ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে মূল সড়কে রিকশার মতো ধীরগতির যানবাহন চলাচল বন্ধের পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুজন পরিবহনবিশেষজ্ঞ। দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে তাঁরা ঢাকায় চলাচলকারী সব বাসকে একটি কোম্পানির অধীনে নিয়ে আসার কথা বলেছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বুয়েটের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন ও অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান এ পরামর্শ তুলে ধরেন। গত সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এই বৈঠক হয়।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ছাড়াও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সূত্র জানিয়েছে, ঢাকার যানজট পরিস্থিতি কীভাবে উন্নতি করা যায়, সেটা জানতেই বৈঠকটির আয়োজন করা হয়েছিল।
বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঢাকায় যানজটের কারণে বছরে অন্তত ৪০ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হামলার মুখে পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ঢাকায় বেশ কয়েক দিন ট্রাফিক পুলিশ ছিল না। ট্রাফিক সামলেছেন শিক্ষার্থীরা। ১২ আগস্ট থেকে ট্রাফিক পুলিশ রাস্তায় ফেরে। যদিও বেশ কয়েক দিন তাদের সংখ্যা কম ছিল, দায়িত্ব পালনেও নিষ্ক্রিয়তা দেখা গেছে। এই ফাঁকে ঢাকার সব রাস্তায় রিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল শুরু হয়ে যায়। যানবাহনের মধ্যে ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। চলছে ফিটনেসবিহীন যানবাহন, যা আগেও চলত।
এমন পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে স্বল্প মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য ছয়টি প্রস্তাব তুলে ধরেন বুয়েটের দুই অধ্যাপক। তাঁরা জানিয়েছেন ধীরগতির যানবাহন মূল সড়কে চলতে না দেওয়া ছাড়া বাকি প্রস্তাবগুলো হলো—
ট্রাফিক সিগন্যালব্যবস্থা চালু করা। দুই বিশেষজ্ঞ বলেছেন, বুয়েট প্রাথমিকভাবে সাধারণ মানের সিগনালব্যবস্থা তৈরি করে দেবে, যা পরবর্তী সময়ে উন্নয়ন করা হবে।
গণ–অভ্যুত্থানের আগে যেভাবে ট্রাফিক পুলিশ কাজ করত, তারা যেন সেভাবে কাজ শুরু করে, সে জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
শহরের মোড়গুলোর ৫০ থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে বাস, প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ কোনো ধরনের যানবাহন যাতে থামতে না পারে, পার্ক করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করা।
বাস থামার নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া যাত্রী ওঠানামা করতে না দেওয়া। কোনো বাস পাশাপাশি দাঁড়াতে পারবে না, একটার পেছনে আরেকটাকে দাঁড়াতে হবে।
ভ্রাম্যমাণ ট্রাফিক পর্যবেক্ষক দল গঠন করা। নির্দিষ্ট এলাকায় দায়িত্বরত সেই দলে একজন ট্রাফিক পুলিশ ও একজন ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার থাকবেন। তাঁরা নির্দিষ্ট এলাকায় সব সময় চলাচল করবেন। তাঁদের দায়িত্ব হবে রাস্তায় নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটছে কি না, তা দেখা। এখন ট্রাফিক পুলিশ যে দায়িত্ব পালন করে, তা কেউ দেখভাল করে না। তাদেরও নজরদারিতে রাখতে হবে। রাস্তায় অনিয়ম হলে বা বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হলে নিয়ন্ত্রণকক্ষ বা কন্ট্রোল রুমকে জানাতে হবে এবং সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে হবে।
দীর্ঘ মেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টার কাছে দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাবও তুলে ধরেছেন বুয়েট অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন ও হাদিউজ্জামান। তাঁরা বলেছেন, ঢাকায় প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। এর মধ্যে ঢাকা শহরের তিন ভাগের মধ্যে দুই ভাগ এলাকায় অপরিকল্পিত এবং রাস্তাঘাট কম। এ রকম অবস্থায় যাত্রার বেশির ভাগ পূরণ করতে হবে গণপরিবহন দিয়ে। ঢাকার যাতায়াতের ৭০ ভাগ গণপরিবহনের মাধ্যমে করা সম্ভব হলে শহরকে সচল রাখা যাবে।
বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার গণপরিবহনের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর হলো মেট্রোরেল। একটি মেট্রোরেল হয়েছে, আরও দুটি মেট্রোরেল ২০২৭ সালের মধ্যে হওয়ার কথা। বাকি জায়গায় বাস দিয়ে চাহিদা পূরণ করতে হবে। ঢাকা শহরকে ৪০-৫০টি রুটে ভাগ করে বাস চলাচল করানো যেতে পারে। এই তিনটি মেট্রোরেল যে পরিমাণ যাত্রী পরিবহন করবে, তার চেয়ে সাত গুণ বেশি যাত্রী বহন করবে এসব রুটের বাস।
দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাব প্রসঙ্গে অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সরকারকে একটি কোম্পানি গঠন করতে হবে। ঢাকা শহরে এই কোম্পানির বাইরে কোনো বাস চলতে পারবে না। এখন বেসরকারি যেসব বাস রয়েছে, তারা হয় এই কোম্পানির কাছে বাস দিয়ে অংশীজন হবে, নয়তো কোম্পানির কাছে বাস বিক্রি করে দেবে। প্রাথমিকভাবে এসব বাস উন্নত করা হবে। এই কোম্পানির আওতায় চলা সব বাসের মান হবে মেট্রোরেলের বগির মতো। আর এই কোম্পানি সরকারি হলেও ব্যবস্থাপনা হবে বেসরকারিভাবে।
দীর্ঘমেয়াদি আরেকটি প্রস্তাব হলো, বাস চলার জন্য আলাদা লেন থাকবে। বর্তমান যে সড়ক আছে, সেই সড়কে বিভাজক তৈরি করে দেওয়া হবে। বাসের লেনে অন্য কোনো পরিবহন চলতে পারবে না। এক থেকে দেড় মিনিট পরপর বাস চলবে। যে সড়কে যে পরিবহন সবচেয়ে বেশি সেবা দিতে পারবে, তার ভিত্তিতে সেখানে সেটিকে রাখা হবে। সরু সড়ক বা গলির সড়কগুলোয় বাস চলতে পারবে না। সেসব সড়কে রিকশা, অটোরিকশা ও তিন চাকার যানবাহন চলাচল করবে। আর চওড়া বা মূল সড়কগুলোয় বাস চলবে। মানে অলিগলি থেকে ধীরগতির যানবাহনগুলো মানুষকে মূল সড়কে নিয়ে আসবে। আর মূল সড়ক থেকে বাসগুলো সংযুক্ত থাকবে মেট্রোরেলের স্টেশনের সঙ্গে।
অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, তিনটি মেট্রোরেলের পেছনে সরকার খরচ করছে দেড় লাখ কোটি টাকা। তারা যে পরিমাণ যাত্রী পরিবহন করবে, কোম্পানির আওতায় এসব বাস তার চেয়ে সাত গুণ বেশি যাত্রী পরিবহন করবে। তবে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে খরচ হবে ছয় হাজার কোটি টাকার মতো।