এডিটরের বাছাই

প্রযুক্তি আমাদের জন্য আশীর্বাদ না অভিশাপ?

By Baadshah

April 02, 2018

আজকাল আমরা মা-বাবার থেকে অনেক দূরে অবস্থান করেও তাদের কাছে চিঠিপত্র লিখি না। এমনকি মা-বাবাও চিঠিপত্র লেখে না। দাদীর মুখে শোনা কথা, একদা চিঠি পড়তে গিয়ে নাকি চোখে জল জমে যেত। সবাই অতি যত্ন করে চিঠিটা বাক্সে তুলে রাখত। দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখত। ডাকপিয়নের অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকত। বুঝতেই পারছেন, এখন আর এমনটা কেউ করে না। কেউ আর পোস্ট অফিসে গিয়ে খোঁজ নেয় না যে আমার কোনো চিঠিপত্র আসছে কিনা। পোষ্ট অফিস তো এখন অচল। আমি ২০১২ সাল হতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পোষ্ট অফিসে আসা যাওয়া করেছি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি পাঠাতাম। পত্রিকা, ম্যাগাজিন, বই আসত। দেখা যেত, আমিই একমাত্র প্রেরক ও প্রাপক ছিলাম। এখন আর পোষ্ট অফিস ব্যবহার করি না। কারণ প্রযুক্তির কল্যাণে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক সহজ ও দ্রুততর হয়ে গেছে। চিঠির বিকল্প মেইল সেবা এসেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ এখন অতি সহজ। শুধু তাই নয় দেশের বাইরে অবস্থানরত স্বজনদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করাও সহজ। ছোট্ট কিন্তু কার্যকরী যন্ত্র মোবাইলের জন্য পৃথিবীতে যোগাযোগ ব্যবস্থার এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। সেই সাথে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ব্যবহার মানুষের জীবনকে আরো গতিময় করেছে। এখন আর দূরে থাকলেও অভিভাবকদের গাঢ় চিন্তায় নিমজ্জিত থাকতে হয় না। সহজলভ্য মোবাইলের বদৌলতে চিন্তা-ভাবনা অনেক কমেছে। সহজেই অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। ভিডিও কলের মাধ্যমের চেহারা দেখা যায়।

বর্তমান সরকার “ডিজিটাল বাংলাদেশ” শিরোনামে শ্লোগান দিয়ে বাঙালী জাতিকে নতুন এক স্বপ্ন দেখিয়েছে। সেই স্বপ্নের ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। আশা করা যাচ্ছে, খুব দ্রুতই এদেশের শিক্ষার্থীসহ জনসাধারণের হাতে মোবাইলের মত স্বল্পমূল্যের ল্যাপটপ শোভা পাবে। সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় আছে। কারণ সবাই পরিবর্তন চায়। উন্নয়নের অংশীদার হতে চায়। আর তাই প্রযুক্তি নির্ভর ও ডিজিটাল দেশ গড়তে, সকল পেশাজীবী মানুষকে এগিয়ে নিতে, প্রযুক্তি নির্ভর প্রজন্ম তৈরী করতে উন্নত বিশ্বের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে এদেশের সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ দ্রুত বাস্তবায়ন হোক এমনটাই প্রত্যাশা করি।

আমি একটি বিষয় লক্ষ্য করে দেখলাম, আজকাল প্রতিটি অভিভাবকই চাচ্ছেন যে তার ছেলেমেয়ে প্রযুক্তির স্পর্শে বেড়ে উঠুক। সবার আগ্রহ এখন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ের উপর। শুধু অভিভাবকগণ নয় সচেতন প্রতিটি শিক্ষার্থীর একই স্বপ্ন, একই প্রত্যাশা। প্রযুক্তির সংস্পর্শে শিক্ষার্থীরাসহ দেশের প্রতিটি মানুষ প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়তে শুরু করে দিয়েছে। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করার অবকাশ নেই। দেশ ও যুগের পরিবর্তন আসবে-এটা সুনিশ্চিত। তবে কতটা পরিবর্তন আসবে, পরিবর্তনটা কেমন হতে পারে, পরিবর্তনটা সুফল-কুফল বয়ে নিয়ে আসবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। সর্বোপরি প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নটা নিছক স্বপ্নই থেকে যাবে। এতে কোনো প্রকার ভুল নেই।

বাংলাদেশে প্রযুক্তির কল্যাণে বর্তমান জীবনযাপনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে। পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছে। এ পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই। তবে সঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছি। কিন্তু আরেকটি বিষয় উপলব্ধি করতে পেরেছি। তাহল, প্রযুক্তির অপব্যবহার পুরো জাতিকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনে প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কয়েকদিন আগেও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে রংপুরে অসাম্প্রদায়িক বর্বরতা ঘটে গেল। যাইহোক, প্রসঙ্গ সেটা নয়। দেখুন, আমাদের দেশে কিছুদিন আগেও সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দটি ছিল- ইভটিজিং। এ নিয়ে মিডিয়া, পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। এখন অবধি হচ্ছে। আমি নিজেই ইভটিজিং নিয়ে অনেক লিখেছি। ইভটিজিং প্রতিরোধ নিয়ে মানববন্ধন হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়েছে। সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। ইভটিজিংয়ের জন্য অসংখ্য প্রাণ অকালে ঝরে পড়েছে। আবার অনেক ঘটনাই লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছে। ইদানিং পত্রিকার পাতা খুললেই নজরে পড়ে মোবাইলে ধারণকৃত নগ্ন ভিডিও চিত্রের খবর। আত্মহত্যা, এসিড সন্ত্রাস, ইভটিজিংসহ নানা অপরাধ ও অপকর্ম এখন মোবাইলে ধারণ করা ভিডিও চিত্র পাওয়া যায়। কম্পিউটারের দোকানে সস্তায় আপলোড করা হয়। এটাকে কি বলে আখ্যায়িত করা যায়? প্রযুক্তিগত সন্ত্রাস? না কি মোবাইলগত সন্ত্রাস?

যাই হোক, এটাকে প্রযুক্তিগত বা মোবাইলগত সন্ত্রাস বলি না কেন এর দ্বারা প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীরা সর্বদা আক্রান্ত হচ্ছে। নারীরা অপমান, অপবাদ, লজ্জা থেকে পরিত্রাণ পেতে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। শুধু এখানেই শেষ নয়। দেশের প্রতিটি জেলায় জেলায় গড়ে ওঠা সাইবার ক্যাফেগুলো আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে সাইবার ক্যাফেতে গেম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা অশ্লীল সাইটগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করে। এসব কারণে যে অসামাজিক কর্মকান্ড যে ঘটছে না, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। ঘটছে এটাই সত্য। এর নমুনা রংপুরের অসাম্প্রদায়িক হামলা। অতঃএব দেখা যাচ্ছে যে প্রযু্ক্তি তথা ইন্টারনেটের মাধ্যমে যেমন পুরো বিশ্বকে সামনে আনা যাচ্ছে, জ্ঞান অর্জন করা যাচ্ছে, তেমনি ব্যবহারকারীদের বিপথগামী করছে।

আমাদের দেশে প্রযুক্তিগত পণ্যগুলো প্রায় সস্তা বললে ভুল হবে না। তবে এই স্বল্পমূল্যে অথবা বিনামূল্যে প্রযুক্তিপণ্য শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিলেই যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূর্ণ হবে, দেশের উন্নতি হবে, ব্যাপক পরিবর্তন আসবে এমনটি ভাবনা করা একদমই ভুল হবে। প্রথমেই আমাদের প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কিভাবে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পরিবর্তন আনা সম্ভব সে বিষয়গুলো প্রকাশসহ সচেতনতা বৃদ্ধিতে সবাইকে আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে। অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ, অপ্রয়োজনীয় সাইটগুলো এখনই বন্ধ করে দিতে হবে। অপব্যবহার রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হতে অশ্লীল ও উস্কানীমুলক ভিডিওগুলো মুছে ফেলতে হবে। এটি আমাদের মেধা মননকে গ্রাস করতে চলেছে। বাংলাদেশে প্রযুক্তি তরুণ প্রজন্মকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছে। কিন্তু অভিভাবক মহলে এ চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। অথচ উন্নত দেশের বয়স্ক ব্যক্তিরা শেষ বয়সে এসেও প্রযুক্তির ব্যবহার শিখতে সময় ব্যয় করছে। আর সেখানে আমাদের দেশে উল্টোচিত্র। সন্তানরা তাদের মা-বাবার কাছে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। তাদের জমানো প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে চায়। প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনি। প্রযুক্তি সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি অভিভাবকের উচিত প্রযুক্তি সম্পর্কিত জ্ঞানার্জন করা। সন্তানকে কম্পিউটার বা ল্যাপটপ কিনে দিলাম, এগিয়ে যাবার সিঁড়ি তৈরী করে দিলাম, এমন ভেবে দায়িত্ব শেষ বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। দায়িত্ব শেষ নয়, বরং শুরু হল। তাদের সঠিক পথ দেখিয়ে দিতে হবে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের পথ বাতলে দিতে হবে, আগ্রহ জন্মাতে হবে। তাছাড়া প্রযুক্তি আশির্বাদ নয় অভিশাপ হয়ে দেখা দেবে। প্রযুক্তি অভিশাপ দূরীকরণে প্রতিটি সচেতন অভিভাবকদেরকে প্রযুক্তির সংস্পর্শে আসতে হবে। সন্তান কি করছে, কোন ওয়েবসাইটে ভিজিট করছে, কম্পিউটারকে বিনোদনের মাধ্যম না জ্ঞানার্জনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করছে, কত সময় ধরে কম্পিউটার ব্যবহার করছে ইত্যাদি বিষয় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। দিনের পর দিন নতুন নতুন ওয়েবসাইট তৈরী হচ্ছে। মেধা খরচ করে তৈরী করা ওয়েবসাইটগুলোতে শিক্ষা, চিকিৎসা, বিজ্ঞান, বিনোদন, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় স্থান পাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে প্রযুক্তি পণ্য স্বল্পমূল্যে বিতরণের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষনীয় ওয়েবসাইটও তৈরী করতে হবে। অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরীর পাশাপাশি কম্পিউটার ল্যাবে রক্ষিত কম্পিউটারের তথ্য ভান্ডার বিখ্যাত বইয়ের ই-বুক দিয়ে ই-বুক লাইব্রেরী গড়ে তুলতে হবে। সরকারী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেবার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণকৃত বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যের ল্যাপটপগুলোতে প্রয়োজনীয় প্রোগ্রামগুলোই দিতে হবে। শিক্ষার্থীরা যাতে ইচ্ছেমত বা অপ্রয়োজনীয় প্রোগ্রাম ইনস্টল করতে বা রিমুভ করতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট কিন্তু পড়াশোনার সাথে সম্পৃক্ত প্রয়োজনীয় সাইটগুলোর ঠিকানা ব্যতীত অন্য কোন সাইটে প্রবেশ করতে যেন না পারে সে বিষয়টিও ভাবতে হবে। প্রকৃত অর্থে এমন নিরাপত্তা বলয় তৈরী করা উচিত যাতে করে শিক্ষার্থীরা পথভ্রষ্ট, অমনোযোগী না হয়, এতে করে শিক্ষাক্ষেত্রে অনেকাংশেই প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব হবে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটমান প্রযুক্তির অপব্যবহার নিয়ে ‍‍‍‍‍”প্রযুক্তি আমাদের জন্য আশির্বাদ না অভিশাপ” এ বিতর্কে না জড়িয়ে প্রযুক্তি দেশ ও জাতির জন্য আশীর্বাদ হয়ে কিভাবে ধরা দিবে, তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সবাই আলোকিত হবে, এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের। প্রযুক্তি প্রকৃত মানবকল্যাণে ব্যবহার হোক।

লেখক: মোহাম্মদ অংকন, কথা সাহিত্যিক ও কলাম লেখক

md.angkon12@gmail.com