ফেসবুক থেকে অনেক তথ্য চুরি হয়েছে জানেন তো? ঠিক চুরি না, একে বাটপারি বলা যেতে পারে। ফেসবুক একটি অ্যাপকে তথ্য সংগ্রহ করতে দিয়েছিল তারা তথ্য না মুছে বেচে দিয়েছে সোজা কথাই এটাই কাহিনী। তবে গোপন ডেটা কেনা বেচার কাহিনী জানা দরকার। ফেসবুকের তথ্য কেলেঙ্কারির কথা ফাঁস হওয়ার পর আওয়াজ উঠেছে ফেসবুক ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়ার। এরই মধ্যে অনেকেই ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। টুইটারে ব্যাপক সাড়া পেয়েছে ‘ডিলিট ফেসবুক’ কর্মসূচি। ২০ মার্চ পর্যন্ত ডিলিট ফেসবুক (#DeleteFacebook) হ্যাশট্যাগটি ৫০ হাজারবারের বেশি টুইটারে ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। তবে এই ধারা যদি জনপ্রিয়তা পায়, তাতেও কি ফেসবুকের কিছু যায়-আসে? ২২০ কোটির বেশি ব্যবহারকারীর এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছেড়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা খুবই নগণ্য বলে মনে করছেন ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ। তবে চিন্তার বিষয় হচ্ছে, ফেসবুকে তথ্য মুছে ফেলা হলেও তা কিন্তু পুরোপুরি মুছে যায় না। বন্ধু বা পরিচিতজনের সুবাদে ফেসবুকে তথ্য থেকেই যাবে। এ ব্যক্তিগত তথ্য নিয়েও তৈরি হচ্ছে শঙ্কা। কীভাবে তথ্য হাতাল কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকা? সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শিবিরের পক্ষে কাজ করা কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকা ফেসবুক ব্যবহারকারী ও তাঁদের বন্ধুদের তথ্যভান্ডারে ঢোকার সুযোগ পেয়েছিল। ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে ভুল বুঝিয়ে গবেষণার নামে তারা এসব তথ্যের নাগাল পায়। তারা দাবি করেছিল, এসব তথ্য শুধু গবেষণার কাজে লাগানো হবে। এতে মানুষের নাম, অবস্থান, লিঙ্গ, তাদের পছন্দ-অপছন্দের তথ্য ছিল। ফেসবুক থেকে বেহাত হওয়া এসব তথ্য কি খুব মূল্যবান ছিল? বিশ্লেষকেরা বলছেন, যে পাঁচ কোটি মানুষের তথ্য বেহাত হয়েছে, তা খুবই মূল্যবান হতে পারে। ফেসবুক যেহেতু ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রি করে না, তাই এসব তথ্য ফেসবুকের কাছ থেকে সহজে পাওয়া কষ্টকর। এ ছাড়া এর মূল্য ঠিক করাও কঠিন। তবে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে এসব তথ্যের অনেক মূল্য। ফেসবুকের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা অ্যালেক্স স্ট্যামোসের তথ্য অনুযায়ী, সফটওয়্যার নির্মাতাদের বিভিন্ন প্রযুক্তিসুবিধা দেয় ফেসবুক। এর মধ্যে একটি জনপ্রিয় টুল হচ্ছে ফেসবুক লগ ইন। এর মাধ্যমে কোনো ওয়েবসাইট বা অ্যাপে ঢুকতে নতুন অ্যাকাউন্ট খোলার পরিবর্তে ফেসবুকের তথ্য-উপাত্ত দিয়েই ঢোকার সুযোগ থাকে। এটি সহজ বলে মানুষ তা ব্যবহার করে। মাত্র দুই-এক ক্লিক বা ট্যাপে এটি ব্যবহার করা যায়, পাসওয়ার্ড ও ইউজারনেম মনে রাখার ঝামেলা করতে হয় না। মানুষ যখন ফেসবুক লগ ইন ব্যবহার করে, তখন অ্যাপ নির্মাতাদের ফেসবুক প্রোফাইলসহ ই-মেইল, বন্ধুতালিকা, অবস্থানগত তথ্য ব্যবহারের অনুমতি দেয়। ২০১৫ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলেকজান্ডার কোগানের তৈরি ‘দিস ইজ ইয়োর ডিজিটাল লাইফ’ অ্যাপের একই ঘটনা ঘটে। এতে ফেসবুকের লগ ইন-সুবিধা ব্যবহার করা হয়। ২ লাখ ৭০ হাজার ব্যবহারকারী ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে সহজে ‘দিস ইজ ইয়োর ডিজিটাল লাইফ’ অ্যাপে অ্যাকাউন্ট খোলেন এবং কোগানের সঙ্গে ব্যক্তিগত তথ্য ভাগাভাগি করেন। ওই সময় ফেসবুক লগ ইন ব্যবহারকারী অ্যাপ নির্মাতাদের ফেসবুক ব্যবহারকারীর বন্ধুদের কিছু তথ্য সংগ্রহ করার অনুমতি দেওয়া হতো। অর্থাৎ তখন ফেসবুক ব্যবহারকারীরা তাঁদের তথ্য দিতে সম্মত হলে, তাঁদের বন্ধুদের তথ্যও পেয়ে যেত অ্যাপ নির্মাতারা। কিন্তু পরে এ সুযোগ বন্ধ করেছে ফেসবুক। ওই ২ লাখ ৭০ হাজার ব্যবহারকারীর তথ্য কাজে লাগিয়ে পাঁচ কোটি ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহ করেছেন কোগান। কোগানের প্রতিষ্ঠা করা গ্লোবাল সায়েন্স রিসার্চ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে এসব তথ্য ছিল। এসব তথ্য গ্লোবাল সায়েন্স রিসার্চের কাছ থেকে কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকার হাতে গেলে তখন থেকেই সমস্যার শুরু। ফেসবুক দাবি করে, ডেভেলপাররা ফেসবুকের তথ্য কোনো বিজ্ঞাপন নেটওয়ার্কসহ অর্থ আয়ে ব্যবহার করা হয়, এমন কোনো প্রতিষ্ঠানে দিতে পারবে না। এটা তাদের নিয়মবিরোধী। স্ট্যামোস অভিযোগ করেন, কোগান তথ্যের অপব্যবহার করেছেন। ফেসবুকের কোনো সিস্টেম বা কারিগরি নিয়ন্ত্রণ ভেঙে তথ্য নিতে পারেননি। জাকারবার্গ একে ‘বিশ্বাস ভঙ্গ’ করার ঘটনা বলেছেন। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকাকে তথ্য মুছে ফেলতে বলেছিল। কিন্তু তারা তা মুছে ফেলেনি। কেমব্রিজ অ্যানলাইটিকা বলছে, তারা ফেসবুকের নিয়মনীতি মেনেই কাজ করেছে। যা আইনগতভাবে করা যায়, তা-ই করেছে এবং ফেসবুকের অনুরোধে যেসব তথ্য মুছে ফেলার কথা, তা মুছেও ফেলা হয়েছে। কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকা কী? যুক্তরাজ্যভিত্তিক তথ্যবিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান, যার মূল প্রতিষ্ঠান হচ্ছে স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন ল্যাবরেটরিজ। প্রতিষ্ঠানটি রাজনৈতিক পরামর্শক হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য নিয়ে ভোটারদের প্রোফাইল তৈরি করে। এরপর কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে আচরণ বুঝে সে অনুযায়ী বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে। ফেসবুকের অভিযোগ, ব্যবহারকারীর কোনো অনুমতি ছাড়াই কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকার কাছে তথ্য দেন কোগান। ট্রাম্পের নির্বাচনের প্রচারকারীরা কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকাকে ২০১৬ সালের ডেটা অপারেশন চালানোর জন্য নিয়োগ দেয়। ট্রাম্পের প্রধান পরিকল্পনাকারী স্টিভেন ব্যানন কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকা বোর্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট। ফেসবুকের সঙ্গে অ্যানালাইটিকার সম্পর্ক শেষ হলো যেভাবে কোগান ও কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকা তিন বছর আগেই ফেসবুকের সব তথ্য মুছে ফেলার কথা বলেছিল। কিন্তু তারা কথা রাখেনি। নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকা কিছু তথ্য রেখে দিয়েছিল। তারা এ বিষয়ে ফেসবুকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কথা বলেছে। জাকারবার্গের প্রতিশ্রুতি তথ্য বেহাতের ঘটনায় তদন্ত করা, যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া, ভবিষ্যতে সতর্ক থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মার্ক জাকারবার্গ। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের তথ্য সুরক্ষায় এখন থেকে কঠোর জাকারবার্গকে দেখা যাবে-এমন কথাও বলেছেন ফেসবুকের এই সহপ্রতিষ্ঠাতা। ব্যবহারকারীদের করণীয় ফেসবুকের সাম্প্রতিক ঘটনায় ব্যবহারকারীদের কিছু করার নেই। কারণ, ফেসবুক ও কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকার পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। প্রাইভেসি সেটিংস পরীক্ষা করে দেখতে পারেন তথ্য বেহাত হওয়ার মতো কোনো কিছু ঘটেছে কি না।