এখন সবাই জানেন সেবা এক্স ওয়াই জেড সম্পর্কে। এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আদনান ইমতিয়াজ হালিম। তিনি সেবার বেড়ে ওঠা ও ভবিষ্যৎ দিনগুলো সম্পর্কে কথা বলেছেন টেকজানোর সঙ্গে।
আপনার পরিচয়? নাম আদনান ইমতিয়াজ হালিম। সিইও-সেবা এক্স ওয়াই জেড।বেড়ে ওঠা ঢাকায় আর পড়াশুনা ইলেকট্রিক এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে।
সেবা প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র নিয়ে বিস্তারিত যদি বলতেন?
আদনান: শুরুর গল্পটা দুজন বন্ধু দিয়ে – আমি আদনান এবং আমার বন্ধু সজীব। আমাদের তখন স্বনামধন্য বহুজাতিক কোম্পানিতে ক্যারিয়ার। কিন্তু হঠাৎ এক অন্যরকম স্বপ্ন বুনতে শুরু করলাম আমরা স্বপ্নের গণ্ডিটা শুধু নিজেদের নিয়ে নয়, পুরো দেশকে নিয়ে, দেশের মানুষকে নিয়ে ছিল। আমরা চিন্তা করলাম যে, যদি বাংলাদেশে এমন একটি মাধ্যম দাড় করানো যায় যেখানে বাংলাদেশের সকল স্তরের সেবা দানকারীরা, ব্যাবসায়িরা প্রযুক্তির মাধ্যমে পুরো দেশ জুড়ে তাদের সেবা পাঠাতে পারবেন, দেশের সব প্রান্ত থেকে তারা কাস্টোমার পাবেন, তাহলে কেমন হয় ? ব্যাস, এখান থেকেই সেবার যাত্রা শুরু। ২০১০ সাল থেকে শুরু হয় সেবাকে গড়ার প্রচেষ্টা । স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে যেয়ে বিসর্জন দিতে হয়েছে আমাদের ক্যারিয়ার এবং আর্থিক নিরাপত্তা। Sheba.xyz এর মাধ্যমে আমরা শুধু আর্থিক সাফল্যই নয়, চাইছিলাম সমাজের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কিছু করার সুযোগ। নানান বাধা বিপত্তি কঠোর পরিশ্রমের পর অবশেষে ২০১৫ সালে অবশেষেতৈরিহয় Sheba.xyz টিম।আমরা গ্রাহকদের ঘরে ঘরে যেয়ে নিজ হাতে বিভিন্ন ধাপে ধাপে নিজেরাই টেস্টিং করেছি প্রথম ১৪ মাস । মূল্য এবং গুণমান ঠিক করতে নিয়েছি শত শত ইন্টারভিউ। অবশেষে জুলাই ২০১৬ সালে শুরু হয় Sheba.xyz এর যাত্রা । বাংলাদেশে Sheba.xyz এখন সর্ববৃহৎ অনালাইন মার্কেট প্ল্যাটফর্ম ।
দক্ষিণ এশিয়ার ৩টি দেশ – ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার এবং ভিয়েতনামে চালু হবে সেবা
সেবা কতটা সবার সেবা দিতে পারছে, বা নিজেদের কতটা সফল দাবী করছেন?
আদনান: হুট করে কোন ব্যবসা বা কোম্পানি সফল হয় না। একটা দীর্ঘ সময় ধরে অর্থ, মেধা, শ্রম বিনিয়োগের পর সফলতা আসতে শুরু করে । আমি মনে করি সেবা সফল কিনা সে প্রশ্ন খোঁজার সময় এখনও আসেনি। আমরা ১০ বছরের টার্গেট নিয়ে এগুচ্ছি এবং আমাদের মতন কাজ করে যাচ্ছি । আমাদের কোম্পানির ৭০ জনের টিম এবং ১৬০০ সার্ভিস প্রভাইডার যে এফোর্ট দিচ্ছে তা উল্লেখযোগ্য। তবে আমি আরও মনে করি, আমাদের আরও বহুদূর যাওয়া বাকি এবং আমরা এগিয়ে যাচ্ছি ।
সেবার পরিধি এখন কতটুকু আছে, আর সামনে আর কোথায় কোথায় সেবার পরিধি বাড়াচ্ছেন?
আদনান: সেবা বর্তমানে সমগ্র ঢাকা জুড়ে দৈনন্দিন জীবনের সব রকম সার্ভিস প্রদান করছে। গত ১বছরে সেবা সফলভাবে ডেলিভারি দিয়েছে প্রায় ৭৫,০০০ অর্ডার । আমাদের কাছে আছে ৩৫,০০০ এরও বেশী কাস্টোমার এবং ১৬০০ এরও বেশী সার্ভিস প্রভাইডার । আমরা এ বছরের মধ্যেই টার্গেট করছি ১০ লাখ কাস্টমার এবং ১০ হাজার সার্ভিস প্রভাইডার। ২০১৮ সালের মধ্যেই সমগ্র বাংলদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে সেবা।এরপর ২০১৯ সাল থেকে আমরা আমাদের কার্যক্রম দক্ষিণ এশিয়ার ৩টি দেশে – ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার এবং ভিয়েতনামে বিস্তৃত করব ।
মানুষের সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে কাজ করাটার স্বপ্ন বা অনুপ্রেরণা পেলেন কিভাবে? আদনান: আমার ১২ বছরের ক্যারিয়ারে সাফল্য ছিল কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারিনি কখনো । ব্যাক্তিগত জীবনে সাফল্য থাকলেও সামাজিক জীবনে তেমন কোন অবদান আমার ছিল না । এই ব্যাপারটা আমাকে স্বস্তি দিচ্ছিল না। মন থেকে চেয়েছিলাম অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের সমাজের সমস্যাগুলি সমাধান করতে , আমার দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে। এই চাওয়া থেকেই সেবা উদ্যোক্তা হয়ে উঠা ।
সেবা মানুষদের যেভাবে দিচ্ছে, ঠিক আমরা যতটুকু জানি, এখানের কর্মী বা অফিস পরিবেশও অনেক সুন্দর, সহযোগিতা ও সহমর্মিতায় ভরা; একটু যদি বলতেন?
আদনান: আমাদের অফিসের কালচারটা একটু ভিন্ন। আমারা সবাই এখানে শিখছি । কেউ কারো চেয়ে উপরে বা নীচে না। বলতে পারেন আমরা একটা প্ল্যাটফর্মের মতন যেখানে কোম্পানির প্রত্যেক কর্মী নিজেকে কর্মী নয়, বরং কোম্পানির মালিক মনে করছে । আমি মনে করি কর্মক্ষেত্রে ওনারশিপটা অনুভব করতে পারা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি চেষ্টা করি এই ব্যপারটা আমাদের অফিসের ভেতর রক্ষা করতে ।
আপনাদের অফিস ব্যবস্থাপনায় এমন কোন কাজজগুলো নিয়মিত করেন, যা আপনাকে/ আপনাদের অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখে?
আদনান: সময়ের ব্যাপারে আমরা খুব সচেতন। অফিসের সবার জন্য সময় এক – ৮ টা থেকে ১০টার মাঝে ঢুকতে হবে । এরপর যে যার কাজ করে বেড় হতে পারে । কেউ যদি বেশিক্ষণ কাজ করে দেরীতে বাসায় ফেরে, সেটাকে আমি খুব ভাল বলবনা । আমরা বিশ্বাস করি স্মার্ট ওয়ার্ক কালচারে । যে যত বেশী দক্ষ এবং স্মার্ট, তত দ্রুত সে কাজ সেরে অফিস থেকে বেড় হতে পারে। এটাকে আমি বেশী এপ্রিশিয়েট করি ।
আপনার পড়াশুনা থেকে শুরু করে পরিবার, যে কাউকে গড়তে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে; আপনার ক্ষেত্রে কেমন ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে?
আদনান: আমি ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্টুডেন্ট ছিলাম, এর মাঝেই আমার গ্রামীনফোনে জব হয়ে যায়। আমার বাবা মার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, তারা আমার কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেনি। পরিবার থেকে মানসিক সাপোর্ট না পেলে এগিয়ে চলাটা কঠিন হয়ে যায় । আমার স্ত্রী, মা এবং শাশুড়িকে দেখে আমি একটি ব্যপার লক্ষ্য করেছি যে নারীরা সবদিক খুব ভাল ভাবে ম্যানেজ করতে পারে। এবং তাদের মাঝের ওনারশিপ ব্যপারটা খুব কাজ করে। তাই আমি সেবাতে নারীদের যোগ দিতে উৎসাহিত করি । কারণ আমরা চাই কোম্পানি এমন হোক যেখানে প্রতিটা কর্মী কোম্পানিকে নিজের মনে করে এগিয়ে নিয়ে যাবে । এখানে কোন পজিশন নিয়ে ভেদাভেদ থাকবেনা, প্রত্যেক কর্মীই কোম্পানিকে নিজের মনে করবে।
সেবা একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান; একটু যদি জানতে চাই; বাণিজ্যিক অপারেশন্স এর বাইরে, সামাজিক দায়বদ্ধতায় আপনারা বিশেষ কোনো সেবায় নিজের সামিল করছেন কি’না, কিভাবে?
আদনান: সেবা আসলে একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে বাংলাদেশের সেবা দানকারীরা এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা কে বৃদ্ধি করার সুযোগ পাচ্ছেন। আমাদের কোম্পানিতে এমন বেশ কয়েকজন রয়েছেন যারা সেবার মাধ্যমে নিজের জীবন পাল্টে ফেলেছেন। এমন একজন হচ্ছে আমাদের কাউসার। একজন সাধারন প্লাম্বার থেকে কাউসার এখন কাউসার এন্টারপ্রাইজের মালিক। তার অধীনে আছে ১৬ জন রিসোর্স। সমগ্র ঢাকাজুড়ে তারা সার্ভিস প্রদান করছে এবং আয় করছে বহুগুণ। আমাদের দেশের এই কর্মজীবী মানুষদের সুযোগ খুব কম। তারা কোন অংশেই কম শ্রম দেন না কিন্তু তারপরও তারা সেখানেই আটকে যান। সেব চেষ্টা করছে এই মানুষগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করে দিতে। যে ব্যাবসায়ী তার ক্ষুদ্র ব্যাবসার জন্য একটি ব্যাঙ্ক একাউন্ট পর্যন্ত খুলতে পারতেন না, তিনি এখন Sheba.xyz এর মাধ্যমে শুধু ব্যাঙ্ক একাউন্টই নয়, বরং পুরো একটি কল সেন্টার এর মাধ্যমে তার ব্যাবসা বিস্তারের সুযোগ পাচ্ছেন, আর লাভ করছেন ব্যাবসায়িক স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক মর্যাদা । যে ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ীর আগে অসুস্থ হলে ঘরে বসে থাকতে হত, সারা দিনের রোজগার বাদ দিয়ে, সে এখন নিশ্চিন্তে তাদের ব্যাবসা চালিয়ে যেতে পারছেন সেবার মাধ্যমে । যে নারী সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে ঘর থেকে বের হয়ে এসে ব্যাবসা করতে পারতেন না , তিনি এখন ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন তার দক্ষতা, হয়ে উঠছেন স্বাবলম্বী ।
আপনার কাছ থেকে তরুণরা, বা যাঁরা এমন নতুন কিছু করতে চান, তাঁরা কী শিখতে পারেন?
আদনান: ব্যাবসা করা চাকরির চেয়ে কঠিন, যদিও আমরা সাধারণত উলটো মনে করি । স্টার্ট আপ খোলা টা আসলে কোন হবির ব্যাপার না । এখানে প্রচুর ধৈর্য এবং শৃঙ্খলা প্রয়োজন । স্টার্ট আপ শুরু করার আগে অন্তত ৫ বছর জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় কাটানোর মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করা উচিৎ । ৬মাসেই কোন ব্যাবসা দাঁড়ায় না । অন্তত ৫ বছর শ্রমের পর একটি ব্যাবসায় সাফল্য আসতে পারে । এটাকে অনেকটা এভাবে বলা যায় , স্টার্ট আপ কোন স্প্রিন্টার না যে দ্রুত দৌড়ে পৌঁছে যাওয়া যাওয়া যাবে। বরং এটা অনেকটা ম্যারাথনের মতন, রোলার কোস্টার এর ম্যারাথন , এখানে আপনাকে দৌড়াতে হবে দ্রুত , আবার তা শেষও হবে না । তবু আপনাকে এগিয়ে যেতে হবে ।
অনেক কঠিন সময় আমাকে পার করতে হয়েছে কিন্তু আমি কখনো হতাশ হয়ে যাইনি । নিজেকে বুঝিয়েছি যে এর চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আসতে যাচ্ছে আমার সামনে, তাই ভেঙে পড়লে চলবে না । এভাবে নিজেকে মোটিভেট করার খুব দরকার । যদি কেউ স্টার্ট আপ খোলার আগে অন্তত ২ বছর কোন স্টার্ট আপ এ জব করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে সেটা খুবই কাজে দিবে । আর অবশ্যই নেটওয়ার্কিং খুব গুরুত্বপূর্ণ ।
নিজের সবচেয়ে কঠিন সময় উতরে যেতে করেন, এমন ৩টা কাজ বা বিষয় সম্পর্কে জানতে চাই?
আদনান: যে কোন কঠিন পরিস্থিতিতে আমি ৩টা বিষয় খেয়াল রাখি – Consistency, Adapting Ability এবং Resilience । সময় যতই কঠিন হোক না কেন, কাজে চালিয়ে যেতে হবে, যে কোন মুহূর্তে যে কোন সময় পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ায়ে এগিয়ে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে এবং যে কোন বাধার মুখে অটল থাকতে হবে।
দেশ এবং বর্তমান বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সব সেবায় ডিজিটাইজ্ড হতে, আমাদের কোন কোন ক্ষেত্রে নজর দেয়া দরকার?
আদনান: বিশ্বজুড়ে এখন ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিভল্যুশন ৪.০ চলছে । এই বিপ্লবে ডিজিটাল ব্যাবসার প্রাধান্য বেশী ।ইউরোপের মার্কেট এডভান্সড হলেও স্যাচুরেটেড। সেই তুলনায় এশিয়া মহাদেশে মার্কেটের পটেনশিয়াল অনেক অনেক বেশী ।
এই মার্কেট পটেনশিয়াল তা পুরোপুরি ধরতে আমাদের তরুন মেধার প্রয়োজন । তরুণ মেধাবীরা দেশে তাদের মেধা বিনিয়োগ করলেই আমাদের দেশ বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সব ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজড হতে পারবে। এ জন্য আমি মনে করি আমাদের তরুন মেধাদের এবং স্টার্ট আপদের দিকে মনোযোগ দেয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইতিমধ্যেই সরকার স্টার্ট আপ ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়নের জন্য শতভাগ চেষ্টা করছে । সরকারের সহযোগিতায় সেবা এগিয়ে চলছে । সত্যি বলতে, জিপি এক্সিলারেটর এবং আই সি টি ডিভিশনের আইডিয়া প্রজেক্ট, এই দুই সেক্টরের সহযোগিতায়ই সেবা এতদূর এসেছে । এরকম সহযোগিতা এবং উদ্যোগের ফলেই আমাদের দেশের স্টার্ট আপ এবং তরুণরা দেশকে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
ধন্যবাদ আপনাকে
আদনান: টেকজানো (Techjano.com) ও এর পাঠকদের ধন্যবাদ।