চৈত্রের শুরু থেকে শিলাবৃষ্টির দাপট। সাধারণত প্রতিবছর এই সময়টাতে শিলাবৃষ্টি হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে বছরের এই সময়টাতে অর্থাৎ বৈশাখে কেন শিলাবৃষ্টি হয়? ঝড়ো আবহাওয়াতে যখন শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহ উপরের দিকে উঠতে থাকে; তখন (hailstorm) তৈরি হয়। ঝড়ে convective cell তৈরি হলে উষ্ণ বায়ু উপরের দিকে উঠতে থাকে আর শীতল বায়ু নিচের দিকে নামতে থাকে| যখন সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ খুব শীতল পানির উৎস পাওয়া যায়, তখন শীতল বায়ু আর পানির দানার মিশ্রণে বরফ কণা জমতে থাকে। উর্ধ্বমুখী বায়ু এমন এক অবস্থানে পৌছায় যেখানে তাপমাত্রা শূণ্যের নিচে চলে যায় এবং বরফ সৃষ্টি হয়| একপর্যায়ে সৃষ্ট বরফ খণ্ডগুলো বায়ুর প্রবাহ থেকে ছুটে গিয়ে নিচের দিকে পড়তে থাকে। এই উর্ধ্বমুখী বায়ুর উপরে উঠা; পরে বরফ কণা সৃষ্টি হয়ে নিম্নগামী হওয়ার প্রক্রিয়াটি পুনঃ পুনঃ চলতে থাকে এবং বরফের উপর বার বার আস্তরণ জমা হতে থাকে। কখনো কখনো এই বায়ুপ্রবাহের বেগ ৬০ মাইল/ঘণ্টা পর্যন্ত হয়ে থাকে ! এভাবে পুনঃ পুনঃ প্রক্রিয়ায় বরফ কণা একসময় শিলাখণ্ডে পরিণত হয়| তবে শিলাখণ্ডগুলো ক্রমশ ভারি হয়ে উঠে। এক পর্যায়ে উর্ধ্বগামী বায়ু আর এই ভার বহন করতে পারে না। ফলে সেগুলো বৃষ্টির সাথে ভূমিতে পতিত হয়ে থাকে|, যা শিলাবৃষ্টি নামে পরিচিত। এবার জেনে নেয়া যাক বৈশাখেই কেন শিলাবৃষ্টি হয়? প্রতিবছর বৈশাখে আমাদের দেশে প্রচণ্ড গরম পড়ে। তখন বাতাসে এ ধরনের ঊর্ধ্বমুখী চাপ সৃষ্টি হয় এবং সে কারণেই এ সময় কালবৈশাখী হয়। শিলাবৃষ্টির প্রধান শর্ত প্রচণ্ড গরম। আমাদের দেশে বৈশাখ মাসে এ রকম গরম পড়ে। ফলে কালবৈশাখী নামে পরিচিত ঝড়ের সময় শিলাবৃষ্টি হয়। চৈত্রের শেষে কিংবা বৈশাখে কালবৈশাখী ঝড় হয়। বছরের অন্য সময় এমন ঝড় কমই হয়। সাধারণভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে বৈশাখেই কেন এত ঝড়-ঝঞ্ঝাট হয়। সাধারণত চৈত্রের শেষে এবং বৈশাখ মাসে সূর্য বাংলাদেশ ও তার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের ওপর খাড়াভাবে কিরণ দেয়। ফলে এ অঞ্চলের বায়ু সকাল থেকে দুপুরের রোদের তাপে হালকা হয়ে ওপরের দিকে উঠে যায়। এভাবে বিকেলের দিকে এ অঞ্চলে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়।
বৈশাখে আমাদের দেশের উত্তরে ও হিমালয়ের দিকে বায়ুর চাপ বেশি থাকে। তাই উচ্চচাপের উত্তরাঞ্চল থেকে বায়ু প্রবল বেগে দক্ষিণ দিকে নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে ধাবিত হয়। ফলে যে প্রবল ঝড়ের সৃষ্টি হয়, তাকে আমরা কালবৈশাখী ঝড় বলে থাকি।
কালবৈশাখী ঝড় কিন্তু চট করে সৃষ্টি হয় না। কালবৈশাখীর স্থায়িত্বকাল স্বল্পতর, একটি কালবৈশাখী ঝড় তৈরি হয়ে পূর্ণতা লাভের পর ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট পর্যন্ত এর তীব্রতা সর্বোচ্চ থাকে। তারপর তা আস্তে আস্তে হ্রাস পেতে থাকে। তবে কখনও কখনও এ ঝড় এক ঘন্টারও বেশিকাল স্থায়ী হয়। কালবৈশাখীর বায়ুর গড় গতিবেগ ঘন্টায় ৪০ থেকে ৬০ কিমি। কোন কোনো ক্ষেত্রে এ গতিবেগ ঘন্টায় ১০০ কিমি-এর বেশিও হতে পারে।
কালবৈশাখীর সময় অঝোর ধারায় বৃষ্টিপাত হয়। বিদ্যুৎ চমকানো, বজ্রপাত, অতি দ্রুত হারে তাপমাত্রা হ্রাস আর শিলাপাত কালবৈশাখীর সাধারণ ঘটনা। কালবৈশাখীর সময় উত্তর-পশ্চিমাকাশ কাল করে আসে।
‘কাল’ শব্দের অর্থ ঋতু। আবার কালো বর্ণকেও বোঝানো হয়ে থাকে। কালবৈশাখীকে কখনও কখনও ‘কালোবৈশাখী’ নামেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে যার অর্থ কালো বর্ণের বৈশাখী মেঘ। ঘন, কালো বর্ণের মেঘ ও ঝঞ্ঝা এবং এর ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির জন্যই এ নামকরণ।
কালবৈশাখীর জীবনচক্রকে তিনটি ধাপ বা পর্যায়ে বিভক্ত করা যায় যেগুলি ঊর্ধগামী অথবা নিম্নগামী বায়ুস্রোতের মাত্রা এবং গতিবিধি দ্বারা নির্ণীত হয়ে থাকে। কালবৈশাখীর পর্যায়গুলি হচ্ছে: ১) কিউমুলাস বা ঘনীপূঞ্জীভবন পর্যায় (cumulus stage), ২) পূর্ণতা পর্যায় (mature stage) এবং ৩) বিচ্ছুরণ পর্যায় (dissipating stage)।
একটি কালবৈশাখী পূর্ণতা লাভের ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট পর এর তীব্রতা হ্রাস পেতে থাকে এবং বিচ্ছুরণ পর্যায়ে প্রবেশ করে। অতি দ্রুত হারে তাপমাত্রা হ্রাস, মেঘে প্রচুর জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি এবং বায়ুর পুঞ্জীভূত ঊর্ধ্বচলনের দরুণ কালবৈশাখীর সঙ্গে শিলাপাত একটি সাধারণ ঘটনা। শিলার আকার নির্ভর করে মেঘের ভেতরে বায়ুর উর্ধ্ব চলাচল হার এবং এর উচ্চ জলীয় বাষ্প ধারণ ক্ষমতার ওপর। কালবৈশাখীর সময় অঝোড় ধারায় বৃষ্টিপাত হয়। বিদ্যুৎ চমকানো এবং বজ্রপাতও কালবৈশাখীর সাধারণ ঘটনা। মধ্যাহ্নের পরে অপরাহ্নে ভূ-পৃষ্ঠ সর্বাধিক উত্তপ্ত হয় এবং বায়ুমন্ডলে পরিচলন স্রোত সৃষ্টিতে ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণতা প্রধান ভূমিকা পালন করায় কালবৈশাখী সাধারণত শেষ বিকেলে শুরু হয়।
বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে শেষ বিকেলে এবং সন্ধ্যার পূর্বে কালবৈশাখীর আগমন ঘটে, কিন্তু পূর্বাঞ্চলে সাধারণত সন্ধ্যার পরে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে পূর্বদিকে এবং দক্ষিণ-পুর্ব দিক থেকে আগমন করে থাকে। এ ঋতুতে সকাল বেলাটা মোটামুটি শান্ত থাকে। কালবৈশাখীর বায়ুর গড় গতিবেগ ঘন্টায় ৪০ থেকে ৬০ কিমি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ গতিবেগ ঘন্টায় ১০০ কিমি-এর বেশিও হতে পারে। কালবৈশাখীর স্থায়িত্বকাল স্বল্পতর, তবে কখনও কখনও এ ঝড় এক ঘন্টারও বেশিকাল স্থায়ী হয়।