বাংলাদেশে ভূমি নিয়ন্ত্রণ কাঠামো, পরিচালন প্রক্রিয়া এবং প্রশাসন (Land Governance and Administration) প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত। এগুলো হচ্ছে ‘ম্যানেজমেন্ট’ (ব্যবস্থাপনা), ‘সেটেলমেন্ট’ (বন্দোবস্ত) এবং ‘রেজিস্ট্রেশন’ (নিবন্ধন)। এর মধ্যে ‘ম্যানেজমেন্ট’ এবং ‘সেটেলমেন্ট’ অংশ ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত। ‘রেজিস্ট্রেশন’ অংশ আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত। রেকর্ড হালনাগাদ তথা নামজারি, রক্ষণাবেক্ষণ, ভূমি রাজস্ব আদায় ইত্যাদি ম্যানেজমেন্ট সংশ্লিষ্ট কাজ। জরিপ পরিচালনা, জরিপ পরবর্তী স্বত্বলিপি বা রেকর্ড ও মৌজা ম্যাপ প্রণয়ন, সংরক্ষণ ও সরবরাহকরণ সেটেলমেন্ট সংশ্লিষ্ট কাজ। জমির দলিলের নিবন্ধন ও সংরক্ষণ রেজিস্ট্রেশন সংশ্লিষ্ট কাজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ ডিজিটাল বাংলাদেশের আওতায় স্থাপিত সরকারের ডিজিটাল নাগরিক সেবা ইকোসিস্টেমে ভূমি মন্ত্রণালয় নাগরিক ভূমিসেবা অধিকতর কার্যকর ও দক্ষ করতে ‘ম্যানেজমেন্ট’, ‘সেটেলমেন্ট’ এবং ‘রেজিস্ট্রেশন’-কার্যক্রমের ডিজিটাল সিস্টেম সিনক্রোনাইজ (সমলয়) করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে কিছু মৌজায় ভূমিসেবা সহজীকরণ ও এর মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাইলট আকারে ই-রেজিস্ট্রেশন ও ই-মিউটেশন ব্যবস্থার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে, সাব-রেজিস্ট্রার জমি রেজিস্ট্রেশনের পূর্বে ডিজিটাল রেকর্ডরুম সিস্টেম হতে জমির রেকর্ড অনলাইনে যাচাই করতে পারবেন। একইভাবে রেজিস্ট্রেশনের সংগে সংগে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) রেজিস্ট্রেশন দলিল ও বিক্রীত জমির তথ্য ই-মিউটেশন সিস্টেমের মাধ্যমে পেয়ে যাবেন, যার ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নামপত্তন কার্যক্রম শুরু করা যাবে। এভাবে দেশব্যাপী ই-রেজিস্ট্রেশনের সংগে ই-মিউটেশনের সংযোগ স্থাপিত হলে মানুষের ভোগান্তি কমবে এবং সংশ্লিষ্ট রেকর্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে হালনাগাদ হতে থাকবে। ফলে মামলা ও জাল-জালিয়াতির সুযোগও কমে আসবে।
বিস্তারিত (ম্যানেজমেন্ট) ভূমি মন্ত্রণালয় নিজ আওতাভুক্ত সংস্থা ভূমি সংস্কার বোর্ড এবং মাঠপর্যায়ে বিভাগীয় কমিশনার-এর মাধ্যমে ভূমি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত কাজ যেমন রেকর্ড হালনাগাদ তথা নামজারি, খাসজমি ও সায়রাত মহাল রক্ষণাবেক্ষণ, ভূমি রাজস্ব আদায় ইত্যাদি সম্পন্ন করে থাকে। ভূমি সংস্কার বোর্ড সরকারের ভূমি সংস্কার নীতি বাস্তবায়নে কাজ করে থাকে। এই সংস্থার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে ভূমি রাজস্ব/ভূমি উন্নয়ন করের সঠিক দাবী নির্ধারণ, আদায় এবং ভূমি উন্নয়ন কর আদায় বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, ভূমি রাজস্ব প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান, ভূমি রাজস্ব প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের দপ্তরগুলোর বাজেট ব্যবস্থাপনা (বাজেট প্রণয়ন ও ছাড়করণ), জেলা হতে ইউনিয়ন ভূমি অফিস পর্যায়ের সকল ভূমি অফিস পরিদর্শন, তত্ত্বাবধানও পরিবীক্ষণ, বিভাগীয় পর্যায়ে উপ-ভূমি সংস্কার কমিশনার কার্যালয়ের তত্ত্বাবধান, কোর্ট অব ওয়ার্ডস-এর আওতাধীন এস্টেটসমূহের ব্যবস্থাপনা ও তদারকি ইত্যাদি। অন্যদিকে বিভাগীয় কমিশনার, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) ও সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক (কালেক্টর)-এর মাধ্যমে সরাসরি মাঠ পর্যায়ে ভূমি ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন তদারকি করেন। জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসকের নিয়ন্ত্রণাধীন ভূমি বিষয়ক বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাগণ হলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি), ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা (এলএও), জেনারেল সার্টিফিকেট অফিসার (জিসিও) এবং রেকর্ড রুম কর্মকর্তা। প্রশাসনিকভাবে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আওতাভুক্ত এবং ভূমি বিষয়ক ব্যাপারে তাঁরা ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাছে দায়বদ্ধ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিজ কর্মদায়িত্বে সরাসরি ভূমি বিষয়ক কাজে সম্পৃক্ত নন। তবে সহকারী কমিশনার (ভূমি)/এসিল্যান্ড-এর কর্মকাণ্ড তিনি তদারকি করেন এবং এসিল্যান্ড-এর অনুপস্থিতিতে তিনি সহকারী এসিল্যান্ড-এর অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। নামজারি কার্যক্রম মূলত এসিল্যান্ডের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এসিল্যান্ডের আধীনে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (পূর্বে তহশীলদার নামে পরিচিত) মাঠ পর্যায়ের প্রাথমিক ভূমি কর্মকর্তা। তার অন্যতম কাজ ভূমি উন্নয়ন কর সংগ্রহ নিশ্চিত করা। ভূমি প্রশাসনের ম্যানেজমেন্ট অংশে ভূমি সংস্কার বোর্ড Facilitator এবং বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় Implementer এর দায়িত্ব পালন করে। (#সেটেলমেন্ট) ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর ভূমি জরিপের (ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে) মাধ্যমে সেটেলমেন্ট কার্যক্রম সম্পন্ন করে । এই সংস্থার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সমগ্র দেশের প্রতিটি মৌজার স্বত্বলিপি বা রেকর্ড ও মৌজা ম্যাপ প্রণয়ন, প্রণীত স্বত্বলিপি ও মৌজাম্যাপ সংরক্ষণ ও সরবরাহকরণ, পর্যায়ক্রমে সকল মৌজায় জিওডেটিক কন্ট্রোল পয়েন্ট স্থাপন, ভূমি জরিপের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, আন্তর্জাতিক সীমানা পিলার নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ, সংরক্ষণ ও মেরামত, জোনাল ও উপজেলা সেটেলমেন্ট কার্যালয়ের তত্ত্বাবধান। এছাড়া, উপর্যুক্ত দুটির সাথে ভূমি মন্ত্রণালয়ের আরও তিনটি সংস্থার মধ্যে ভূমি রাজস্ব মামলায় জনগণের সুবিচার প্রাপ্তি, আপিল দ্রুত নিষ্পত্তি এবং মামলার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করায় কাজ করে ভূমি আপীল বোর্ড। ভূমি ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত জনবলকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে ভূমি প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। অভ্যন্তরীণ হিসাব নিরীক্ষা সংস্থা হিসেবে কাজ করে হিসাব নিয়ন্ত্রক (রাজস্ব) দপ্তর। প্রথম স্তরের নির্বাহী সংস্থা হিসেবে ভূমি মন্ত্রণালয় মাঠ-প্রশাসন, অধিগ্রহণ, খাসজমি, সায়রাত, আইন, জরিপ, বাজেট ইত্যাদি শাখার সমন্বয়ে মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত দপ্তর/সংস্থার মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কাজ ও সেবাকার্যক্রম তত্ত্বাবধান করে। এছড়া, উন্নয়ন শাখার মাধ্যমে ডিজিটালাইজেশন সহ সমস্ত উন্নয়ন প্রকল্পের তত্ত্বাবধান করে থাকে। (#নিবন্ধন) আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘আইন ও বিচার বিভাগ’-এর আওতাভুক্ত নিবন্ধন অধিদপ্তরের অধীন জেলা এবং সাব-রেজিস্ট্রারগণ ভূমি রেজিস্ট্রেশন তথা নিবন্ধনের কাজ করেন। (#অন্যান্য) উপর্যুক্ত প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সরকারের আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভূমি বিষয়ক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘বাংলাদেশ জরিপ অধিদপ্তর’ ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল, জিওডেটিক্যাল কন্ট্রোল সার্ভে ও টপোগ্রাফিক্যাল সার্ভে পরিচালনা করে থাকে এবং সংশ্লিষ্ট ম্যাপ প্রস্তুত করে থাকে। উল্লেখ্য, ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর মূলত ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে (ভূ-সম্পদ জরিপ /ভূমি রাজস্ব জরিপ) পরিচালনা করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ’ সরকারি সার্ভে (জরিপ) ইন্সটিটিউটগুলো পরিচালনা তত্ত্বাবধান করে। ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন’-এর উপর পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির দায়িত্ব অর্পিত। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে ৫ জন সদস্য নিয়ে এই কমিশন গঠিত।