নাট, বোল্ট ও স্ক্রু। বিভিন্ন শিল্প কারখানায় আসবাবপত্র থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক্স, ইলেকট্রিক্যাল, অটোমোবইলসহ অসংখ্য পণ্য উৎপাদনের অন্যতম কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এসব পণ্য আকারে ছোট হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সংশ্লিষ্ট পণ্যের দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য এগুলো যথেষ্ট মানসম্পন্ন হতে হয়। বাংলাদেশে এই খাতের রয়েছে বিশাল বাজার। আগে যার বেশিরভাগই ছিল আমদানি নির্ভর। তবে ওয়ালটন এখন দেশেই তৈরি করছে বিশ্বমানের নাট, বোল্ট ও স্ক্রু। ফলে, এসব পণ্যের আমদানি নির্ভরতাই শুধু কাটেনি, এ খাতে উল্লেখযোগ্য সফলতাও অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
সূত্রমতে, নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাজারে বিপুল পরিমন নাট, বোল্ট ও স্ক্রু সরবরাহ করেছে ওয়ালটন। এসব পণ্য বিদেশেও রপ্তানির প্রক্রিয়া চলছে। ঢাকার নবাবপুরে রয়েছে এসব প্রকৌশল পণ্যের বিশাল বাজার। এতদিন বেশি দাম দিয়ে বিদেশ থেকে এগুলো আমদানি করতে হতো। এতে একদিকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হতো। আবার পোহাতে হতো নানান ঝঁক্কিও। ওয়ালটন দেশেই উচ্চমানসম্পন্ন নাট বোল্ট ও স্ক্রু তৈরি করায় ব্যবসায়ীরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। ওয়ালটনের তৈরি নাট বোল্ট ও স্ক্রু পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের মাধ্যমে সারা দেশে পৌঁছে দিচ্ছেন তারা।
রাজধানীর জনসন রোডের নিউ নাসির হার্ডওয়্যার স্টোরের সত্ত্বাধিকারী মো. নাসির উদ্দিন জানান, আগে তিনি নাট বোল্ট ও স্ক্রু আমদানি করতেন। এতে সময় বেশি লাগতো এবং খরচও বেশি হতো। আবার আমদানি করা পণ্যের মান নিয়েও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারতেন না। কিন্তু ওয়ালটনের তৈরি এসব প্রকৌশল পণ্যের কোয়ালিটি অনেক ভালো। দেশেই এসব পণ্য উৎপাদন হওয়ায় তিনি সন্তুষ্ট।
ওয়ালটন ইন্ডাস্ট্রিয়াল সলিউশনস বিভাগের প্রধান আব্দুর রউফ জানান, বার্ষিক প্রায় ১৮০০ টন নাট, বোল্ট ও স্ক্রুর উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে ওয়ালটনের। এর মধ্যে ওয়ালটনের নিজস্ব চাহিদা রয়েছে ৩৬০ থেকে ৪০০ টন। এজন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এসব সরবরাহের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এরইমধ্যে বিভিন্ন দেশীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে বিপুল পরিমান নাট, বোল্ট ও স্ক্রু সরবরাহ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বাজারে ওয়ালটনের তৈরি এসব পণ্যের চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। এরই প্রেক্ষিতে বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা অন্তত তিন গুণ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। কারখানায় সংযোজন করা হচ্ছে বিশ্বের লেটেস্ট প্রযুক্তির মেশিনারিজ। বাড়ছে লোকবলও।বেশ কিছু দেশীয় ফার্নিচার,বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল এবং হোম ও কিচেন এ্যাপ্লায়েন্সেস প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালটনের কাছ থেকে নাট বোল্ট ও স্ক্রু নিচ্ছে। তারা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ওয়ালটনের তৈরি পণ্যের মান নিয়েও। এসব পণ্য রপ্তানির বিষয়েও কাজ করছে ওয়ালটন। ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্কসহ বেশ কিছু দেশে রপ্তানির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আলোচনা চলছে আরো কিছু বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
ওয়ালটনের স্ক্রু আরএনডি (গবেষণা ও উন্নয়ন) বিভাগের প্রধান পৃথ্বিশ কুমার সাহা জানান, আন্তর্জাতিক মানের উৎপাদন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তৈরি হচ্ছে ওয়ালটনের নাট, বোল্ট ও স্ক্রু। এসব ইন্ডাস্ট্রিয়াল সলিউশনস উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে ওয়্যার ড্রইং; স্ফের্যো ডাইজিং অ্যানেলিং; পিকলিং, ফসফেটিং অ্যান্ড মেটাল সোপ ট্রিটমেন্ট; কোল্ড ফর্মিং; হিট ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড ইলেকট্রপ্ল্যেটিং ইত্যাদি মেশিনারিজ। মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মান প্রযুক্তির ইক্যুইপমেন্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা হচ্ছে।
তিনি আরো জানান, ওয়ালটন কারখানায় তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন সাইজের ফাসেনার (Fastener- যা দিয়ে বিভিন্ন অংশকে একত্রে আবদ্ধ করা হয়)। এর মধ্যে রয়েছে ২ থেকে ১০ মিলিমিটার ব্যাসের এবং ৫ থেকে ৭৫ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যরে সেলফ ট্যাপিং ও সেলফ ড্রিলিং স্ক্রু, ৮.৮ ও ১০.৯ গ্রেডের হেক্সাগোনাল ও অ্যালেন বোল্ট; মেশিন স্ক্রু এবং হেক্সাগোনাল নাট। স্ক্রু এবং বোল্ট তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে উচ্চ গুণগতমানের বোরন মিশ্রিত ইস্পাত। অন্যদিকে কার্বন ইস্পাত দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে নাট।
জানা গেছে, শতভাগ হিট ট্রিটমেন্টে তৈরি পণ্যের মান যাচাইয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে স্টেরিও মাইক্রোস্কোপ, ম্যাটালার্জিক্যাল মাইক্রোস্কোপ ও মাইক্রো হার্ডনেস যন্ত্র। সূক্ষভাবে এসব ধাতব পণ্যের মান যাচাইয়ে মাইক্রোস্কোপে প্রায় ১ হাজার গুণ বড় করে স্ট্রাকচারাল টেস্ট করা হয়। অন্যদিকে মাইক্রো হার্ডনেস যন্ত্র দিয়ে হার্ডনেস মাপা হয়। কমপক্ষে ৯৬ ঘন্টা সল্ট স্প্রে টেস্টে উত্তীর্ণ ওয়ালটনের নাট-বোল্ট ও স্ক্রু’র মরিচারোধক ক্ষমতা তুলনামূলক অনেক বেশি।
ওয়ালটনের তথ্যমতে, তাদের ফ্রিজ, এলইডি টিভি, এসি, কম্প্রেসর, বিভিন্ন ধরণের ইলেকট্রিক ফ্যান, রাইস কুকার, ব্লেন্ডার, গ্যাস স্টোভ, সুইচ-সকেট, এলইডি লাইট ইত্যাদি পণ্যের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা হচ্ছে নিজস্ব কারখানায় তৈরি নাট, বোল্ট ও স্ক্রু। সংশিষ্টদের অভিমত, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পে আমদানি নির্ভরতার ফলে ব্যাহত হচ্ছে দেশীয় শিল্পোদ্যাক্তাদের প্রয়াস। এ অবস্থায় ওয়ালটন দেশেই আন্তর্জাতিক মানের নাট, বোল্ট ও স্ক্রুর মতো প্রকৌশল পণ্য তৈরি করায় এ খাতে ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যা দেশের শিল্পায়নকে ত্বরান্বিত করবে।