মোবাইল ফোনদেশে বৈধভাবে আমদানি হলেও অবৈধ পথে (গ্রে) দেদার আসছে মোবাইল ফোন সেট, এটা পুরনো খবর। নতুন খবর হলো, দেশে এখন দামি মোবাইল ফোন সেট খুলে যন্ত্রাংশ (পার্টস) হিসেবে আনা হচ্ছে। বিমানবন্দরে তা ছাড় করানো হচ্ছে ওজনে তথা ‘কেজি’ হিসেবে। এসব যন্ত্রাংশ সংযোজন করে একেবারে নতুন হিসেবে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতার কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে এই ব্যবসায়ীরা সংশ্লিষ্ট ফোনগুলোর আসল (অরিজিনাল) প্যাকেট আমদানি করছে। দেশে এখন প্রচুর সংখ্যায় দামি মোবাইল ফোন এভাবেই যন্ত্রাংশ হয়ে ঢুকছে, যা বিক্রি হচ্ছে গ্রে মার্কেটে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেবল দামি মোবাইল ফোনগুলোর ক্ষেত্রে এমনটা ঘটছে। তলিকায় সবার ওপরে আছে আইফোন। এরপরের অবস্থানে রয়েছে স্যামসাং। এছাড়া, তালিকায় রয়েছে শাওমি, অপো ও হুয়াওয়ে মোবাইল ফোন সেট। বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমপিআইএ) বলছে, দেশে দামি ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোনের উৎপাদন শুরু হলে এমনিতেই দাম কমে যাবে। তখন হয়তো এভাবে মোবাইল ফোনের প্রবেশও দেশে কমবে, হয়তো থাকবেই না। তখন অবৈধ পথে আসা মোবাইল ফোনের কেনা দামই উঠাতে অনেক কষ্ট হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমপিআইএ) জানাচ্ছে, মাঝে এই পদ্ধতিতে ফোন আসা বন্ধ ছিল। সম্প্রতি তা আবারও চালু হয়েছে এবং দেদার ফোন সেট যন্ত্রাংশ হয়ে আসছে। সংগঠনটির সভাপতি রুহুল আলম আল মাহবুব বলেন, ‘সাধারণত বেশি দামের ফোন সেটগুলো এভাবে আসছে।’ কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমেও আসছে। দেশে আনা হচ্ছে কেজি দরে। দেশের তালিকায় রয়েছে হংকং ও তাইওয়ান।’ চীন থেকেও কিছু কিছু আসছে বলে জানান তিনি ।
রুহুল আলম আল মাহবুব বলেন, ‘দামি ফোনগুলো সাধারণত এভাবে আনা হয়। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর পার্টিকে দিলে তারা ফোনসেট খুলে প্রতিটা পার্টস আলাদা আলাদা করে খুচরা যন্ত্রাংশ হিসেবে নিয়ে আসে। দেশে আসার পরে এগুলো বিভিন্ন মার্কেট, বাসাবাড়িতে সংযোজন করা হয়।’
তিনি উল্লেখ করেন, ফোন সেট যন্ত্রাংশ হিসেবে আনা হলেও ফোনের আসল (অরিজিনাল) প্যাকেটগুলো আলাদা করে নিয়ে আসা হয়। কারণ, আসল প্যাকেট এখানে তৈরি করা সম্ভব নয়। নিঁখুত করা যায় না। কপি প্যাকেট দেখলেই বোঝা যায়। যেহেতু এগুলো বেশি দামের ফোন হয়ে থাকে, ফলে এর ক্রেতারাও খুবই সচেতন। এর ফলে ব্যবসায়ীরা আলাদা করে প্যাকেট নিয়ে আসছে দেশে। আগামী জুন মাস নাগাদ দেশে মোবাইল ফোন সেট পুরোপুরিভাবে উৎপাদন শুরু হতে পারে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
মাহবুব জানান, ৯৯ ভাগ আইফোন দেশে গ্রে পথে আসে। এর মধ্যে ৪০ ভাগ আসে যন্ত্রাংশ হিসেবে। স্যামসাংয়ের ৪০ শতাংশ ফোন আসে গ্রে পথে। এর মধ্যে ২০ শতাংশ আসে যন্ত্রাংশ হিসেবে। তবে এসব ফোনে ওয়ারেন্টি পাওয়া যায় না। তফাৎ কেবল এটুকুই। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘একটি ৫০ হাজার টাকা দামের ফোন আমদানি করলে খরচ (শুল্ক ও অন্যান্য চার্জসহ) পড়ে ১৫ হাজার টাকার মতো। মুনাফা যোগ করে বিক্রি করতে গেলে দাম ধরতে হয় কমপক্ষে ৭০-৭৫ হাজার টাকা। আর যন্ত্রাংশ হিসেবে আসা একই ফোন বাজারে কেনা যাবে ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকায়। ফলে বৈধ আমদানিকারক হয়েও আমরা বাজারে টিকতে পারছি না।
গত বছর দেশে এক লাখের বেশি আইফোন এলেও বৈধ পথে এসেছে মাত্র পাঁচ হাজার ৫৪৪টি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জানা যায়, দেশে প্রতি বছর অবৈধ পথে আসছে ৫০ লাখের বেশি মোবাইল ফোন। মোবাইল ফোন আমদানিকারকদের সূত্রে জানা যায়, ফিচার ফোনের জায়গা দখল করে নিচ্ছে স্মার্টফোন। বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ মোবাইল ফোন আমদানি হয়, তার প্রায় ২৫-৩০ ভাগ স্মার্টফোন। আর এই স্মার্টফোনের বেশিরভাগই আসে অবৈধ পথে (হাতে হাতে, লাগেজ ইত্যাদি মাধ্যমে)। এসব মাধ্যমে আসা স্মার্টফোনই বিক্রি হয় গ্রে মার্কেটে।
বিএমপিআইএ বলছে, দেশে মোবাইল ফোনের বাজার আট হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে ২৫ শতাংশের বেশি অবৈধভাবে আসা মোবাইল ফোনের দখলে। এই গ্রে মার্কেটের আকার দুই হাজার কোটি টাকার। এই মার্কেট দিন দিন বড় হচ্ছে। এজন্য অবৈধ পথে ফোন আনার জন্য অসাধু ব্যবসায়ীরা নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে মোবাইল ফোন দেশে আনছে।
প্রসঙ্গত, এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে দেশে এসেছে তিন কোটি ৪০ লাখ মোবাইল ফোন। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল প্রায় তিন কোটি। ২০১৫ সালে এসেছিল দুই কোটি ৬০ লাখ হ্যান্ডসেট।
শাওমি মোবাইল ফোনের বড় একটা অংশ এভাবে দেশের বাজারে ঢুকছে বলে আমদানিকারক সূত্রে জানা গেছে। দেশে আসা মোট শাওমি ফোনের ৫৫-৬০ ভাগ আসছে গ্রে পথে, যার বড় একটি অংশ আসছে যন্ত্রাংশ হয়ে। সূত্র জানায়, একই ফোন, একই প্যাকেট, কিন্তু ফোনটি শাওমির বৈধ চ্যানেল দিয়ে আসেনি।
শাওমি বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী দেওয়ান কানন বলেন, ‘আমরা দেখেছি প্রতি মাসে শাওমিরই অন্তত পাঁচ হাজার প্যাকেট দেশে আসছে। কাস্টমসের উচিত এগুলো আটকে দেওয়া। তাদের জানতে চাওয়া উচিত, খালি প্যাকেট দিয়ে আমদানিকারকরা কী করে।’
তিনি জানান, এ দেশে অনেক মোবাইল ফোন মেরামতকারী রয়েছেন, যারা মোবাইল মেরামতের কথা বলে, খুচরা যন্ত্রাংশ দেখিয়ে কেজি দরে দেশে নিয়ে আসেন। যন্ত্রাংশগুলো রাখার কথা বলে প্যাকেট নিয়ে আসেন। পরে এখানে সেগুলো সংযোজন করে নতুন মোবাইল ফোন হিসেবে বিক্রি করে। তিনি আরও জানান, শাওমির ১০-২০ হাজার টাকা দামের সেটগুলো এভাবেই বেশি আসছে। তার হাতে প্রমাণ আছে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি জানান, যন্ত্রাংশ সংযোজন করার সময় আসল পার্টস রেখে অনেক সময় পুরনো পার্টস জুড়ে দেওয়া হয়। ফলে মোবাইলের সক্ষমতা নতুনের মতো হয় না। কয়েকদিন ব্যবহারেই অকার্যকর হয়ে পড়ে। আর বদনাম হয় ব্র্যান্ডের। সেই বদনাম বয়ে বেড়াতে হয় আমাকে।
হুয়াওয়ের মোবাইলফোন সেট গ্রে পথে আসে এটা সংশ্লিষ্টরাও জানেন। এই ফোন সেট বাজারে তাদের মোট বিক্রির পরিমাণে প্রভাবও ফেলছে। হুয়াওয়ে কয়েকটি মডেলের সেট বাংলাদেশে না আনলেও ঠিকই সেগুলো বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায়, ৮৩ হাজার টাকা দামের সেট বাজারে ৬৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বৈধপথে ফোনসেট এলে এই দামে বিক্রি করা সম্ভব নয় বলে হুয়াওয়ের বাংলাদেশ অফিসের এক কর্মকর্তা জানান। গ্রে পথে হাতে হাতে মোবাইল ফোন সেট এলেও যন্ত্রাংশ হিসেবেও কিন্তু আসছে। টার্গেট ওই দামি মোবাইল সেট। তবে হুয়াওয়ে কর্তৃপক্ষ জানান, তাদের কাছে এ বিষয়ে অকাট্য কোনও প্রমাণ নেই। অথচ বাজারে গুজব রয়েছে, কয়েকটি মোবাইল ফোনসেট দেশে যন্ত্রাংশের মতো করে আসে, তার মধ্যে হুয়াওয়ে একটি।
প্রতিবেদনটির লেখক: হিটলার এ. হালিম। এটি বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত হয়।