ফিচার

ফেসবুক তৈরি ও বদলে গেল যেভাবে

By Sajia Afrin

February 15, 2025

২১ পেরিয়ে ২২ বছরে পড়েছে ফেসবুক। ৪ ফেব্রুয়ারি ২১ বছর পূর্ণ হয়েছে বিশ্বের জনপ্রিয় এ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির। দুই দশকের বেশি সময় আগে মার্ক জাকারবার্গ হার্ভার্ডের ছোট্ট ডরমিটরিতে তৈরি করেছিলেন দ্য ফেসবুক। ডিজিটাল জগতের জন্য এক যুগান্তকারী মুহূর্ত ছিল সেটি। মানুষের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের প্রথম ঢেউ তুলেছিল এটি। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন দুনিয়ায় পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের বিকাশ ঘটিয়ে পরস্পরের মিথস্ক্রিয়া চিরতরে বদলে দিয়েছে ফেসবুক।

২০০৪ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন জাকারবার্গ। ওই সময় তিনি কয়েকজন সহপাঠীকে নিয়ে এমন একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম চালু করেন, যা সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে ওঠে। জাকারবার্গ ও তাঁর বন্ধুদের হাতে তৈরি ওই ফেসবুক এখন এক মহাবিস্ময়।

 

হার্ভার্ডে জাকারবার্গের ঘনিষ্ঠদের মধ্যে ছিলেন কম্পিউটারবিজ্ঞান বিষয়ের ছাত্র অ্যাডওয়ার্ডো সেভারিন, ডাস্টিন মস্কোভিজ ও ক্রিস হিউজ। তাঁরা মিলে শুরু করেন প্রাথমিক কাজ। শুরুতে জাকারবার্গ ও সেভারিন এক হাজার ডলার করে এতে বিনিয়োগ করেছিলেন। এ সময় তাঁদের পরীক্ষামূলক সাইটের নাম ছিল দ্য ফেসবুক। ফেসবুকের সদস্য প্রাথমিকভাবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু পরে সেটা বোস্টন শহরের অন্যান্য কলেজ, আইভি লিগ এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়।

এরপর ধীরে ধীরে বৈধ ই–মেইল থাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, হাইস্কুল এবং ১৩ বছর বা ততোধিক বয়স্কদের জন্য দ্য ফেসবুক উন্মুক্ত করা হয়। ২০০৫ সাল ছিল মূলত দ্য ফেসবুকের মূল ফেসবুক হয়ে ওঠা। এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। ২০০৫ সালের মধ্যে ফেসবুকের সদস্যসংখ্যা ৬০ লাখ অতিক্রম করে এবং দশকের শেষের দিকে ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০ কোটির বেশি।

সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্র হিসেবে তরুণদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে শুরু করে ফেসবুক। এরপর মিসর, সিরিয়া ও তিউনিসিয়ার মতো মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ফেসবুক ‘আরব বসন্ত’খ্যাত গণজোয়ার তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। যা সরকার উত্খাতের মতো বিপ্লব তৈরি করতে যোগাযোগে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।

ফেসবুকের বিবর্তন ফেসবুক চালু হওয়ার পর থেকে প্রথম এক দশকে ব্যবহারকারীর আধেয় ব্যক্তিগত করার সুযোগ দিয়ে ডিজিটাল ও সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে আধিপত্য ধরে রাখে। ফেসবুকে ২০০৬ সালে নিউজ ফিডের মতো ফিচার যুক্ত হয়। এতে ব্যবহারকারী তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দের আধেয় দেখার সুযোগ পেতেন। ফেসবুকে যুক্ত হয় লাইক বাটন। এটিই পরে এ প্ল্যাটফর্মের যোগাযোগে মডেলের একটি মৌলিক দিক হয়ে ওঠে।

২০০৭ সালে ফেসবুকে আরও বেশি বিবর্তন আসে। এ সময় ফেসবুক প্ল্যাটফর্ম থেকে আয় করার সুযোগ তৈরি হয়। এ সময় ফেসবুকে তৃতীয় পক্ষ বা থার্ড পার্টি অ্যাপ্লিকেশন নির্মাতারা যুক্ত হন। এতে ফেসবুক ইকোসিস্টেম দ্রুত বিস্তৃত হয়। হাজারো অ্যাপ ফেসবুক প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয় ও এতে শেয়ার করা হয়।

এরপর ধীরে ধীরে ফেসবুক তাদের প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন ও আর্থিক কৌশলগুলো চালু করতে শুরু করে। এতে ব্যবহারকারীর তথ্য ও আচরণ লক্ষ করে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু হয়। ২০০৭ সালে ফেসবুক অ্যাডস চালু হওয়ার থেকে ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে ফেসবুকের বড় খেলোয়াড় হওয়ার যাত্রা শুরু হয়।

ফেসবুক অনেকটাই কৌশলগতভাবে বিকশিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ব্যবহারকারীরা ফেসবুকের এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। ফেসবুক কৌশলগতভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অধিগ্রহণ করেছে এবং ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে নতুন নতুন ফিচার চালু করেছে। ফেসবুকের গুরুত্বপূর্ণ অধিগ্রহণের মধ্যে ছিল ২০১২ সালে ছবি শেয়ার করার প্ল্যাটফর্ম ইনস্টাগ্রাম ও ২০১৪ সালে বার্তা আদান–প্রদানের প্ল্যাটফর্ম হোয়াটসঅ্যাপ।

ফেসবুকের কেলেঙ্কারি ফেসবুকের কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা–কাণ্ডে তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল প্রযুক্তি ও বিশ্ব রাজনীতি। ২০১৮ সালে ফেসবুকের পক্ষ থেকে স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন ল্যাবরেটরিজ (এসসিএল) এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। ফেসবুকে তথ্য কেলেঙ্কারির কেন্দ্রে ছিল নির্বাচনী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ফেসবুকের তথ্য হাতিয়ে ট্রাম্পের পক্ষে কাজ করার অভিযোগ ওঠে। ফেসবুক থেকে অনৈতিকভাবে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের অভিযোগ উঠেছিল প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।

যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে প্রথম এ বিতর্কের সূচনা হয়। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আমেরিকান নাগরিকদের ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছিল তথ্য বিশ্লেষণ করার প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। এ ক্ষেত্রে ফেসবুকের কোটি কোটি ব্যবহারকারীর প্রোফাইল থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করা হয়েছিল।

ফেসবুকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ডেপুটি জেনারেল কাউন্সেলের এক বিবৃতি অনুসারে, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা তৃতীয় একটি পক্ষের অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহ করেছিল, যা ব্যবহারকারীর তথ্য সুরক্ষার প্ল্যাটফর্মের নীতি লঙ্ঘন করে।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক আলেকজান্ডার কোগানের তৈরি অ্যাপ্লিকেশন ‘দিসইজইয়োরডিজিটাললাইফ’ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল ফেসবুক। এতে ব্যবহারকারীদের তথ্য জোগাড় করার সুযোগ পান ওই অধ্যাপক। ওই অ্যাপ মূলত একটি ব্যক্তিত্ববিষয়ক পরীক্ষা চালাত।

কিন্তু যেসব ফেসবুক ব্যবহারকারী ওই অ্যাপ ডাউনলোড করতেন, তাঁরা আলেকজান্ডার কোগানকে নিজেদের বিভিন্ন তথ্য নেওয়ার অনুমতিও দিতেন। এতে ব্যবহারকারীদের অবস্থান, তাঁদের বন্ধু ও যেসব পোস্টে তাঁরা ‘লাইক’ দিতেন, সে সম্পর্কে জানতে পারতেন মনোবিজ্ঞানের ওই অধ্যাপক।

ওই সময় ফেসবুকের নিয়মনীতির মধ্যেও এ কার্যক্রম অনুমোদিত ছিল। ব্যবহারকারীদের ওই তথ্যাবলি কোগান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কাছে সরবরাহ করেন। ফেসবুকের নীতিমালা লঙ্ঘন করেই এ কাজ করেন তিনি।

২০১৮ সালের ১৭ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমস ও অবজারভারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেসবুকের পাঁচ কোটির বেশি ব্যবহারকারীর তথ্য কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারিতে বেহাত হয়ে যায়। ওই সময় কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ভোটারদের প্রভাবিত করা যাবে, এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চেষ্টা করছিল।

তবে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দাবি, ২০১৫ সালে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাকে ওই সব তথ্য মুছে ফেলতে বলেছিল তারা। তবে নিউইয়র্ক টাইমস ও অবজারভারের তদন্তে উঠে আসে, ফেসবুকের অনুরোধ রেখে তথ্য মুছে ফেলা হয়নি।

২০১৮ সালের পর নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ফেসবুকের তথ্য আরও অনেক প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। এরপর ফেসবুক তাদের তথ্য দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে।

ফেসবুক হলো মেটা ২০২১ সালের অক্টোবরে ফেসবুক তাদের করপোরেট নাম পরিবর্তন করে ‘মেটা’ রাখে। এটা ছিল তাদের রিব্র্যান্ডিং করার প্রচেষ্টা। এর আগে একজন হুইসেলব্লোয়ার ফেসবুকে বৈষম্যসহ নানা বিষয়ে শত শত অভ্যন্তরীণ নথি ফাঁস করে। এ নিয়ে ব্যাপক তদন্তের মধ্যে ফেসবুক বদলে যায়।

২০২২ সালের মার্চে মেটার বিরুদ্ধে ওয়াশিংটন ডিসিতে মামলা হয়। ওয়াশিংটন ডিসি অ্যাটর্নি জেনারেল কার্ল রাসিন ফেসবুকের প্রাইভেসি ও ব্যক্তিগত তথ্যের ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যবহারকারীদের ভুল বোঝানোর অভিযোগ তোলেন।

মেটার নীতি বদল ফেসবুকের বিরুদ্ধে নানা ক্ষেত্রে পক্ষপাত ও আধেয় ফিল্টার না করার অভিযোগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একসময় ফেসবুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন। একসময় ফেসবুকে তাঁর অ্যাকাউন্ট বন্ধ রাখা হয়েছিল। তবে মেটা নীতি বদলেছে।

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ এবং থ্রেডস অ্যাপের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা দীর্ঘদিন ধরে ভুয়া তথ্য মোকাবিলায় তথ্য যাচাইকরণের সঙ্গে জড়িত পেশাদার সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করে আসছে। সম্প্রতি তৃতীয় পক্ষের (থার্ড পার্টি) ফ্যাক্টচেকিং ব্যবস্থা বন্ধ ও কনটেন্ট মডারেশন নীতি শিথিল করার ঘোষণা দিয়েছেন মেটার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ।

অনেকেই মনে করেন ফেসবুকের দিন ফুরিয়েছে। ফেসবুক আর আগের মতো নেই। এ কথা ঠিক ফেসবুক সেই আগের মতো রমরমা আর নেই। তরুণদের জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ফেসবুক তার অবস্থান হারিয়েছে। তবে ডিজিটাল–দুনিয়ায় এখনো মেটার জনপ্রিয়তার ধারেকাছে অন্য কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই।

মেটার মালিকানাধীন ইনস্টাগ্রামের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০১৩ সালে ছিল এক কোটি, এক যুগ পর সেই সংখ্যা ২৪০ কোটির মাইলফলক ছুঁয়েছে। ফেসবুক ব্যবহারকারী ৩০৭ কোটি পার হয়ে গেছে।