মদরিচ নাকি এমবাপ্পে? কে হচ্ছে সেরা? রাশিয়া বিশ্বকাপ আজ শেষ হচ্ছে। বিশ্ব পাবে নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। সেরা দলটি মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে তুলে ধরবে বিশ্বকাপ ট্রফি। আর বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় জিতবে গোল্ডেন বল। কিন্তু কে জিতবে এবারের গোল্ডেন বল?
বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়কে দেওয়া হয় গোল্ডেন বল। কিন্তু অনেকেই জানেন না সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন করা হয় কিভাবে? প্রথমেই জেনে নিই বিশ্বকাপে টূর্ণামেন্টের সেরা খেলোয়াড় কিভাবে নির্বাচন করা হয়।
বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন প্রক্রিয়া
বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনাল শেষ হওয়ার পর ফিফা ১০ জন খেলোয়াড়ের একটি তালিকা তৈরী করে। ফিফার টেকনিক্যাল কমিটি ও টূর্ণামেন্ট কাভার করা বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকরা সেরা খেলোয়াড় নির্বাচনের জন্য ভোট দেন। উভয় পক্ষের ভোট ৫০% করে বিবেচনা করা হয়। দর্শকরা ও ভক্তরা ভোট দিতে পারেন না।
পুরো প্রক্রিয়াটি কঠোর গোপনীয়তার মাধ্যমে দেখভাল করে ফিফা। বিশ্বকাপ ফাইনাল শেষে পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে সেরা খেলোয়াড়ের নাম ঘোষণা করা হয়। সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত জেতেন গোল্ডেন বল। ২য় ও ৩য় সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া খেলোয়াড় জেতেন সিলভার ও ব্রোঞ্জ বল।
রাশিয়া বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল
এবারের বিশ্বকাপের শুরুতে রাশিয়া বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল জিতবে বলে যে সম্ভাব্য নামগুলো উচ্চারিত হয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মেসি, রোনালদো, নেইমার, কৌতিনহো, ইনিয়েস্তা, ইস্কো, টনি ক্রুসদের মতো তারকাদের নাম। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এই নামগুলো এখন বিশ্বকাপের দর্শক।
বিশ্বকাপ মঞ্চ হতে তারকা খসে পড়ে যাওয়ার পর, এখন প্রশ্ন এটাই যে কে জিতবে রাশিয়া বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুট। চলুন জেনে নিই রাশিয়া বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড়ের মুকুট অর্জণ করতে পারেন এমন সম্ভাব্য কয়েকটি নাম।
কিলিয়ান এমবাপ্পে (ফ্রান্স)
তারকাবহুল ফ্রান্স দলে নিজেকে আলাদা করে চিনিয়েছেন এমবাপ্পে। মাত্র ২০ ছুঁই ছুঁই এমবাপ্পে ফ্রান্স দলের আক্রমণভাগের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বিশ্বকাপে আলো ছড়াচ্ছেন নিয়মিত। প্রচন্ড গতি প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগ গুড়িয়ে দেওয়ায় সিদ্ধহস্ত।
বিশেষ করে আর্জেন্টিনাকে তো প্রায় একাই ধসিয়ে দিয়ে রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিলেন বিশ্বব্যাপী। সেই ম্যাচে ৩৭ কি.মি. গতিতে আর্জেন্টাইন রক্ষণভাগ কাঁপিয়েছেন, আদায় করেছেন একটি পেনাল্টি, করেছেন জোড়া গোল। প্রয়োজনে নিজ দলকে রক্ষণেও সাহায্য করছেন। প্রতি ম্যাচেই তাকে আটকাতে হিমশিম খেয়েছ প্রতিপক্ষ।
বিশ্বকাপে এরই মধ্যে করেছেন ৩ গোল। আর প্রতিটা ম্যাচেই দলকে সাহায্য করছেন। বিশ্বকাপের অপরাজেয় উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরষ্কারটি এমবাপ্পের হাতেই উঠছে, এটি একরকম নিশ্চিতই। সাথে যদি রাশিয়া বিশ্বকাপের গোল্ডেন বলটিও ওঠে, খুব একটা অবাক হওয়ার মত কিছু থাকবে না তাতে।
লুকা মদ্রিচ (ক্রোয়েশিয়া)
ক্লাব বলুন বা জাতীয় দল, লুকা মদ্রিচের সময়টা অসাধারণই কাটছে। রিয়াল মাদ্রিদ ও ক্রোয়েশিয়া দলের মাঝ মাঠের প্রাণ হচ্ছেন মদ্রিচ। মাঠে অসাধারণ খেলার পাশাপাশি দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। তার যোগ্য নেতৃত্বই ক্রোয়েশিয়া উঠেছে ফাইনালে।
মাঝমাঠ থেকে খেলা তৈরী করছেন। ইভান রাকিতিচকে নিয়ে মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণে করছেন। ফরোয়ার্ডদের উদ্দেশ্য দিচ্ছেন একের পর এক ডিফেন্সচেরা পাস। পেনাল্টি শ্যুট আউটের সময় দলকে করেছেন উদ্দীপ্ত।
করেছেন ২ গোল, করিয়েছেন একটি। করেছেন ১১ টি ট্যাকলও। ক্রোয়েশিয়াকে ফাইনালে চলে যাওয়ায় আর সেরা খেলোয়াড় হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়েছে। মদ্রিচ হয়ে যেতে পারেন রাশিয়া বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়।
আতোয়ান গ্রিয়েজমান (ফ্রান্স)
অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের ফরোয়ার্ড গ্রিয়েজমান ফ্রান্স দলের আশা-ভরসার প্রতীক। আর বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচেই ধারাবাহিক ভালো খেলে সেই আশার প্রতিদানও দিচ্ছেন নিয়মিত। সেমি-ফাইনাল পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাল পারফর্ম করেছেন। গোল করেছেন, করিয়েছেন।
কে হবেন রিয়াল মাদ্রিদে রোনালদোর উত্তরসূরী, সম্ভাব্য ৮ জনের নাম
উইং দিয়ে ত্রাস ছড়িয়েছেন। ফ্রান্সের ফাইনালে ওঠায় রেখেছেন বড় ভূমিকা। ৩টি গোল করার পাশাপাশি করিয়েছেন ২টি। রাশিয়া বিশ্বকাপের গোল্ডেন বলের জন্য প্রতিদ্বন্দিতাকারীদের মধ্যে গ্রিয়েজমান বেশ শক্ত প্রতিদ্বন্দী।
হ্যারি কেইন (ইংল্যান্ড)
রাশিয়া বিশ্বকাপে “হ্যারিকেইন ঝড়” নিয়মিতই দেখা যাচ্ছে। এ মৌসুমে টটেনহাম হটস্পারের হয়ে অসাধারণ পারফর্ম করেছেন। ক্লাবের ফর্মটা টেনে নিয়ে এসেছেন বিশ্বকাপেও। তার পারফরম্যান্সের উপর ভর করেই ১৯৬৬ সালের পর আরেকবার বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে বিভোর ছিল পুরো ইংল্যান্ড।
কেইন তো গ্রুপ পর্ব থেকেই দুর্দান্ত ফর্মে আছেন। সেমিফাইনালের আগেই করে ফেলেছেন ৬ গোল। বলতে গেলে প্রায় একাই দলকে টেনে নিয়ে গেছেন সেমি-ফাইনালে।
এখনো আরো ১টি ম্যাচ খেলতে পারবেন তিনি। তাই গোলের সংখ্যা আরও বাড়ানোর সুযোগ থাকছে তার সামনে। হয়তোবা গোল্ডেন বুটের পাশাপাশি রাশিয়া বিশ্বকাপের গোল্ডেন বলটাও নিজের করে নিতে পারেন কেইন।
এডেন হ্যাজার্ড (বেলজিয়াম)
বেলজিয়ামের সোনালী প্রজন্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ তিনি। বেলজিয়ামের সেমি-ফাইনালে ওঠায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান তার। গ্রুপ পর্বেই ২টি গোল করার পাশাপাশি করিয়েছেনও ২টি।
নক-আউট পর্বেও ছড়িয়েছেন আলো। বিশেষ করে কাউন্টার অ্যাটাকে ছড়িয়েছেন ত্রাস। ড্রিবল করেছেন, বলও কেড়েছেন। সোনার বলটা জিততে পারেন তিনিও।
রোমেলু লুকাকু (বেলজিয়াম)
এবারের বিশ্বকাপে বেশ দারুন পারফর্ম করছেন রোমেলু লুকাকু। গোল করছেন, করাচ্ছেন, প্রতিপক্ষের রক্ষণকে তটস্থ রাখছেন।
বিশ্বকাপে গোল করেছেন ৪ টি। অবদান রেখেছেন ব্রাজিলের বিপক্ষে কেভিন ডি ব্রুইনার করা গোলেও। তার সুযোগ আছে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে হয়ে যেতে পারেন রাশিয়া বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়।
পল পগবা (ফ্রান্স)
আগের বিশ্বকাপে “সেরা তরুণ খেলোয়াড়” পুরষ্কার পেয়েছিলেন, এবার সম্ভাবনা আছে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হওয়ার।
তিনি একজন মিডফিল্ডার, যার কাজ হচ্ছে মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণের সাথে রক্ষণে সাহায্য করা। এই কাজটি কন্তেকে নিয়ে খুব ভালোভাবেই সামলেছেন।
মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি প্রতি ম্যাচেই ডিফেন্সচেরা পাস, কী-পাস দিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণকে ব্যস্ত রেখেছেন।
গ্রিয়েজমান, এমবাপ্পেদের সাথে চমৎকার বোঝা-পড়া ছিল। তার পাঠানো নিঁখুত অনেক লং পাস থেকেই প্রতি আক্রমণে গ্রিয়েজমান, এমবাপ্পেরা প্রচন্ড ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল।
তবে শুধু মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ ও আক্রমণভাগের উদ্দেশ্য ক্রমাগত বলের যোগান দিয়েই দায়িত্ব সারেননি পগবা। নিচে নেমে এসে দলের রক্ষণেও সহায়তা করেছেন।
৬টি ট্যাকলের সাথে ১৩ টি ক্লিয়ারেন্স করেছেন। একজন খেলোয়াড় থেকে কোচ এর বেশী আর কি চাইতে পারে। নিঃসন্দেহে রাশিয়া বিশ্বকাপের গোল্ডেন বলের অন্যতম বড় দাবীদার হচ্ছেন পল পগবা।
ইভান রাকিতিচ (ক্রোয়েশিয়া)
বার্সেলোনার তারকা মিডফিল্ডার ইভান রাকিতিচ ঠান্ডা মাথায় খেলতে পছন্দ করেন। শান্ত স্বভাবের রাকিতিচ ক্রোয়েশিয়ার জন্য নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছেন।
মদ্রিচের সাথে জুটি বেঁধে গড়ে তুলেছেন সমীহ জাগানিয়া মাঝমাঠ। এছাড়াও ডিফেন্স আগলে রাখছেন, গুরুত্বপূর্ণ অনেক ট্যাকল করে দলকে বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন কয়েকবার।
একজন আদর্শ বক্স টু বক্স মিডফিল্ডারের মতই খেলছেন। খেলছেন পুরো মাঠ জুড়েই। ৬টি ট্যাকলের পাশাপাশি ৭টি ক্লিয়ারেন্সও করেছেন।
রাকিতিচ সবচেয়ে বেশি প্রশংশিত হয়েছেন টানা দুটি নক আউট পর্বের ম্যাচে অসাধারণ পারফর্ম করে। পুরো ম্যাচেই দারুণ খেলার পাশাপাশি দুইটি ম্যাচেই সর্বশেষ পেনাল্টি শ্যুট আউট থেকে প্রচন্ড চাপের মুখে ঠান্ডা মাথায় লক্ষ্যভেদ করেছেন, দলকে পরবর্তী রাউন্ডে তুলেছেন।
আর সেমি-ফাইনালে তো ১০২ ডিগ্রী জ্বর নিয়েও খেলেছেন। রাশিয়া বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল অর্জনের যথেষ্ঠ সম্ভাবনা রয়েছে রাকিতিচের।
কেভিন ডি ব্রুইনা (বেলজিয়াম)
ম্যানচেস্টার সিটির এই মিডফিল্ডার বেলজিয়াম দলের মাঝমাঠের অপরিহার্য সদস্য। মাঝমাঠের “ইঞ্জিন” বলা হয় তাকে। গোলের পাশাপাশি করছেন গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসিস্ট। মাঝমাঠে তার সপ্রতিভ উপস্থিতি বিপক্ষ দলগুলোর মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে।
মাঝমাঠ থেকে খেলা তৈরীর পাশাপাশি ডানে লুকাকু ও বায়ে এডেন হ্যাজার্ডকে গুরুত্বপূর্ণ পাস দিচ্ছেন, আচমকা নিঁখুত ক্রসে গোলের সু্যোগ তৈরী করছেন। গতি, স্কিলে ব্যস্ত রাখছেন প্রতিপক্ষের রক্ষণও। গোল্ডেন বল জিততে পারেন তিনিও।
ড্যানিয়েল সুবাসিচ (ক্রোয়েশিয়া)
তিনি ক্রোয়েশিয়া দলের গোলরক্ষক। বিশ্বকাপের আগে তাকে নিয়ে খুব একটা মাতামাতি হয়নি। রাশিয়া বিশ্বকাপের পারফর্মেন্সই তাকে এনেছে আলোচনায়।
গ্রুপ পর্বে একের পর এক সেভ করে দলকে করেছেন বিপদমুক্ত। নক-আউট পর্বেও ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন। ফাইনালের আগে পর্যন্ত সেভ করার হার ৭৫%।
ডেনমার্ক ও রাশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দুটিতে ট্রাইব্রেকারে মোট চারটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে হয়েছেন নায়ক। বিশেষ করে রাশিয়ার বিপক্ষে কোয়ার্টার-ফাইনাল ম্যাচটি তিনি খেলেছেন বাহুতে ব্যান্ডেজ় বেঁধে! গোল্ডেন বল উঠতে পারে তার হাতেও।
যদি শেষ পর্যন্ত গোল্ডেন বল তার হাতে ওঠে, তবে তিনি মাত্র ২য় গোলকিপার হিসেবে এটি জিতবেন। ২০০২ সালে ১ম ও সর্বশেষবারের মত গোলকিপার হিসেবে গোল্ডেন বল জিতেছিলেন অলিভার কান।
এনগোলো কন্তে (ফ্রান্স)
তিনি এমন একজন খেলোয়াড় যার নামটা এই লিস্টে দেখেই আপনি চমকে উঠবেন। কিন্তু তার কাজটা আসলে কি সেটাই অনেকে বোঝেন না। নেই কোন গোল কিংবা অ্যাসিস্ট।
তবুও এই লিস্ট থেকে তার নামটা বাদ দেয়ার উপায় নেই। কারণ ফ্রান্স দলের রক্ষণ আগলে রাখার পাশাপাশি আক্রমণের সূচনাটাও হয় তার পা থেকেই।
মাঠে ফ্রান্স দলের “মস্তিষ্ক” যে তিনিই।
কন্তে রাশিয়ায় ৩ টি ট্যাকলের পাশাপাশি করেছেন ১১টি ক্লিয়ারেন্স। বল পুনরুদ্ধার করেছেন ৫৮ বার! তাই অন্যদের থেকে খানিকতা পিছিয়ে থাকলেও শেষমেশ বাজিমাত করতে পারেন তিনিও।
উপরে যে সম্ভাব্য নামগুলো দেওয়া হয়েছে তারা সবাই বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় এবং বিশ্বকাপে চোখ ধাঁধানো পারফর্ম করেছেন। তাই তাদের রাশিয়া বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল জেতার সম্ভাবনা একটু বেশি অন্যদের চেয়ে। বিশ্বকাপের এই শেষ পর্যায়ে এসে জমে ওঠা বিশ্বকাপ লড়াই এর সাথে উপভোগ করতে পারেন রাশিয়া বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল জেতার লড়াইও।