ইভেন্ট

‘মিলিয়ে গেছে’ ১১৬টি পাঁচতলা ভবন নির্মাণের টাকা!

By Baadshah

October 02, 2019

>> দ্বিতীয় সংশোধনীর মোট ব্যয় ৪৮৪০ কোটি ২৮ লাখ, ১৩৯ ভবন নির্মাণ >> প্রথম সংশোধনীর চেয়ে দ্বিতীয়তে ব্যয় বেশি ২৬৩৬ কোটি ৮ লাখ টাকা >> তৃতীয় সংশোধনীতে ধরা হয়েছে ৪৮২৬ কোটি ১৬ লাখ, বাদ ১১৯ ভবন >> ১১৯টি বাদ পড়লেও ঢুকবে ৫০টি ভবন, তবে তা ‘সুনির্দিষ্ট করা হয়নি’

প্রকল্পটির তৃতীয় সংশোধনীও আনা হয়েছে। সংশোধনীতে সেই ১৩৯টির মধ্যে ১১৯টি ভবন আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। বাকি ২০টি পাঁচতলা ভবন এ প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হবে। ২০টি ভবনের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১০৯ কোটি ৭৩ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। এ হিসাবে প্রতিটি ভবনের জন্য খরচ ধরা হয়েছে পাঁচ কোটি ৪৮ লাখ ৬৯ হাজার ৯০০ টাকা।

তৃতীয় সংশোধনীতে প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে চার হাজার ৮২৬ কোটি ১৬ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। আড়াই হাজার কোটির বেশি টাকা বাড়তি ধরে দ্বিতীয় সংশোধনের চেয়ে তৃতীয় সংশোধনীতে টাকা কমেছে মাত্র ১৪ কোটি ১১ লাখ ৭৭ হাজার। অথচ ১১৯টি ভবন বাদ দেয়ার কারণে অন্ততপক্ষে ৬৫২ কোটি ৯৫ লাখ ১৮ হাজার ১০০ টাকা (প্রতিটি ভবন পাঁচ কোটি ৪৮ লাখ ৬৯ হাজার ৯০০ টাকা মূল্যে) কমার কথা ছিল, কিন্তু তা কমেনি। কমেছে মাত্র ১৪ কোটি ১১ লাখ ৭৭ হাজার টাকা, যা তিনটি ভবন নির্মাণের বরাদ্দের চেয়ে কম।

অর্থাৎ তৃতীয় সংশোধনী থেকে ১১৯টি ভবনের খরচ কমার কথা থাকলেও কমেছে মাত্র তিনটি ভবনের মূল্য। বাকি ১১৬টি ভবনের প্রায় ৬৩৬ কোটি ৪৯ লাখ ৮ হাজার ৪০০ টাকা যেন ‘মিলিয়ে গেছে বা হাওয়া হয়ে গেছে’!

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের পরিচালক মো. মাহবুব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ প্রকল্প থেকে ১১৯টি ভবন বাদ যাওয়ার ফলে যে পরিমাণ টাকা কমার কথা, ওই পরিমাণ কমেনি। কারণ, এ প্রকল্পে আরও ৫০টি নতুন ভবন ঢুকবে।

‘তবে কোন কোন ভবন ঢুকবে, তা সুনির্দিষ্ট হয়নি’ বলেও জানান তিনি। মাহবুব হোসেন বলেন, ‘জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) প্রস্তাব দিলে আমরা পরিদর্শন করে দেখব, যেখানে করার মতো সেখানে করব। যেমন ধরেন, উপকূলীয় অঞ্চল মহেশখালী, কুতুবদিয়া – উপকূলের খাসজমিতে ভবন হতে পারে। আবার সিলেট সদরে খাসজমি আছে, সেখানে ভবন হবে। এগুলো সুনির্দিষ্ট না হলেও উপকূলীয় ও উপকূলীয় নয় – এভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের আওতায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, এলজিইডি, সমবায় অধিদফতর, যুব উন্নয়ন অধিদফতর, গণপূর্ত অধিদফতর, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, সমাজকল্যাণ অধিদফতর, বন অধিদফতর, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও ইউনিয়ন পরিষদ।

কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দরে উন্নীত করতে সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে কক্সবাজারের খুরুশকুল মৌজায় পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১১৯টি পাঁচতলা আবাসিক ভবন ও আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণে আলাদা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

কোথায় গেল এত টাকা?

আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনীর চেয়ে তৃতীয় সংশোধনীর টাকার পরিমাণ কম মাত্র ১৪ কোটি ১১ লাখ ৭৭ হাজার। তাহলে তৃতীয় সংশোধনী থেকে বাদ পড়া ১১৯টি ভবনের জন্য বরাদ্দ থাকা প্রায় ৬৫২ কোটি ৯৫ লাখ ১৮ হাজার ১০০ টাকা গেল কোথায়, এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প মূল্যায়ন সভা (পিইসি) সূত্রে জানা যায়, এ প্রকল্পে মোট ৯২টি ব্যয়ের খাত দেখানো হয়েছে। পিইসি সভায় এ ব্যয়ের খাতগুলোতে একটি মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়। পিইসি সভা ৯২টি খাতে যে ব্যয় নির্ধারণ করেছে, তার চেয়ে ৬৫টি খাতে বাড়তি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

পিইসি সভা সূত্রে আরও জানা যায়, পিইসির সুপারিশের চেয়ে কর্মকর্তাদের বেতন ৬৫ লাখ, ভাতা ৫৭ লাখ ৫ হাজার, প্রশাসনিক ব্যয় ১০ কোটি ৮৩ লাখ ৯৩ হাজার, সংরক্ষণ ও মেরামত ৫৭ লাখ ৭৭ হাজার, মূলধন ব্যয় ৪২৬ কোটি ৩০ লাখ ৪৯ হাজার, ফিজিক্যাল কন্টিনজেন্সিতে ৬৪ কোটি ৫৪ লাখ ২১ হাজার বাড়তি এবং প্রাইস কন্টিজেন্সিতে তিন কোটি ৬৫ লাখ ৫২ হাজার টাকা কম ধরা হয়েছে।

সার্বিকভাবে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় পিইসি সভার সুপারিশের চেয়ে ৪৯৯ কোটি ৮৩ লাখ ৩৮ হাজার টাকা বাড়তি অনুমোদন নিয়েছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। অর্থাৎ এ বাড়তি মূল্যের মাঝেই মূলত ১১৯টি ভবনের টাকার বড় একটি অংশ ঢুকিয়ে দেয়া (মিলিয়ে বা মিশিয়ে দেয়া) হয়েছে।

পিইসির সুপারিশ ৪ লাখ, অনুমোদন ২৪৬ কোটি!

গত একনেক সভায় প্রকল্পের সংশোধনীর কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, আশ্রয়ণ-১ থেকে ১১৯টি ভবন বাদ দেয়ার পাশাপাশি পিডব্লিউডি, এলজিইডি ও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সর্বশেষ রেড শিডিউলের কারণে প্রকল্পের অবশিষ্ট নির্মাণকাজের ব্যয় বৃদ্ধি এবং প্রকল্পের মেয়াদ তিন বছর বৃদ্ধির কারণে প্রকল্প পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধির জন্য তৃতীয় সংশোধনী আনা হয়েছে।

পিডব্লিউডি, এলজিইডি ও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সর্বশেষ রেড শিডিউলের পাশাপাশি অধিকাংশ খাতে ব্যয় বৃদ্ধির চিত্র উপরে দেখা গেছে।

সেই সঙ্গে কিছু খাতে অস্বাভাবিকতাও দেখা মিলেছে। যেমন- মূলধন ব্যয়ে ৩৪টি খাত রয়েছে। এর মধ্যে ২৬টি খাতে কতটি ব্যারাক, ঘর, কক্ষ বা সংখ্যা/পরিমাণ উল্লেখ করা আছে। কতগুলো ঘরের বিপরীতে কত টাকা খরচ করা হবে, তাও উল্লেখ আছে। যেমন- উপকূলীয় ও সাইক্লোন প্রভাবিত এলাকায় তিন হাজার ৯৫০টি পাকা ব্যারাক নির্মাণ করা হবে, এতে ব্যয় হবে ৫৪৯ কোটি ৪৭ লাখ ৮ হাজার টাকা। আবার নিজ জমিতে ৭৪০টি সেমি-পাকা কক্ষ নির্মাণের জন্য ৭৫ কোটি ৪৪ লাখ ৭৯ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। মূলধন ব্যয়ের প্রতিটি খাতে এ রকম সুনির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখ করা আছে এবং তার জন্য খরচও নির্ধারণ করা আছে।

তবে মূলধন ব্যয়ের আটটি খাতে কতটি ভবন, ব্যারাক বা সংখ্যা/পরিমাণ উল্লেখ নেই। এ দুই খাতেই মূলত টাকার বড় অংশ খরচ দেখানো হয়েছে।

খাত দুটির মধ্যে একটি হলো উপকূলীয় ও সাইক্লোনপ্রবণ এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণ (বিভাগীয় সদর/জেলা/উপজেলা/পৌরসভা ইত্যাদি)। কতগুলো বহুতল ভবন নির্মাণ হবে, সেটি উল্লেখ করা হয়নি। এ খাতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পিইসি সভার সুপারিশ ছিল চার লাখ ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দের। পিইসি সভার সুপারিশ না মেনে এ খাতে ব্যয় করার জন্য ২৪৬ কোটি ৭৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকার অনুমোদন নিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ।

অন্য খাতটি হলো আশ্রয়ণ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত ছোট রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট, গাইডওয়াল, স্লোপ প্রোটেকশন ওয়াল, সিসি ব্লক স্থাপন এবং এইচবিবি/ব্রিকফ্লাটসলিং রাস্তা নির্মাণ। এ খাতেও সুনির্দিষ্টভাবে কতগুলো ব্রিজ, কত কিলোমিটার রাস্তা করা হবে, তা উল্লেখ করা হয়নি।

পিইসি সভায় এ খাতে ২১ কোটি ৬৩ লাখ ৮৬ হাজার টাকা বরাদ্দের সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু সভার সুপারিশ না মেনে তারা ৩৬ কোটি ৮৫ লাখ ৩৬ হাজার টাকা অনুমোদন নিয়েছে।

২০১০ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া এ প্রকল্প এখনও চলমান। এ বিষয়ে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের পরিচালক মাহবুব হোসেন বলেন, ‘এ প্রকল্পের কাজ চলছে সারাদেশ ধরে। ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন– এসব কারণে প্রতি বছরই মানুষ ভূমিহীন, গৃহহীন হয়। তাদের ঘর প্রদান করতে হয়। এজন্য এ প্রকল্প প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এ কারণেই মূলত সংশোধনী।