বাংলাদেশে কর্পোরেট গভর্নেন্স প্রতিষ্ঠায় উৎকর্ষতা সাধন এবং কোম্পানির সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ৪১ টি প্রতিষ্ঠানকে কর্পোরেট গভর্নেন্স এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড প্রদান করল ইন্সটিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারীজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি)।
গতকাল সন্ধ্যায় (৫ অক্টোবর) রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের গ্র্যান্ড বলরুমে ‘১১তম আইসিএসবি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর কর্পোরেট গভর্ন্যান্স এক্সিলেন্স, ২০২৩’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আইসিএসবি।
আইসিএসবির নির্ধারিত মান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে কর্পোরেট গভর্নেন্স, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় কোম্পানিগুলোর প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কর্পোরেট গভর্নেন্স কোডের সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকান্ড পরিচালনার ভিত্তিতে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। এবারের পুরস্কারের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘প্রমোটিং গভর্নিং এক্সিলেন্স’।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থ, বাণিজ্য এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর চেয়ারম্যান জনাব খন্দকার রাশেদ মাকসুদ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সচিব জনাব ড. মোঃ খায়েরুজ্জামান মজুমদার, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব সেলিম উদ্দিন এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান জনাব মোঃ আব্দুর রহমান খান, এফসিএমএ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান এবং আইসিএসবি-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব এম নুরুল আলম এফসিএস।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ পিএলসি ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ পিএলসি-এ তালিকাভুক্ত কোম্পানিসমূহের মধ্য থেকে ১৪ টি ক্যাটাগরিতে বিজয়ী ৪১ টি কোম্পানিকে ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট প্রদান করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। গোল্ড, সিলভার ও ব্রোঞ্জ- এই তিনটি ক্যাটাগরিতে কোম্পানিসমূহকে পুরষ্কার প্রদান করা হয়।
জেনারেল ব্যাংকিং সেক্টরে গোল্ড অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি; ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসি সিলভার এবং সিটি ব্যাংক পিএলসি ব্রোঞ্জ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে। ইসলামিক ব্যাংকিং ক্যাটাগরিতে কোনো কোম্পানি পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হয়নি।
নন-ব্যাংকিং ফাইন্যান্সিয়াল ইন্সটিটিউশন ক্যাটাগরিতে গোল্ড অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে আইডিএলসি ফাইন্যান্স পিএলসি; আইপিডিসি ফাইন্যান্স পিএলসি সিলভার এবং ডিবিএইচ ফাইন্যান্স পিএলসি ব্রোঞ্জ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে।
জেনারেল ইন্স্যুরেন্স ক্যাটাগরিতে গোল্ড অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে সিটি ইন্স্যুরেন্স পিএলসি; গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স পিএলসি সিলভার এবং সেনা ইন্স্যুরেন্স পিএলসি ব্রোঞ্জ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে।
লাইফ ইন্স্যুরেন্স ক্যাটাগরিতে সিলভার অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড এবং ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স পিএলসি ব্রোঞ্জ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে। ফার্মাসিউটিক্যালস ও কেমিক্যাল ক্যাটাগরিতে গোল্ড অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস পিএলসি; দি ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি পিএলসি সিলভার এবং দি একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড ও নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস পিএলসি উভয়েই ব্রোঞ্জ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে।
টেক্সটাইল ও আরএমজি ক্যাটাগরিতে গোল্ড অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল পিএলসি; মতিন স্পিনিং মিলস পিএলসি সিলভার এবং স্কয়ার টেক্সটাইল পিএলসি ও শাশা ডেনিমস লিমিটেড উভয়েই ব্রোঞ্জ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে।
ফুড ও অ্যালায়েড ক্যাটাগরিতে গোল্ড অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে ইউনিলিভার কনজিউমার কেয়ার লিমিটেড; অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড সিলভার এবং এগ্রিকালচারাল মার্কেটিং কোম্পানি লিমিটেড ব্রোঞ্জ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে।
ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন টেকনলজি ক্যাটাগরিতে গোল্ড অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে আইটি কনসালটেন্টস পিএলসি; এডিএন টেলিকম লিমিটেড সিলভার এবং বিডিকম অনলাইন লিমিটেড ও আমরা টেকনলজিস লিমিটেড উভয়েই ব্রোঞ্জ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে।
ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ক্যাটাগরিতে গোল্ড অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসি; সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড সিলভার এবং বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেড ব্রোঞ্জ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে।
ম্যানুফ্যাকচারিং ক্যাটাগরিতে গোল্ড অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেড; আরএকে সিরামিকস (বাংলাদেশ) লিমিটেড সিলভার এবং ইনডেক্স অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড উভয়েই ব্রোঞ্জ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে।
ফুয়েল এন্ড পাওয়ার ক্যাটাগরিতে গোল্ড অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড; এমজেএল বাংলাদেশ পিএলসি সিলভার এবং লিনডে বাংলাদেশ লিমিটেড ব্রোঞ্জ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে।
সার্ভিস ক্যাটাগরিতে গোল্ড অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস পিএলসি এবং ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড সিলভার অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে।
টেলিকমিউনিকেশন্স ক্যাটাগরিতে গোল্ড অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে গ্রামীণফোন লিমিটেড; রবি আজিয়াটা পিএলসি সিলভার এবং বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবলস পিএলসি ব্রোঞ্জ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থ, বাণিজ্য এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা, ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “এই পুরস্কার শুধু একটি স্মারক নয়; বরং আমাদের দেশে কর্পোরেট শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্রে একটি মাপকাঠি। আইসিএসবি গত কয়েক দশকে কর্পোরেট গভর্ন্যান্সের ক্ষেত্রে একটি বিশ্বস্ত নাম হয়ে উঠেছে, যা সত্যিই প্রশংসনীয়।”
বিজয়ীদের অভিনন্দন জানিয়ে তিনি আরও বলেন “এই ধরনের স্বীকৃতির ফলে তালিকাভুক্ত কোম্পানিসমূহকে সুশাসন ও কমপ্লায়েন্সের বিষয়গুলো বজায় রাখার বিষয়ে আরও বেশি মনোযোগী হয়ে উঠছে। এই পুরস্কার প্রতিষ্ঠান ও তাদের নীতি-নির্ধারনী ও সুশাসনের ক্ষেত্রে আরও উন্নতি করার জন্য অনুপ্রাণিত করবে। আইসিএসবি আমাদের কর্পোরেট নেতৃত্ব ও উন্নত কর্পোরেট সংস্কৃতি গড়ে তুলছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।”
বিশেষ অতিথি বিএসইসি-এর চেয়ারম্যান জনাব খন্দকার রাশেদ মাকসুদ তার বক্তব্যে বলেন, ‘টেকসই পুঁজিবাজারের জন্য তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে অবশ্যই কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড মেনে চলার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে’।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সচিব, ড. মোঃ খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, “এই অনুষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল কর্পোরেট ব্যবস্থাপনায় সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা। আইসিএসবি ব্যবসায়িক খাতে চার্টার্ড সেক্রেটারীদের ক্ষমতা এবং সৃজনশীলতা বাড়ানোর জন্য অক্লান্তভাবে কাজ করছে।”
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, জনাব মোঃ সেলিম উদ্দিন বলেন, “একটি কোম্পানিতে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য কোম্পানি সচিবদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কার্যকর যোগাযোগ ও প্রয়োজন অনুযায়ী স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা উচ্চ পর্যায়ের পেশাদারিত্ব, দক্ষতা এবং আচরণ বজায় রাখেন।“
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, জনাব মোঃ আবদুর রহমান খান এফসিএমএ বর্তমান পরিবর্তনশীল ব্যবসা পরিবেশে সুশাসনের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, “এই অ্যাওয়ার্ড কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক হতে এবং কর্পোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি মানদণ্ড তৈরিতে সহায়তা করছে।”
আইসিএসবি-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান জনাব এম নুরুল আলম এফসিএস অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের স্বাগত জানান। তিনি বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের কর্পোরেট সেক্টরে সুশাসন উৎসাহিত করা এবং একে সমুন্নত রাখা। আমরা সেসব কোম্পানি ও তাদের ব্যবস্থাপনাকে সম্মান জানাই যারা সুশাসনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং বিএসইসি প্রদত্ত কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড, কোম্পানি আইন-১৯৯৪ ও বৈশ্বিক সেরা অনুশীলনসমূহ মেনে চলে।”
আইসিএসবি-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব এ কে এম মুশফিকুর রহমান, এফসিএস কর্পোরেট গভর্নেন্স অ্যাওয়ার্ডের প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতা তুলে ধরেন এবং বিজয়ীদের অভিনন্দন জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এই পুরস্কার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্পোরেট ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর অগ্রগতি অর্জনে অনুপ্রাণিত করবে।
পরিশেষে, আইসিএসবি-এর কাউন্সিল সদস্য জনাব মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ভুঁইয়া এফসিএস আইসিএসবি ইন্সটিটিউটের পক্ষ থেকে উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানান।
অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজন, সরকারি কর্মকর্তা, পেশাজীবী, বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সহ ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দ এবং সাংবাদিকগণ উপস্থিত ছিলেন। অতিথিবৃন্দ বাংলাদেশের কর্পোরেট সেক্টরের গভর্নেন্স প্রতিষ্ঠায় এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতে আইসিএসবি-এর ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন।