পারস্পারিক অ-অবধারিত সহযোগীতামূলক শ্রম বা সেবার বিনিময়ে একটা কমিউনিটি বা প্লাটফর্মকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়ার পন্থা হিসাবে Co-sharing Business Venture Model (CBV Model / Rocket Model) বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। রকেট মডেল কার্যকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন মডেলটির উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা সাংবাদিক ও র’দিয়া আইএনসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ রবিউস সামস।
প্রকৃতির নিয়মেই আমাদেরকে একে অন্যের উপর নির্ভর করতে হয়। জন্মের পর থেকে লালন-পালন থেকে শুরু করে বার্ধক্যর সময় পর্যন্ত মানুষকে অন্যের নির্ভর করতে হয়। তেমনি কোন উদ্যোগ বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করতে গেলে নিজে নিজে সব কিছু করা সম্ভব হয়ে উঠেনা। পণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, পন্য/সেবা বিক্রি জন্য এবং ট্রেড লাইসেন্স, ব্যাংক একাউন্ট সহ নানাবিধ কারনে বিভিন্ন শ্রেণী বা পেশাজীবী মানুষের প্রয়োজন। একটি উদাহরনের মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার করে বলা যায়। ধরুন, আপনি একজন লেখক। পান্ডুলিপি তৈরী করেছেন, বইটি প্রকাশের জন্য। এক্ষেত্রে, আপনাকে প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। যদিও নিজেও আপনি বইটি প্রকাশ করতে পারেন। উভয় ক্ষেত্রেই একজন কম্পিউটার ডিজাইনার বইটির লে-আউট ডিজাইন করবে, তারপর সেটি দিয়ে ছাপার জন্য প্লেট তৈরী করতে হবে। আর প্রেসম্যান প্লেটগুলো দিয়ে বইটি ছাপাবেন। তারপর বইটি চলে যাবে বাইন্ডিংয়ের জন্য। পরিশেষে, মুদ্রনের পরে বইটি বিভিন্ন বুক স্টলে বা লাইব্রেরিতে চলে যাবে। তারপরে চলে যাবে পাঠকের কাছে। এটি হচ্ছে “অবধারিত সহযোগীতা শ্রম বা সেবা” বা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শ্রম। এই প্রক্রিয়ার অ-অবধারিত সহযোগীতা / শ্রম হচ্ছে – বইটির প্রকাশনা উৎসব করা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বইটির ‘রিভিউ’ হওয়া ইত্যাদি।
এই লেখার আলোচ্য বিষয় হচ্ছে-উদ্যোক্তা উন্নয়নের ক্ষেত্রে অ অবধারিত সহযোগীতা / শ্রম বা সেবার নতুন ব্যবহার।
প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় প্রতিযোগীতা মূলক বাজারে, উদ্যোক্তার উদ্যোগকে সব সময় “আপটুডেট” রাখতে হবে। যে উদ্যোক্তা এই প্রক্রিয়ায় লেগে থেকে আপটুডেট থাকবে সে দিক নির্দেশনা পাবে। আর যারা এই প্রক্রিয়া মধ্যে থেকে নতুন নতুন কৌশল যেমন বাজারজাত কৌশল, বিপনন কৌশল বা অন্যান্য কৌশল রপ্ত করবে তারা দ্রুত এগিয়ে যাবে। তবে নবীন বা তরুন উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে অনেক সময় কৌশলী হওয়া দু:সাধ্য হয়ে পড়ে। জেনে রাখা ভাল, উদ্যোক্তার মূলমন্ত্র লেগে থাকা। লেগে থাকতে থাকতে একটা না একটা সময় উপায় বের হবেই। কৌশলী হবার জন্য অনেকে নেটওয়ার্কিং করেন, বিভিন্ন সংগঠন, ক্লাব, সভা বা সেমিনারে অংশগ্রহন করেন। উদ্যোক্তা উন্নয়নে এগুলো অবশ্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
“সিন্ডিকেট”একটি বহুল প্রচলিত শব্দ যেটিকে আমাদের দেশে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। কিন্তু এই সিন্ডিকেট করে অনেকে অনেক বড় বড় ব্যবসা হাতিয়ে নেন। এটা ওই ব্যবসায়ির জন্য একটা অ-অবধারতি কৌশল অবলম্বন। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারী উদ্যোক্তারা সিন্ডিকেট কৌশল খুব একটা কাজে লাগতে পারেনা বা কাজে আসে না। বিকল্প হিসাবে তারা যেটা করতে পারেন তা হলো বিভিন্ন ব্যবসা উদ্যোগ মডেল অনুসরণ করতে পারে। তেমনি একটি ব্যবসা উদ্যোগ মডেল হচ্ছে Co-sharing Business Venture Model যাকে সংক্ষেপে সিবিভি বা রকেট মডেল বলা হয়। কীভাবে এই রকেট মডেল বাস্তবায়ন করা যায় তা নিচে আলোকপাত করা হল।
এই ক্ষেত্রে সমমনা কিন্তু বিভিন্ন সেক্টরের উদ্যোক্তা বা একটা প্লাটফর্মে তাদের পন্য বা সেবা পরস্পরের মধ্যে কেনা বা বেচার ব্যবস্থা করতে পারেন অল্প লাভের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে নিজেদের পোর্টফোলিও বাড়বে, সেই সাথে ব্যবসার ও বিস্তৃতি বাড়বে। একটা উদাহরন দেয়া যেতে পারে।
যেমন ‘চাকুরী খুজবো না চাকুরী দেব’ অথবা ‘এন্টারপ্রেনারস ক্লাব অফ বাংলাদেশ’ (ই – ক্লাব) । এই গ্রপগুলো তাদের সদস্যদের উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে বেশ কিছু কাজ করছে। যেমন, পন্য উৎপাদন সহায়ক পুঁজি সংগ্রহ, মেলা, উদ্যোক্তা সম্মাননা, কর্মশালা ইত্যাদি আয়োজন করে । রকেট মডেল তে এগুলো থাকবে সেই এই গ্রুপ বা ক্লাবটি আরো কিছু বাড়তি ভূমিকা পালন করবো।
যেমন তারা Trusted Partner (ট্রাস্টটেড পার্টনার) খুঁজে বের করবে ট্রাস্টটেড পার্টনারদের Digital Presence এবং Social Media কার্যক্রম যথাযথ আছে কিনা; না থাকলে তা করার ব্যবস্থা করা, থাকলে তা হাল নাগাদ আছে কিনা তা পরীক্ষা করা। সোসাল মিডিয়া / পেজ গুলো নিয়মিত আপডেট হচ্ছে কিনা। তাদের নিজস্ব কোম্পানি প্রোফাইল, ব্রোসিয়োর আছে কিনা, লিফলেট আছে কিনা / থাকলে তা পরীক্ষা করা না থাকলে স্বল্প মূল্যে ব্যবস্থা করে দেয়ার উপদেশ দেয়া / ওয়েব সাইট / ব্রোসিয়ার কন্টেন্ট তৈরীতে সহায়তা করা। সেই সাথে কিভাবে বিপনন বৃদ্ধি করা যায়। সেই সব বিষয় খতিয়ে পরামর্শ দেয়া। ট্রেড লাইসেন্স, ব্যাংক আ্যাকাউন্ট, ট্যাক্স, ভাট এর কাগজ পত্র ঠিক আছে কিনা নিয়মিক দেখভাল করা।
এর জন্য একটি Counseling Body থাকবে, যারা এই বিষয়গুলে তদারকি করবে। এর জন দরকার 1. কমিউনিটি বা প্লাটফর্মের Members Directory তৈরি করা 2. কমিউনিটি বা প্লাটফর্মকে Working Checklist অনুযায়ী কাজ করা।
রকেট মডেলের সুবিধাসমূহঃ
- প্রযুক্তি, দ্রব্য ও সেবা বিনিময়
- আন্তঃ যোগাযোগ বৃদ্ধি
- বিশ্বস্ততা ও দ্রুততার সাথে প্রযুক্তি, দ্রব্য ও সেবা গ্রহণ কিন্তু মানের কোন কমতি থাকবে না
- বিজ্ঞাপন ব্যয় শূন্য রেখেই ব্যবসা চালু করা
- একটি নির্দিষ্ট কমিউনিটি বা প্লাটফর্মে জোরালো নেটওয়ার্ক স্থাপন হওয়া
- কমিউনিটি বা প্লাটফর্মের সদসদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা করার মানসিকতা থাকা।
রকেট মডেলের সাতটি স্তর আছে। মডেলটি কার্যকরী ভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে এই সাতটি স্তর ফলো করতে হবে। প্রথমত একটি কমিউনিটি বা প্লাটফর্মে কিছু নির্দিষ্ট বয়সসীমার সমমনা উদ্যোক্তা থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত যেসব পণ্য বা সেবা থাকবে সেগুলো মধ্যে বৈচিত্র থাকতে হবে। কমিউনিটি বা প্লাটফর্মে সদস্যদের মধ্যে trusted partner থাকতে হবে এবং কাউন্সেলিং বডি trusted partnerদের বিভিন্ন সহায়তামূলক পরামসশ দেবে। পরবর্তী পর্যায়ে trusted partnerরা তাদের মধ্যে সুলভ / সাশ্রয়ী লাভে একজন অপরজনের কাছে তাদের পণ্য বা সেবা বিক্রয় ব্যবস্থা করব। এভাবে একটা সময় পর কমিউনিটি বা প্লাটফর্মের প্রত্যেক trusted partner পোর্টফোলিও ভারি হবে এবং এভাবে তারা গ্রোথ হ্যাকিং এর পর্যায়ে চলে যাবে। এভাবেই রকেট মডেল টেস্ট করা সম্ভব এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস যদি এই পেশাটি পর্যায় পর্যালোচনা করে কোন কমিউনিটি প্লাটফর্ম এই মডেল ইমপ্লিমেন্ট করে তাহলে তাদের ব্যবসায় উন্নতি হবে নিঃসন্দেহে বলা যায়।
রকেট মডেলটি বাস্তবায়নের কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকবে না। এটা নির্ভর করবে কমিউনিটি বা প্লাটফর্মের কাজের ব্যাপ্তি, সদস্য সংখ্যা ইত্যাদি বিষয়ের উপর।
উল্লেখ, অতীত কালে দ্রব্য বিনিময় প্রথার প্রচলন ছিল। আমাদের দেশে এখনও গ্রামে-গঞ্জে হাট-বাজারে গেলে দেখা যায় কেউ কেউ পণ্য/ দ্রব্য এনে তা বিক্রি করে আবার অন্য পণ্য/দ্রব্য কিনে নিয়ে যায়। আবার প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পন্য বা সেবা অর্থের মাধ্যমে আদান প্রদান করা হয়। তাই এই রকেট মডেলে পণ্য বা সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রের অবশ্যই আর্থিক লেনদেন থাকতে হবে। এটি হবে বিশেষ করে নবীন বা তরুণ উদ্যোক্তা উৎসাহিত করার জন্য এবং তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রমোশনের জন্য। এই ভাবে রকেট মডেলের মাধ্যমে উদ্যোক্তা কমিউনিটি বা প্লাটফর্মের উন্নতি সাধন করা সম্ভব।
লেখকের সাথে যোগাযোগ radiadhk@gmail.com