দেশ

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে চড়ে বাংলাদেশের মহাকাশ যাত্রা (ভিডিও)

By Baadshah

May 12, 2018

সেই স্বপ্ন হলো সত্যি। মহাকাশের অজানার পানে বাংলাদেশের একটি স্যাটেলাইট ছুটবে—লাল-সবুজের বাংলাদেশ এই স্বপ্নে বিভোর ছিল অনেক দিন থেকে। অবশেষে মহাকাশে ডানা মেললো বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। স্থানীয় সময় শুক্রবার বিকাল ৪টা ১৪ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের অরল্যান্ডোর কেনেডি স্পেস সেন্টারের কেপ কেনাভেরাল থেকে সম্পূর্ণ নতুন একটি ফ্যালকন-৯ রকেটের মাধ্যমে এটি উৎক্ষেপণ করে মহাকাশ অনুসন্ধান ও মহাকাশ যান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্স।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ উৎক্ষেপণের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। উদ্বোধন ঘোষণার পূর্বে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও রাশিয়াকে ধন্যবাদ জানান। বিশেষ করে কক্ষপথ ভাড়া দেয়ার জন্য রাশিয়ার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মহাকাশে যাত্রার জন্য প্রস্তুতি সেরে রাখা হয়েছিল আগেই। নানা কারণে বেশ কয়েকবার পেছানোর পর গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাত ২টা ১৪ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক হলো।

মাত্র ৩ মিনিটের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ রকেট ফ্যালকন-৯ মহাকাশে পৌঁছে যায় এবং তা নির্ধারিত প্যাডে ফেরত আসে। স্পেস এক্স জানিয়েছে, উৎক্ষেপণ সম্পূর্ণ নির্ভুল ছিল। ৩৩ মিনিট পর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত কক্ষপথ ১১৯ দশমিক ১ দ্রাঘিমাংশে অবস্থান নেবে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।

পুরো উৎক্ষেপণ পর্বটি সরাসরি সম্প্রচার করে বাংলাদেশ টেলিভিশন। পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলও উৎক্ষেপণ পর্বটি সরাসরি সম্প্রচার করে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের ইউটিউব চ্যানেলেও উৎক্ষেপণ পর্ব সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। । বিভিন্ন জেলা শহরে বড় পর্দায় সেটা প্রদর্শনেরও ব্যবস্থা করা হয়। শুধু শহর নয়, উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। উৎক্ষেপণের প্রথম ১০ ঘণ্টার মধ্যেই এ মহাকাশ যানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হবে গাজীপুরের ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের। এ ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র থেকেই সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ শুরু হবে তখন থেকেই।

এর আগে বৃহস্পতিবার কারিগরি ত্রুটির কারণে গতকাল স্থগিত হয়ে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ। গত রাতে একাধিকবার সময় পরিবর্তনের পর সব প্রক্রিয়া শেষে শেষ মিনিটের ১৫ সেকেন্ড বাকি থাকার সময় স্পেসএক্সের ক্ষণগননার মেশিন থমকে যায়। অর্থাৎ, রকেটের যাত্রা (স্টার্টআপ মোড) শুরু হওয়ার সময়েই তা বন্ধ হয়ে যায়। স্পেসএক্সের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বৃহস্পতিবার রাতে আর উড়ছে না বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট।

স্যাটেলাইটটি মহাকাশে পাঠানোর কাজ করছে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্স। তাদের ‘ফ্যালকন-৯’ রকেটে করে বঙ্গবন্ধু-১ যাত্রা শুরু করে। এটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে বাংলাদেশের গাজীপুর থেকে। এ জন্য গাজীপুরের জয়দেবপুরে তৈরি করা হয়েছে গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশন। বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হবে রাঙামাটির বেতবুনিয়া গ্রাউন্ড স্টেশন।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবার সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে। দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রা যোগ হবে। স্যাটেলাইটভিত্তিক টেলিভিশন সেবা ডিটিএইচ (ডাইরেক্ট টু হোম) ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজেও এ স্যাটেলাইটকে কাজে লাগানো যাবে।

মহাকাশে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের অবস্থান হবে ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। এই কক্ষপথ থেকে বাংলাদেশ ছাড়াও সার্কভুক্ত সব দেশ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমিনিস্তান ও কাজাখস্তানের কিছু অংশ এই স্যাটেলাইটের আওতায় আসবে।

দেশের প্রথম এ স্যাটেলাইট তৈরিতে খরচ ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার ও বাকি ১ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। এ ঋণ দিয়েছে বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসি। তবে শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা।

স্যাটেলাইট তৈরির এই পুরো কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়িত হয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তত্ত্বাবধানে। তিনটি ধাপে এই কাজ হয়েছে। এগুলো হলো স্যাটেলাইটের মূল কাঠামো তৈরি, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের মূল অবকাঠামো তৈরি করেছে ফ্রান্সের মহাকাশ সংস্থা থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস। স্যাটেলাইট তৈরির কাজ শেষে গত ৩০ মার্চ এটি উৎক্ষেপণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় পাঠানো হয়। সেখানে আরেক মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সের ‘ফ্যালকন-৯’ রকেটে করে স্যাটেলাইটটি মহাকাশে যাত্রা শুরু করে।

কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জানান, “সবকিছু ঠিক থাকায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সফলভাবে কক্ষেপথের দিকে যাত্রা শুরু করেছে।” বাংলাদেশের এই স্বপ্নযাত্রা শুরু হলো কেনেডি স্পেস সেন্টারের সেই ‘৩৯-এ’ লঞ্চ কমপ্লেক্স থেকে, যেখান থেকে ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অ্যাপোলো-১১’ মহাকাশযানটি মানুষকে পৌঁছে দিয়েছিল চাঁদে।

বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ ‘কমিউনিকেশন এবং ব্রডকাস্টিং’ ক্যাটাগরির এ স্যাটেলাইট। অর্থাৎ, এটি যোগাযোগ এবং সম্প্রচার কাজেই মূলত ব্যবহার করা হবে। এ স্যাটেলাইটে থাকছে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার সক্ষমতা। এর মধ্যে ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনে ব্যবহার করবে। আর ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিদেশি রাষ্ট্রের কাছে ভাড়া দেওয়ার জন্য রাখা হবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা আয় করতে সক্ষম হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিবছর অন্যান্য দেশের স্যাটেলাইট পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রায় দেড় কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ ভাড়া হিসেবে পরিশোধ করে। বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালিত হলে এ অর্থ বাংলাদেশেই থেকে যাবে। ফলে বড় অঙ্কের টাকার বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে। দেশের বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর স্যাটেলাইট ভাড়া বাবদ ব্যয়ও কমে আসবে।

এ ছাড়া স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া যাবে উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ। ফলে ব্যান্ডউইথের বিকল্প উৎসও পাওয়া যাবে। এই ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করে দেশের দুর্গম দ্বীপ, নদী ও হাওর এবং পাহাড়ি অঞ্চলে স্যাটেলাইট প্রযুক্তিতে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা চালুও সম্ভব হবে। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে স্বাভাবিক টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও উদ্ধারকর্মীরা স্যাটেলাইট ফোনে যোগাযোগ রেখে দুর্গত এলাকায় কাজ করতে সক্ষম হবেন। মহাকাশ গবেষণার প্রয়োজনে নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহেও ব্যবহার করা যাবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের জন্য রাশিয়ার ইন্টার স্পুটনিক থেকে ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে বরাদ্দ পাওয়া কক্ষপথের ভাড়ার মেয়াদ ১৫ বছর।