ভিত্তিক দক্ষ জনবল গড়ে তোলার জন্য সারাদেশে প্রশিক্ষণ কর্মসূচী চালু করার বিষয়ে যথাসম্ভব দ্রুত সময়ের মধ্যে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণের জন্য ই-ক্যাব এর পক্ষ থেকে সরকারকে আহবান জানাচ্ছি।

Exit mobile version