আজকাল প্রায়ই শোনা যায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের প্রয়োজনীয়তার কথা। কিন্তু আসলে কি এই ফ্যাটি এসিড? কেনই বা খেতে হয় এই ওমেগা ৩? উপকারীতা কি কি? এসবের উত্তর জানা নেই অনেকেরই। ‘ওমেগা-৩’ এর নাম শুনেছেন কিন্তু বিস্তারিত জানেন না এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি। চিকিৎসাশাস্ত্র সংশ্লিষ্ট ও স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের অনেকেরই অবশ্য এটা জানা,‘অতি প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিড’ মানুষের শরীরের জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয় উপাদান। আমাদের মস্তিষ্কের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগই এই ফ্যাটি এসিড। সেল মেমব্রেন, হরমোন, সিগনালিং ম্যাসেঞ্জার প্রভৃতি তৈরিতে ফ্যাটি এসিডের গুরুত্ব অনেক। উপকারী এই ফ্যাটি এসিডকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন বিজ্ঞানীরা- অতি-প্রয়োজনীয় ও স্বল্প প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিড। এদের মধ্যে অতিপ্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিডের অধিকাংশই মানুষের শরীর নিজে নিজে তৈরি করতে পারে না। খাবারের থেকে গ্রহণ করতে হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় হল ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড। এদিকে স্বল্প প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিড বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে শরীর নিজেই তৈরি করতে পারে।
ওমেগা ৩ কি? ‘ওমেগা ৩’ হল এক ধরণের অসম্পৃক্ত চর্বি। স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ মাত্রই জানেন, সম্পৃক্ত চর্বি হৃদযন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। তেল-চর্বিযুক্ত খাবার একটা বয়েসের পর সে কারনে খেতে মানা। কিন্তু অসম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খেতে বাধা নেই, বরং এটি রক্তে উপকারী চর্বির পরিমাণ বাড়ায় এবং দেহের নানা উপকার করে। প্রকৃতিতে কয়েক ধরনের ‘ওমেগা ৩’ চর্বি আছে। এর মধ্যে ‘আলফা লিনোলেইক’ এসিড পাওয়া যায় কিছু উদ্ভিজ্জ্ব খাবার বা তেলে। অন্যদিকে সামুদ্রিক খাবারে পাওয়া যায় ‘ইকোসা পেন্টানোয়িক অ্যাসিড’ এবং ‘ডোকোসা হেক্সানোয়িক অ্যাসিড’। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে আমাদের খাদ্যে প্রধান উপাদান তিনটি। কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও চর্বি। এর মধ্যে চর্বির প্রধান কাজ হল দেহে শক্তি যোগানো। চর্বি থেকে সমপরিমান কার্বোহাইড্রেট বা প্রোটিনের চেয়ে দ্বিগুনেরও বেশি শক্তি মেলে। শরীরের চর্বি আবার তিন ধরনের- ট্রাইগ্লিসারাইড, কোলেস্টেরল আর ফসফোলিপিড। এদের মধ্যে আবার দেহে ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। ট্রাই গ্লিসারাইড তৈরী হয় তিনটি ফ্যাটি এসিডের সঙ্গে গ্লাইসেরল মিলে। স্যাচুরেটেড বা সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড দিয়ে তৈরী চর্বি শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে ধমনীর ভেতরের গায়ে লেগে যায়। এতে ধমনীর ব্যাস ক্রমশ ছোট হয়ে আসে। ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। দুধ, ঘি, মাখন, মাংস, ক্রীম, ডিম, চকোলেট ইত্যাদি সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডের উৎস। এই সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডগুলো স্বাভাবিক তাপমাত্রায় কঠিন আর অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডগুলো তরল হয়। মোনো আনস্যাচুরেটেড চর্বি পাওয়া যায় সমস্ত ধরনের বাদাম, জলপাই তেল, এবং ক্যানোলা তেল এ। মোনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল (এল.ডি.এল) কমায়। তাই এর ব্যবহার নিঃসন্দেহে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল বা এল,ডি,এল এর মাত্রা কমিয়ে কোলেস্টেরল জনিত ধমনীর রোগ প্রতিহত করে। পলি আনস্যাচুরেটেড চর্বি পাওয়া যায় সয়াবিন, সুর্য্যমুখীর তেল, ভুট্টা ইত্যাদিতে। ওমেগা-৩ এর মতো ওমেগা-৬ ও ‘অতি প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিড’ । খাদ্যে ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের অনুপাতও রক্তের চর্বি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ন। বর্তমানে খাদ্যে ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ বেশী, যা কমিয়ে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ বাড়ানো জরুরী। তা নাহলে ওমেগা-৩ ও ৬ এর ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়ে দেখা দেবে নানা ধরনের মারাত্মক সব অসুখ। ক্ষতিকর চর্বি বিভিন্ন ধরনের তরল তেলকে হাইড্রোজেন যোগ করে তৈরী হয় কঠিন চর্বি, যেমন- ডালডা, মার্জারিন ইত্যাদি। আর হাইড্রোজেন যোগ করার এই পদ্ধতি বা হাইড্রোজেনেশানের ফলে তৈরী হয় ট্রান্স ফ্যাট। তেলকে যদি উচ্চ তাপমাত্রায় গরম করা হয় বা বার বার একই তেল গরম করে ব্যবহার করা হয় তা হলেও তার মধ্যে ট্রান্স ফ্যাট তৈরী হয়। ট্রান্স ফ্যাট রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল বাড়ায় ফলে কোলেস্টেরল জনিত ধমনীর রোগ যেমন-করোনারী হার্ট ডিজিজ, হার্ট এটাক, ব্লাড প্রেশার ইত্যাদির সম্ভাবনা বাড়ায়।
ওমেগা-৩ এর কাজ দেহে প্রদাহ কমানো, অপ্রয়োজনীয় রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিহত করা, ইনসুলিনের কার্য্যকারিতা বাড়ানো, রক্তের কোলেস্টেরল কমানো, প্লেটলেট বা অনুচক্রিকা জড়ো হওয়া কমানো, রক্তে ট্রাই গ্লিসারাইড কমানো, ক্যান্সার কোষের বাড়া প্রতিহত করা, রক্ত নালীর পুরু হয়ে যাওয়া, রক্তনালীর প্রসারণে সহায়তা, শরীরের রোগ প্রতিরোধ বাড়ানো ইত্যাদি।
যেসব রোগে ওমেগা-৩ উপকারী
হৃদরোগ প্রতিরোধ, হৃৎপিন্ডকে সবল রাখা, রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং কোলেস্টেরল কমিয়ে স্ট্রোক প্রতিরোধ। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, রক্তচাপ কমানো, মানসিক রোগ যেমন- ডিপ্রেশান, ডিমেনসিয়া, এটেনশান ডেফিসিট হাইপার এক্টিভিটি ডিজর্ডার, শিশুদের সুস্থ্য সবলভাবে বেড়ে ওঠার জন্য যথেস্ট পরিমাণ ওমেগা- ৩ ফ্যাটি এসিড প্রয়োজন। ক্যান্সার প্রতিরোধ, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি।
ওমেগা ৩ পাওয়া যায় কোথায় উদ্ভিজ্জ তেল যেমন- তিসির তেল ও ক্যানোলা অয়েল ইত্যাদিতে পাওয়া যায় ওমেগা ৩। যা আমাদের দেশে ব্যবহৃত হয় না। এদিকে সয়াবিন তেলে ওমেগা ৬ এর পরিমাণ বেশি থাকায় এর নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করতে হবে। সামুদ্রিক মাছের তেল ওমেগা ৩-এর উৎকৃষ্ট উৎস। এছাড়া গবেষণায় পাওয়া গেছে, দেশীয় মাছের মধ্যে রুই মাছ, পাংগাস, মাগুর ইত্যাদি মাছের তেলে পাওয়া যাবে ওমেগা ৩। এতে ওমেগা ৩ ও ৬ এর ভারসাম্য বর্ণণামূলকভাবে সঠিক মাত্রায় বিদ্যমান। বীজ জাতীয় খাবারেও পাওয়া যায় ওমেগা ৩। মাছের ডিমে ক্ষতিকর চর্বির সঙ্গে বেশ ভালো পরিমাণে থাকে ওমেগা ৩। ১ চামচ মাছের ডিমে প্রায় ৩৪২ মিলিগ্রাম পরিমাণ ওমেগা ৩ পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধরনের বাদামে আছে ওমেগা ৩। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে আছে ওয়ালনাট বা আখরোট, পেস্তা ইত্যাদি বাদামে। শাকসব্জী যেমন পালং শাক, ব্রক্কোলী, তিষির তেল, ওয়ালনাট, ক্যানোলা তেল ইত্যাদিতে যথেষ্ট পরিমানে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড থাকে। এদিকে একদিনে মাত্রাতিরিক্ত ওমেগা ৩ (৩ গ্রাম এর অধিক) স্ট্রোকের মত ভয়ংকর রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। তাই ওমেগা ৩ ও ৬ এর ভারসাম্য জেনে বুঝে খাদ্য গ্রহণ করা উচিৎ।
লেখক: মাহবুব মাসফিক, তথ্যপ্রযুক্তি লেখক