ওয়াইফাই-এর উদ্ভাবন যোগাযোগকে সহজ করেছে। ১৯৯০-এর দশকে অস্ট্রেলিয়ার একদল বিজ্ঞানী উদ্ভাবন করেছিলেন ওয়াইফাই, যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে কম্পিউটার, মোবাইল ফোন এবং অন্যান্য ডিভাইসের মধ্যে সংযোগ তৈরি করা সম্ভব হয়। এই বিজ্ঞানী দলের দু’জন সদস্য হলেন জন ও’সালিভান এবং ডেভিড স্কেলার্ন। তাদের নিয়েই ইতিহাসের সাক্ষীর এই পর্ব।
ডেভিড স্কেলার্ন বলছেন, তাদের লক্ষ্য ছিল ইন্টারনেট ব্যবস্থা থেকে সরে আসা। কম্পিউটারের তারগুলো সব কেটে ফেলা।
“সে সময়টা ছিল পোর্টেবল কম্পিউটিং-এর আদিযুগ। নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি ছিল আদিম, বলছেন জন ও’সালিভান, “ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব আসতে তখনও বেশ কয়েক বছর বাকি।”
“তখনও মোবাইল ফোন আবিষ্কৃত হয়নি। অথবা হলেও সেগুলো ছিল খুবই প্রাথমিক স্তরে। শুধুমাত্র কথা বলা যেত,” বলছেন ডেভিড স্কেলার্ন, “কোন ডেটা আদান-প্রদান করা যেত না। সেগুলোর দাম ছিল খুবই বেশি। আর সাইজও ছিল ইটের মত।”
ওয়াইফাই আবিষ্কারের আগে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে চাইলে আপনাকে কেবল এবং টেলিফোন লাইন ব্যবহার করতে হতো। ওয়্যারলেস প্রযুক্তি এর আগেই এসেছিল, কিন্তু তা ছিল খুবই ধীর গতির।
উনিশশো আশি সালের শেষের দিকে ডেভিড স্কেলার্ন হিউলেট প্যাকার্ডে কিছুদিনের জন্য কাজ করতে যান।
সেখানে একটি বিজ্ঞাপন দেখে তিনি মুগ্ধ হন। এই বিজ্ঞাপনে এক তারবিহীন ভবিষ্যতের কথা বলা হয়েছিল।
সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, একটি মনিটর হাতে নিয়ে কিছু লোক বোর্ডরুমে মিটিঙের জন্য ঢুকলেন।
ওয়াইফাই-এর আগে যোগযোগের প্রধান বাহন ছিল কেবল।
হঠাৎ করে স্ক্রিনে দেখা গেল ছবি। যেখানে ইন্টারনেটের গতি খুবই দ্রুত। এবং ডিভাইসে কোন তার লাগানো নেই।
“এটা দেখে আমার মনে হলো এটা তো সত্যি ইন্টারেস্টিং। এরপর এটা নিয়ে আমি ভাবতে শুরু করলাম।”
এরপর থেকে ডেভিড স্কেলার্ন দ্রুতগতির ওয়্যারলেস সংযোগকে বাস্তবে রূপ দিতে কাজ শুরু করলেন।
কিন্তু মোবাইল এবং ওয়্যারলেস যে খুব জরুরি কোন প্রযুক্তি সে সময় একথা সবাই মেনে নিতে রাজি ছিলেন না।
তিনি বলছিলেন, “আমার মনে আছে অনেকেই তখন না করেছিলেন। আমরা বড় বড় কয়েকটি কোম্পানিকে দলে টানতে চাইছিলাম। এই শিল্পের সাথে জড়িত কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাথেও কথা বলেছিলাম।”
“মনে আছে এদেরই একজনের সাথে কথা হয়েছিল। তিনি আমাকে বললেন, আমি বুঝি না যে কেন আমাকে আমার কম্পিউটার নিয়ে ঘোরাফেরা করতে হবে? আমার ডেস্কেই রয়েছে উঁচু গতির ইন্টারনেট। আমি কাজ করি সেখানে। কেন আমাকে মোবাইল হতে হবে? বুঝতেই পারছেন, তিনি ব্যাপারটা ধরতেই পারছিলেন না।”
ওয়াইফাই নিয়ে শিল্প খাতে এই সন্দেহ থাকার পরও অস্ট্রেলিয়ার সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিসরিও এই প্রকল্পে অর্থায়ন করে।
বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মোবাইল ব্যবহারকারী ওয়াইফাই ব্যবহার করেন।
আজকে ওয়াইফাই প্রযুক্তির অনেক পেটেন্ট এই প্রতিষ্ঠানের হাতে। এই প্রকল্পে কাজ করতেন মোট ১০ জন। কিন্তু ভবিষ্যতে ওয়াইফাই প্রযুক্তির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিয়ে তারা কতটা আশাবাদী ছিলেন?
ডেভিড স্কেলার্ন বলছেন, “আমরা একে দেখছিলাম নেটওয়ার্কিং প্রযুক্তির দুনিয়ায় বিশাল একটা পরিবর্তন হিসেবে। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে ভবিষ্যতে এটা সবাই ব্যবহার করবে। আজ আমরা সেটাই দেখছি। কিন্তু ১৯৯০ সালের অস্ট্রেলিয়া থেকে আজকে এই অবস্থায় আসতে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।”
ওয়াইফাই নিয়ে পরীক্ষা চালানোর সময় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল রেডিও সিগনালে নানা রকমের বিঘ্ন।
দ্রুতগতির লোকাল নেটওয়ার্ক তৈরি নিয়ে যে সমস্যা হচ্ছিল তা হলো ঘরের ভেতরে নানা ধরনের জিনিস থেকে রেডিও সিগনাল প্রতিফলিত হচ্ছিল।
ঘরের বাইরে গাড়ি কিংবা দালানে এই সিগনাল ধাক্কা খাচ্ছিল। কিন্তু ঘরের ভেতরে নানা ধরনের কঠিন বস্তু, চকচকে বস্তু থেকে সিগনাল প্রতিফলিত হচ্ছিল।
এর ফলে নানা ধরনের প্রতিফলিত সিগনাল রিসিভারে ধরা পড়ছিল।
কোন একো চেম্বারে ঢুকলে আপনি প্রতিধ্বনির বিষয়টা ভাল বুঝতে পারবেন।
বড় ধরনের খাদের ভেতরে ঢুকে কথা বললে, নিজের গলার স্বরই শোনা যায়। কিন্তু কী বলা হচ্ছে তা হয়তো বুঝতে কষ্ট হতে পারে।
ওয়াইফাই প্রযুক্তি উদ্ভবনের প্রতিযোগিতায় শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরাই বিজয়ী হন।
ওয়্যারলেসের ক্ষেত্রেও এই ব্যাপারটা ঘটতে পারে।
তখন জন ও’সালিভান বুঝতে পারলেন যে রেডিও সিগনালের শক্তি বাড়াতে হবে।
তিনি ব্যাখ্যা করছেন: “এটা অনেকটা কনসার্ট হলের মতো যেখানে প্রতিধ্বনি হয় বেশ জোরে। আপনি যদি একের পর এক শব্দ পাঠাতে থাকেন, তাহলে এক শব্দের সাথে অন্য শব্দের ধাক্কা লাগে। তাই আমরা আরো ধীর গতিতে সিগনাল পাঠাতে শুরু করলাম। অনেকটা মহাসড়কের মতো যেখানে বিভিন্ন লেন দিয়ে অনেকগুলো ট্রাক একসাথে চলছে। ফলে তাদের শক্তি সম্মিলিতভাবে অনেক বেশি।”
এই প্রকল্পের একটা সুবিধেজনক দিক হলো জন ও’সালিভান এবং ডেভিড স্কেলার্ন তাদের কেরিয়ারের শুরুতে এক সময় রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি নিয়ে কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা তারা কাজে লাগিয়েছিলেন।
ডেভিড স্কেলার্ন বলছিলেন, “আমার মনে আছে সিগনালের বিকৃতি কিভাবে রোধ করা যায় তা বোঝার চেষ্টা করতাম। বিভিন্ন পরিবেশে এই সিগনাল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতাম। একাজে নানা ধরনের ট্রান্সমিটার ব্যবহার করতাম।”
“যে যন্ত্রগুলো এক সময়ে আমরা গবেষণাগারে ব্যবহার করতাম, তার আকার ছোট হতে শুরু করলো। এরপর সেগুলো কম্পিউটারের ভেতরে ঢুকে গেল। এরপর সেগুলো আরো ছোট হয়ে এখন স্থান পেয়েছে আপনার মোবাইল ফোনের ভেতরে।”
রেডিও তরঙ্গ সম্প্রচার করতে হলে সরকারি অনুমতি লাগে। ১৯৯৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের সময় প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ঘোষণা করেন যে প্রতিটি স্কুলে তিনি ইন্টারনেটের সংযোগের ব্যবস্থা করবেন।
কিন্তু সেখানে দেখা গেল সমস্যা। ৮০% স্কুলের দেয়ালে অ্যাসবেস্টস ছিল। ফলে তারের লাইন দিয়ে ইন্টারনেট সরবরাহ করতে ঝামেলা হচ্ছিল।
এই সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব দেয়া হয় ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্ট অ্যাল গোরের নেতৃত্বাধীন এক টাস্কফোর্সকে।
নানা ধরনের পরীক্ষার পর বোঝা গেল স্কুলগুলিতে ইন্টারনেট সংযোগ দিতে হলে ওয়্যারলেস প্রযুক্তি অর্থাৎ ওয়াইফাই ছাড়া কোন পথ নেই।
এজন্য মার্কিন সরকার কিছু ফ্রিকোয়েন্সিও বরাদ্দ করেছিল। সেটাই সমস্যা দূর করেছিল।
রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ হওয়ার পর ১৯৯৭ সাল নাগাদ দেখা গেল যুক্তরাষ্ট্রে ওয়্যারলেস প্রযুক্তির একটা বাজার তৈরি হয়েছে।
ডেভিড স্কেলার্ন বলছেন, এতে তারা খুব খুশি হয়েছিলেন। পরিশ্রমের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে প্রায় ছয় মাস পর তারা প্রথম বাণিজ্যিক পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন।
ডেভিড স্কেলার্ন তার সহকর্মীদের সাথে নিয়ে যে প্রাইভেট কোম্পানি খোলেন তার নাম ছিল রেডিয়াটা।
নতুন ওয়্যারলেস প্রযুক্তি নিয়ে কাজ শুরু করেছিল যেসব কোম্পানি, রেডিয়াটা ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। তাদের পরবর্তী কাজ ছিল এমন ওয়াইফাই চিপ তৈরি করা যা মোবাইল ফোনের ভেতরে বসানো যাবে। রেডিয়াটা তার প্রথম চিপ প্রদর্শনী করে ২০০০ সালে।
কিন্তু তারপরও সমস্যা ছিল, বলছিলেন জন ও’সালিভান: “আমরা একটি বড় সেমিকন্ডাকটার নির্মাণকারী কোম্পানির সাথে কথাবার্তা বলছিলাম। আমার মনে আছে তারা আমাদের যা বলেছিল তা ছিল এই রকম: আমাদের মনে হচ্ছে আপনারা সঠিক পথেই এগুচ্ছেন। কিন্তু সত্যি বলতে কি এটা দিয়ে কোন কাজ হবে না।”
“পরের দিন আমরা চিপ এনে পরীক্ষা চালালাম। সেটা ঠিকই কাজ করলো। পরের সপ্তাহে আমরা চলে গেলাম অ্যাটলান্টায়। সেখানে এক সম্মেলনে আমরা আমাদের চিপসগুলি প্রদর্শন করলাম।”
এই ওয়্যারলেস প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য তখন বিশ্বে আরো ২০টি কোম্পানি কাজ করছিল। কিন্তু যে ধরনের সাফল্য বিজ্ঞানীরা অর্জন করেছিলেন সেই ধরনের সাফল্যই কী তারা কামনা করছিলেন?
ডেভিড স্কেলার্ন জানালেন, “অবশ্যই। তেমনটাই আমরা আশা করছিলাম। প্রকল্পটির লক্ষ্যও তাই ছিল। কোটি কোটি মানুষ এক সময় এই প্রযুক্তি ব্যবহার করবে সেটাও আমাদের কাম্য ছিল।”
বাজারে কার্যকর ওয়াইফাই প্রযুক্তি নিয়ে আসার প্রতিযোগিতায় শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার এই বিজ্ঞানীরাই বিজয়ী হন।
ওয়াইফাই প্রযুক্তির ইতিহাস সেই গল্পের কথাই বলে যেখানে সরকারি ব্যয়ে গবেষণার ফলে ব্যাপক বাণিজ্যিক মুনাফার সুযোগ তৈরি হয় এবং তার সুফল ভোগ করেন কোটি কোটি মানুষ।