জমজমাট ভাবে শেষ হলো বিপিও সামিট বাংলাদেশ ২০১৮। প্রশ্ন হল এত বড় আয়োজনে কি পেল বাংলাদেশ? উত্তর অনেক কিছু। অনেক সম্ভাবনার কথা জানান দিল বিপিও সামিট। ১৬ এপ্রিল সোমবার সন্ধ্যায় প্যান পাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে সমাপণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। এ সময় তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার কাজ শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে। এর ধারাবহিকতায় বিগত বছরগুলোতে এই পথে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। সামনের দিনগুলোতে আমাদের আরও অনেক কাজ করতে হবে। ২০২১ সালের মধ্যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক মাননীয় উপদেষ্টা ও ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর রূপকার সজীব ওয়াজেদের নেতৃত্বে কাজ করে যাচ্ছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং এর অর্ন্তগত বিভাগসমূহ। তিনি আরও বলেন, দু’দিনব্যপী এই আন্তর্জাতিক সামিটে বাংলাদেশের বিপিও খাতের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে নানা আঙ্গিকে যে সব আলোচনা ও সুপারিশ এসেছে, তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌছে দিতে অনুুরোধ করবো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ‘বিপিও খাতে’র উন্নতিতে সবসময় পাশে থাকবে। সমাপণী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আইসিটি সচিব সুবির কিশোর চৌধুরী। এছাড়া অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ কলসেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের (বাক্য) সভাপতি ওয়াহিদ শরীফ, সাধারণ সম্পাদক তৌহিদ হোসেনসহ আরও অনেকে।
ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুলেশন: চ্যালেঞ্জেস ইন বিপিও: বিপিও সামিটের ১৬ এপ্রিল সোমবার শেষ দিন দুপুর আড়াইটার সময় ব্যালকনি হলে অনুষ্ঠিত হয় ‘ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুলেশন: চ্যালেঞ্জেস ইন বিপিও’ শিরোনামে একটি সেমিনার। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। এ সময় তিনি বলেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) খাতের প্রস্তুত রাখতে হবে। দেশের বেকারত্ব সমস্যা সমাধানেও বিপিও খাত ‘বড় অবদান’ রাখতে পারেও বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। শিল্পমন্ত্রী বলেন, আমরা আশা করছি, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের মাধ্যমে আমরা চতুর্থ বিপ্লবের সুফল ভোগ করতে শুরু করব। সৃজনশীল উদ্ভাবন এবং মেধাসম্পদের লালন ও সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বিপিও খাতে সরকারি- বেসরকারি অংশীদারিত্ব বাড়ানোর পরামর্শও দেন। শিল্পমন্ত্রী আরও বলেন, বিপিও খাতে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের বাজার উদীয়মান অর্থনীতির জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে। বিপিও খাতে আমাদের আয় প্রবৃদ্ধি বছরে শতকরা ১০০ ভাগেরও বেশি। এটি আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। প্রতিবছর লাখো শি¶ার্থী যখন স্নাতক পাশ করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ায়, তখন এই বিপিও খাতে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন শিল্পমন্ত্রী। আমরা যখন আইসিটি খাত থেকে বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের কথা বলছি, তখন আমাদের ভাবতে হবে তরুণদের কথা। আমাদের মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ হল তরুণ, যাদের বয়স ৩৫ বছরের নিচে। এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টদের কাজে লাগাতে পারলে আমরা সময়ের আগেই ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের সেই লক্ষ্য অর্জন করতে পারব। অনুষ্ঠানে বোস্টন কনসালটিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জারিফ মুনিরের পরিচালনায় আলোচনায় অংশ নেন কাজী আইটির প্রধান নির্বাহী মাইকি কাজী, লোজলি কাপলড টেকনোলজির প্রধান নির্বাহী ফিরোজ এম জাহিদুর রহমান, আইবিএম ইন্ডিয়ার কর্মকর্তা আমির শাহুল ও নিপুন মেহরোত্রা, ইন্টিলেনেন্ট গ্লোবাল সার্ভিসের পরিচালক কানওয়ার বি সিংহ।
আউসসোসিং ফর স্টার্ট-আপস: গ্রোয়িং টুগেদার: বিপিও সামিট বাংলাদেশ ২০১৮ এর শেষ দিনে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে বারোটা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় ‘আউসসোসিং ফর স্টার্ট-আপস: গ্রোয়িং টুগেদার’ শিরোনামে দিনের সেমিনার। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে তরুণ উদ্যোক্তাদের বিকাশের জন্য ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে ‘বিপিও হাব’ গড়ে তোলার প্রস্তবনা এসেছে এ সেমিনার থেকে। সেমিনারে এ প্রস্তাবনা দেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কল সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের (বাক্য) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ইমপেল সার্ভিস অ্যান্ড সলিউশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিনুল হক। পরে তাতে সায় দেন অ্যাপভিত্তিক রাইড সার্ভিস পাঠাও ও সেবা’র প্রতিনিধিরাও। সেবা’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক আদনান ইমতিয়াজ হালিম এবং পাঠাও’র প্রধান নির্বাহী হোসেন ইলিয়াস আউটসোর্সিং খাতের জন্য জন্য একটি দ¶ ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য নানা পরামর্শ দিয়ে আমিনুল হক বলেন, প্রথম ৩০ মাস যেকোনো উদ্যোক্তার জন্যই ভীষণ কঠিন সময় যায়। এই সময়ে পেরিয়ে গেলে তারা বুঝে যাবে, তাদের ব্যবসা প্রসারের জন্য আসলে কোন দিকগুলোতে তাদের মনযোগ দেওয়া উচিৎ। তরুণ উদ্যোক্তারা শুরুতে একটি আইডিয়া নিয়ে বসে থাকে, তারা যে বিষয়ে দ¶ সে বিষয়টি নিয়ে পড়ে থাকে। এমন সময় তাদের নজরে পড়ে, আরও অনেক দিকে তাদের দ¶তা অর্জন করতে হবে, তখন তাদের সব মনযোগ ঘুরে যায়। পাঠাও’র প্রধান নির্বাহী হোসেন ইলিয়াস বলেন, তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রশি¶ণ, অর্থ সাহায্য, আইনি সহায়তাসহ নানা তথ্য সহযোগিতা পেতে বিপিওগুলো নিয়ে একটি হাব করা যেতে পারে। আউটসোর্সিং ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে গেলে এখন সেটা বেশি দরকার। আলোচনায় যোগ দিয়ে হাইটেক পার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসনে আরা বেগম বলেন, স্টার্ট আপদের জন্য আউটসোর্সিং ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে আইসিটি ডিভিশন, হাইটে পার্ক বিভিন্ন প্রশি¶ণের পাশাপাশি অর্থ সাহায্যও দিচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ ¶েত্রে দেখা যাচ্ছে, তরুণরা পয়সা নিয়ে কোনো কাজই করছে না। তখন বলতেই হয়, অর্থের অপচয় হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে বাছাই করে তারা কয়েকজনকে হাইটেক পার্ক অর্থায়ন করবে বলেও জানান হোসনে আরা বেগম। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ‘স্টার্ট আপ বাংলাদেশ’ প্রকল্পের উপদেষ্টা টিনা জাবিন অ্যাপস ব্যবহারের ¶েত্রে উদ্যোক্তাদের সতর্ক করে বলেন, অ্যাপসগুলোর ৬৮ শতাংশ পাইরেটেড, এই অ্যাপস ব্যবহার করলে পরে আইনি ঝামেলাতেও পড়তে পারেন তারা।
ক্যাপাসিটি ব্লিডিং ফর কলসেন্টার এজেন্টস: আয়োজনের দ্বিতীয় দিন সকাল সাড়ে ১০টায় মেঘনা হলে অনুষ্ঠিত হয় ‘ক্যাপাসিটি ব্লিডিং ফর কলসেন্টার এজেন্টস’ শিরোনামে একটি কর্মশালা। এ প্রশিক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কণ্ঠশীলনের সাধারণ সম্পাদক জাহীদ রেজা নূর। এ সময় তিনি বিভিন্ন কলসেন্টারে কর্মরত ও কল সেন্টারে কাজ করতে আগ্রহী তরুণদের হাতে কলমে নানা বিষয় প্রশিক্ষণ দেয়। জাহীদ রেজা নূর বলেন, সুন্দর ভাবে কথা বলতে পারা একটি মানুষের অনেক বড় একটি গুণ। বিপিও সেক্টরে ভালো করতে হলে সুন্দর ভাবে কথা দক্ষতা থাকতে হবে।
এছাড়া শেষ দিনে দুপুরে আরও দুটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সুরমা হলে ‘কাস্টমার-সেনট্রিক হেলথকেয়ার ডেলিভারি সিস্টেম অ্যান্ড বিপিও’ এবং মেঘনা হলে ‘রাইস অফ এআই অ্যান্ড দ্যা ইমপ্যাকট অন বিপিও’।
সামিটে ছিলো সরাসরি ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা: বিপিও সামিট বাংলাদেশ ২০১৮ আয়োজনে ভেন্যুতেই সরাসরি ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাক্যের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দুই দিনের এ সামিটে মোট ৪৩২ ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছে। ইন্টারভিউ নেওয়া প্রার্থীদের বিপিও ক্ষেত্রে চাকরির ব্যবস্থা করার জন্য উচ্চতর ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া সামিটে ১১২০ জনের সিভি জমা পরেছে।
১৫ এপ্রিল রোববার সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে’র আওতাধীন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদফতর (উড়ওঈঞ) এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ কলসেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিং (বাক্য) এর আয়োজনে ‘বিপিও সামিট বাংলাদেশ ২০১৮’ এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ।
এবারের আয়োজনে ৬০ জন স্থানীয় স্পীকার, ২০ জন আন্তর্জাতিক স্পীকার অংশগ্রহন করেছে। দুই দিনের মূল্য আয়োজনের আগে ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্টিবেশন কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়। বিপিও সামিট বাংলাদেশ ২০১৮ এর আয়োজনের প্ল্যাটিনাম স্পন্সর অগমেডিক্স, গোল্ড স্পন্সর এডিএন টেলিকম লিমিটেড, সিলভার স্পন্সর অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, ফ্রোরা ব্যাংক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড, সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেড, নেটওয়ার্ক পার্টনার ফাইবার অ্যাট হোম, আইটি পার্টনার আমরা নেটওয়ার্ক লিমিটেড, স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলমেন্ট অথরিটি (বিডা), বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক অথরিটি, এলআইসিটি, একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই), বাংলাদেশ টেলিকমিনিকেশন রেগুলাটরি কমিশন (বিটিআরসি), এক্সপোট প্রমোশন ব্যুারো (ইপিবি), আইসিটি বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল (বিপিসি)। পার্টনার বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস), বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরাম (বিআইজেএফ), বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি (বিসিএস), বাংলাদেশ ওমেন ইন টেকনোলজি (বিডব্লিউআইটি), আইএসপি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি), সিটিও ফোরাম বাংলাদেশ ও ই-কর্মাস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)।