ট্রেন্ডিং

বাংলাদেশের শক্তিশালী ঝড়

By Baadshah

November 08, 2019

বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশের দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমেছে। এর মধ্যেও মাত্র এক যুগ আগেই প্রলয়ঙ্করী ‘সিডর’-এর ধ্বংসযজ্ঞ এখনও মানুষের চোখে ভেসে ওঠে। ২০০৭ সালের নভেম্বরের ওই ঝড় ও তার প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারিয়েছিলেন সাড়ে তিন হাজার মানুষ।

এখন আরেক ঝড়ের মুখে পড়ছে বাংলাদেশ, ‘ফণী’ নামে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট এই ঘর্ণিঝড়কে সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড় বলা হচ্ছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ঘণ্টায় ১৭০-১৮০ কিলোমিটার গতির বাতাস নিয়ে শুক্রবার সকালে ভারতের ওড়িষ্যা ঊপকূলে আঘাত হানতে পারে এই ঘূর্ণিঝড়।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক শামসুদ্দিন আহমেদ বলেছেন, শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে সারা রাত ধরে বাংলাদেশ অতিক্রম করবে এ ঝড়। তখন বাতাসের গতিবেগ থাকতে পারে ঘণ্টায় ১০০-১২০ কিলোমিটার।

ঝড়ে প্রাণহানি এড়াতে শুক্রবার সকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে ঊপকূলীয় জেলাগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হবে।

বাংলাদেশ যখন আরেকটি শক্তিশালী ঝড় মোকাবেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেই সময় গত দেড়শ বছরে বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী ঝড়গুলোতে প্রাণহানির চিত্র তুলে ধরা হল-

১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার উপর দিয়ে বয়ে যায় প্রলয়ঙ্করী ‘গ্রেট ভোলা সাইক্লোন’। এই ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২২২ কিলোমিটার।এই ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, ভোলার চর বোরহানুদ্দিনের উত্তর পাশ ও চর তজুমুদ্দিন এবং নোয়াখালীর মাইজদি ও হরিণঘাটার দক্ষিণপাশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঝড়ে প্রাণ হারায় প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষ। চার লাখের মতো বসতভিটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এর আগে ১৮৭৬ সালের ২৯ অক্টোবর বরিশালের বাকেরগঞ্জে মেঘনা নদীর মোহনার কাছ দিয়ে তীব্র ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। এর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটার। এই ঝড়ের প্রভাবে ১২ মিটারের বেশি জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় ঊপকূলীয় এলাকা। চট্টগ্রাম, বরিশাল ও নোয়াখালীর উপকূলে তাণ্ডব চালিয়ে যাওয়া এই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় দুই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।

তারও আগে ১৭৬৭ সালে এই বাকেরগঞ্জেই ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারান ৩০ হাজার মানুষ।

এরপর ১৮২২ সালের জুন মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বরিশাল, হাতিয়া ও নোয়াখালীতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ মারা যান।

১৮৩১ সালে বালেশ্বর-উড়িষ্যা উপকূল ঘেঁষে চলে যাওয়া তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে বরিশাল উপকূলের ২২ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ১৫৮৪ সালে পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী ঘূর্ণিঝড়ে পটুয়াখালী ও বরিশাল জেলার উপকূলের দুই লাখ মানুষ প্রাণ হারান।

১৮৯৭ সালের ২৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম অঞ্চলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়, যাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কুতুবদিয়া দ্বীপ। ঝড়ে প্রাণ হারান পৌনে দুই লাখ মানুষ।

১৯০৯ সালের ১৬ অক্টোবর খুলনা অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারান ৬৯৮ জন।

১৯১৩ সালের অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলায় মৃত্যু হয় ৫০০ জনের। এর চার বছর পর খুলনায় আবারও এক ঘূর্ণিঝড়ে ৪৩২ জন মারা যান।

১৯৪৮ সালে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারান চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলে ১২০০ অধিবাসী। ১৯৫৮ সালে বরিশাল ও নোয়াখালীতে ঝড়ে মৃত্যু হয় ৮৭০ জনের।

১৯৬০ সালে অক্টোবরে ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার গতির প্রবল ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, পটুয়াখালী ও পূর্ব মেঘনা মোহনায়। ঝড়ের প্রভাবে ৪.৫-৬.১ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। এতে মারা পড়েন ঊপকূলের প্রায় ১০ হাজার বাসিন্দা।

পরের বছর ১৯৬১ সালের ৯ মে তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার। প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মানুষ মারা যান এই ঝড়ে।

১৯৬২ সালে ২৬ অক্টোবর ফেনীতে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় হাজারখানেক মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৬৩ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার এবং সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, হাতিয়া ও মহেশখালী উপকূলীয় অঞ্চল। এই ঝড়ে প্রাণ হারান ১১ হাজার ৫২০ জন।

১৯৬৫ সালে মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বারিশাল ও বাকেরগঞ্জে প্রাণ হারান ১৯ হাজার ২৭৯ জন। সে বছর ডিসেম্বরে আরেক ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজারে মৃত্যু হয় ৮৭৩ জনের। পরের বছর অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে সন্দ্বীপ, বাকেরগঞ্জ, খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লায়। এতে মারা যান ৮৫০ জন।

পরে ১৯৭১ সালের নভেম্বরে, ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে, ১৯৭৪ সালের অগাস্টে ও নভেম্বরে, ১৯৭৫ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে উপকূলীয় এলাকায়।

১৯৮৩ সালে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে দুটি ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও নোয়াখালী জেলার উপকূলীয় এলাকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, প্রাণ যায় অনেকের।

১৯৮৫ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয় সন্দ্বীপ, হাতিয়া ও উড়িরচর এলাকা; এই ঝড়ে প্রাণ হারান ঊপকূলের ১১ হাজার ৬৯ জন বাসিন্দা।

১৯৮৮ সালের নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায় যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর এবং বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায়। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬২ কিলোমিটার। এই ঘূর্ণিঝড়ে ৫ হাজার ৭০৮ জন প্রাণ হারান।

১৯৯৪ সালের মে মাসে এবং পরের বছর নভেম্বরে কক্সবাজারে, ১৯৯৭ সালের মে মাসে  চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী ও ভোলা জেলায় ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

১৯৯১ সালের ৩০ এপ্রিল বয়ে যায় আরেক প্রলয়ঙ্করী ঝড়। ভারত মহাসাগরে উৎপত্তি ছিল সেই ঝড়ের, পরে তা ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার গতিবেগ নিয়ে আছড়ে পড়ে চট্টগ্রাম ও বরিশালের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে। প্রায় দেড় লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে ওই ঝড়ে।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে বিধ্বস্ত হয় দেশের দক্ষিণ উপকূল। উত্তর ভারত মহাসাগরে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে সৃষ্ট এ ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ থেকে ৩০৫ কিলোমিটার। এতে তিন হাজরের বেশি মানুষ মারা যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩২টি জেলার ২০ লাখ মানুষ। উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৬ লাখ টন ধান নষ্ট হয়ে যায়। সুন্দরবনের প্রাণীদের পাশাপাশি ব্যাপক গবাদিপশু প্রাণ হারায়।

২০০৯ সালের ২১ মে ভারত মহাসাগরে সৃষ্টি হয় ঘূর্ণিঝড় আইলা, যার অবস্থান ছিল কলকাতা থেকে ৯৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে।চার দিনের মাথায় ২৫ মে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে আঘাত হানে এই ঝড়। এই ঘূর্ণিঝড় ভারতের ১৪৯ জন ও বাংলাদেশের ১৯৩ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে উপকূলে প্রায় ৩ লাখ মানুষ বাস্তুভিটাহারা হয়।

২০০৮ সালের অক্টোবরে ঘণ্টায় ৮৫ কিলোমিটার বেগের বাতাস নিয়ে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় রেশমিতেও প্রাণহানি ঘটে।

২০১৩ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’-এ প্রাণ হারান ১৭ জন। এরপর ২০১৬ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’র আঘাতে মারা যান চট্টগ্রামের ২৬ জন অধিবাসী।