মানুষ ও নীল তিমির তুলনায় মানুষ কত ছোট্ট একটি প্রাণী। নীল তিমি আকারের দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী। এর গড় ওজন হয়ে থাকে ১৭০ টনের মতো। কিন্তু একটি জায়গায় মানুষের থেকে পিছিয়ে নীল তিমি। সেটি হলো মস্তিষ্ক। দেহের আকারের অনুপাতে তিমির মস্তিষ্ক বেজায় ছোট। মোটে ছয়-সাত কেজি। অথচ ৫০-৬০ কেজি ওজনের মানুষের দেহেও থাকে প্রায় দেড় কেজি ওজনের মস্তিষ্ক!
মস্তিষ্কের আকারের দিক থেকে মানুষ এই বিশ্বের অন্য সব প্রাণী থেকে আলাদা। মানুষই একমাত্র মেরুদণ্ডী প্রাণী, যাদের মস্তিষ্ক দেহের আকারের অনুপাতে সবচেয়ে বড়। মানুষের মস্তিষ্ক সবচেয়ে জটিল, নিউরনের ঘনত্বও থাকে বেশি। আর এই উন্নত মস্তিষ্কের জোরেই নীল তিমিকে হারিয়ে পৃথিবীতে রাজত্ব করছে দুপেয়ে মানুষ।
কিন্তু মানুষের মস্তিষ্ক এত বড় হলো কী করে? চার্লস রবার্ট ডারউইনের বিবর্তনবাদের দোহাই দিয়ে একটি অস্পষ্ট উত্তর দেওয়া যায় বটে, তবে তা নিখুঁত হয় না। বিষয় হলো, বিজ্ঞানীরাও এত দিন এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছেন। এবার তার কিছু ফল আসতে শুরু করেছে। সম্প্রতি দুই বিজ্ঞানীর পৃথক গবেষণায় জানা গেছে, একটি বিশেষ জিনের কারণে মানুষের মস্তিষ্ক এত বড় ও জটিল হয়েছে। অন্যান্য প্রাণীর দেহে ব্যবহার করে তার প্রমাণও মিলেছে। এই দুই গবেষণার বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে ‘সেল’ সাময়িকীতে। একটি গবেষণা দলের নেতৃত্বে ছিলেন ডেভিড হসলার ও সান্তা ক্রুজ। অন্যটির পরিচালনায় ছিলেন বেলজিয়ামের ফ্রি ইউনিভার্সিটি অব ব্রাসেলসের জীববিজ্ঞানী পিয়েরে ভনডারহেঘেন।
গবেষণা দুটি নিয়ে দ্য ইকোনমিস্ট সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গবেষক ডেভিড হসলার ও তাঁর দল এক জাতের বানরের ওপর পরীক্ষা চালান। তাতে নতুন ধরনের এক জিনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এই জিনটি হলো নচ২এনএল (এনওটিসিএইচ২এনএল)। গবেষকেরা বলছেন, পরীক্ষা চালানো বানরের দেহে এই জিন পাওয়া যায়নি। শুধু বানর নয়, শিম্পাঞ্জি ও গরিলা বাদে পৃথিবীর অন্য কোনো প্রাণীর ডিএনএ-তেই এই জিন পাওয়া যায়নি। আর পাওয়া গেছে মানুষের দেহে। শিম্পাঞ্জি ও গরিলায় থাকা নচ২এনএল (এনওটিসিএইচ২এনএল) নামের জিন পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। কিন্তু মানুষে সক্রিয়। বিবর্তনের ধারায় তা তিনটি সংস্করণও তৈরি করে ফেলেছে। এগুলো হলো এ, বি ও সি।
এই তিন সংস্করণের নচ জিন মানুষের দুটি বিলুপ্ত প্রজাতির মধ্যেও ছিল। সেগুলো হলো নিয়ানডার্থাল ও ডেনিসোভানস। গবেষকদের ধারণা, ৩০ থেকে ৪০ লাখ বছর আগে নচ২এনএল (এনওটিসিএইচ২এনএল) নামের জিনটি সক্রিয় হতে শুরু করে এবং তখন থেকেই পৃথিবীর বুকে মানুষ প্রজাতির প্রাণীর জয়জয়কার শুরু হয়। ডেভিড হসলারের গবেষণায় দেখা গেছে, নচ২এনএল (এনওটিসিএইচ২এনএল) কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। এই জিনের অনুপস্থিতিতে কোষের স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়। কিন্তু নচ২এনএলের প্রভাবে কোষের সংখ্যা বেড়ে যায়। বেড়ে যায় মস্তিষ্কের নিউরনের সংখ্যাও। আর সেটিই মানুষের মস্তিষ্ক বড় হওয়ার মূল কারণ।
জীববিজ্ঞানী পিয়েরে ভনডারহেঘেনের গবেষণাতেও একই জিনের প্রভাব দেখা গেছে। এই দুই পৃথক গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে যে মানুষের মস্তিষ্ক বড় হওয়ার পেছনে নচ২এনএল (এনওটিসিএইচ২এনএল) নামের জিনের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে কেন এটি হয়, অর্থাৎ প্রক্রিয়াটি ঠিক কী—তা এখনো জানা যায়নি। ডিএনএর মিউটেশন প্রক্রিয়া প্রতিনিয়ত ঘটে। এই মিউটেশন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে বড় আকারের মস্তিষ্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তবে বড় ও জটিল মস্তিষ্কের কিছু ঝামেলাও আছে। বড় মস্তিষ্ক পেলে পুষে রাখা বেশ হ্যাপার। কারণ, বড় মস্তিষ্কের পুষ্টিও লাগে বেশি। মজার বিষয় হলো ৩০ থেকে ৪০ লাখ বছর আগে নচ২এনএল (এনওটিসিএইচ২এনএল) নামের জিনটি সক্রিয় হয় বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। প্রাণী হিসেবে মানুষের উন্নতিও শুরু হয় তখন থেকেই। কিন্তু বড় মস্তিষ্কের জন্য তো খাবারও লাগে। ১০ হাজার বছর আগে যখন কৃষিকাজের পত্তন হলো, তার আগে কিন্তু মানুষ বেশ দুর্লভই ছিল। খাবারের জোগান বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বুদ্ধির খোলতাই হওয়া শুরু হলো!
ঠিক কীভাবে মানুষের মস্তিষ্ক এত উন্নত হলো—তার নিখুঁত বিশ্লেষণ এখনো অজানা। যন্ত্রের উদ্ভাবন একটি ব্যাখ্যা হতে পারে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সাম্প্রতিক উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে মানব মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণায় আরেকটি নতুন দিগন্তের উন্মোচন হলো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই একদিন মানুষ জানতে পারবে নিজেদের মস্তিষ্কের পুরো রহস্য।