মানুষ মারা যায়। তাকে আমরা চিরবিদায় দিয়ে দিই। কিন্তু এর মধ্যেও আছে এক রহস্য। সে রহস্যের ভেদ করা বা পর্দা সহজে তোলা সম্ভব নয়। কিন্তু মৃত্যু আসলে কী? কী এমন অমোঘ শক্তি এর মধ্যে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মানুষের চেষ্টার অন্ত নেই। প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর প্রথম প্রতিক্রিয়াই হচ্ছে তা বিশ্বাস না করা। মেনে না নেওয়া। মনে হয় কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। যে কথা কান দিয়ে ঢুকছে, তা আসলে ঘটেনি। সবই কল্পনা। যেমন ১৩ বছর বয়সী জাহির মা লাতাশা উইনকফিল্ড মেনে নেননি তাঁর মেয়ে মারা যেতে পারে। টনসিল অস্ত্রোপচারে কি কারও মৃত্যু হতে পারে?—এমনটাই ভাবছিলেন। তাঁর মেয়েকে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করার পর তিনি তা বিশ্বাস করেননি । খুলতে দেননি লাইফ সাপোর্ট। শেষ পর্যন্ত আদালতের দ্বারস্থ হয়ে জয়ী হয়েছিলেন। তরুণ শালমকে যখন চিকিৎসকেরা ‘মৃত ঘোষণা’ করেন, একই রকম প্রতিক্রিয়া হয় তাঁর বাবার। ছেলেকে লাইফ সাপোর্টে রাখতে ছুটে গিয়েছিলেন আদালতের কাছে। ‘মৃত ঘোষণার’ পাঁচ মাস পর্যন্ত কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় টিকিয়ে রাখা হয়েছিল শালমকে। সন্তানকে ফিরে পাননি তিনি। হয়তো একটাই সান্ত্বনা, অন্তত ওই পাঁচ মাস দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন বুকের ধনকে। তিনি বলেছিলেন, শালমকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন ঘুমিয়ে আছে। গা উষ্ণ। চেহারায় ছিল গোলাপি আভা। চিকিৎসকদের ভাষায়, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা থেমে যাওয়ার (ব্রেন ডেথ) মাধ্যমে একজন মানুষের মৃত্যু হওয়ার পরও তাকে জীবিত মানুষের মতো দেখায়। মনে হয় যেন শ্বাস টানছে। একটি পরিবারের জন্য প্রিয়জনের এমন অবস্থা মেনে নেওয়া কষ্টকর। তারা মানতে চায় না, মানুষটি আর বেঁচে নেই। জাহি ও শালমের মা-বাবার বিশ্বাসের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল বিজ্ঞান ও আইন। তবে মৃত্যুকে কি থামিয়ে রাখা সম্ভব? কখনোই না। মৃত্যু অবধারিত। মৃত্যু অমোঘ সত্য। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেই হয়। পরিণতি এক হলেও বিশ্বজুড়ে মৃত্যুকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে মৃত্যুর সংজ্ঞা। পশ্চিমা বিশ্বে ব্রেন ডেথ হওয়া মানেই একজন মানুষকে মৃত বলা হয়। অন্যদিকে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে হৃৎপিণ্ড-শ্বাসতন্ত্রের (কার্ডিও-রেসপিরেটরি) প্রক্রিয়া থেমে যাওয়াকে বলা হয় মানুষটির মৃত্যু হয়েছে। কোনো কোনো দেশে দুই প্রক্রিয়াই ব্যবহার হয় মৃত ঘোষণার জন্য। তবে কাউকে মৃত ঘোষণা করা নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের আদালত মৃত ঘোষণার ক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাসের বিষয়টিতে জোর দিয়েছেন। ধর্মীয় বিশ্বাসের বাইরে কাউকে মস্তিষ্কের মৃত্যুর জন্য মৃত ঘোষণা করার নিয়ম নেই সেখানে। বাংলাদেশে মস্তিষ্কের মৃত্যু নয়, হৃৎপিণ্ড-শ্বাসতন্ত্রের প্রক্রিয়া দেখে একজন ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করা হয় বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ও প্রকল্প ব্যবস্থাপক (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. রায়হান ই জান্নাত। তিনি বলেন, একজন মানুষ মারা গেছে—এটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আধা ঘণ্টা ধরে পরীক্ষা করা হয়। চোখের মণিতে আলো ফেললে যদি রিফ্লেকশন না হয়, হৃৎস্পন্দন না পাওয়া যায়, শ্বাসপ্রশ্বাস-প্রক্রিয়া থেমে থাকে, সর্বশেষ ইসিজি পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে ওই ব্যক্তিকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। কী ঘটেছিল শালম ও জাহির? শালম ওউয়ানোউনোউকে গত সেপ্টেম্বরে মৃত ঘোষণা করা হয়। ২৫ বছর বয়সী এই কানাডীয় তরুণ শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। কানাডার অন্টারিওর হাসপাতালে নেওয়ার পর তাঁকে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস দেওয়ার জন্য ভেন্টিলেটরে রাখা হয়। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকেরা দেখতে পান তাঁর মস্তিষ্ক সেভাবে কাজ করছে না। চেতনা নেই। শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়ার প্রক্রিয়াও মস্তিষ্কে প্রতিফলিত হচ্ছে না। শালমকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। তাঁর শরীর থেকে যন্ত্রপাতি খুলে নেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। শালমের পরিবার গোঁড়া ইহুদি। আরও অনেকের মতো তাঁর পরিবারেরও বিশ্বাস, একজন মানুষের মৃত্যু তখনই হয়, যখন তাঁর শ্বাস নেওয়া আর হৃৎস্পন্দন থেমে যায়। শালমের শরীর থেকে ভেন্টিলেশন সরিয়ে নেওয়ার বিরোধিতা করে তাঁরা আদালতে যান। আদালত তাঁদের পক্ষে নির্দেশ দেন। শালমের শরীরে আবারও লাগানো হয় কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র। এভাবে পাঁচ মাস থাকার পর গত মার্চে তাঁর হৃৎস্পন্দন থেমে যায়। তাঁর বাবা ম্যাক্স ওউয়ানোউনোউয়ের মতে, ওই কয়েকটা মাস শালম বেঁচে ছিলেন না, এমনটা তাঁরা ভাবেন না। ধনী দেশগুলোতে যেভাবে একজন ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করা হয়, সেভাবেই করা হয়েছিল শালমের বেলায়। মস্তিষ্কের কার্যকারিতা হারানোকে মৃত্যুর ভিত্তি হিসেবে ধরা হয় বলে চিকিৎসকেরা চিকিৎসার জন্য মস্তিষ্কের দিকেই ঝুঁকে পড়েন। যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণত পুরো মস্তিষ্কের কার্যকারিতা থেমে যাওয়াকে মৃত্যু বলে ধরে নেওয়া হয়। যেমন মস্তিষ্ক করোটিতে রক্ত সঞ্চালন কমে যাওয়া। তবে এই নিয়ম মেনেই শুধু সেখানে মৃত ঘোষণা করা হয়, বিষয়টি তা-ও নয়। ব্রিটেনে ব্রেইন স্টেমের মৃত্যু হলেই মৃত বলা হয়। টিউব আকৃতির মস্তিষ্কের নিচের অংশ হলো ব্রেইন স্টেম, এটা মেরুদণ্ড ও মস্তিষ্কের বাকি অংশের মধ্যে চলাচল করে। শ্বাসপ্রশ্বাসসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে ব্রেইন স্টেম। অনেকে ব্রেইন স্টেম মৃত্যুকে পুরো মস্তিষ্কের মৃত্যুর আরেকটি অবস্থা বলে মনে করেন। তবে এই বিষয়ে দ্বিমতও রয়েছে অনেকের। সাধারণভাবে কারও মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন ওঠার ঘটনা খুব একটা ঘটে না। মস্তিষ্কের সঙ্গে হৃদ্যন্ত্র ও ফুসফুসের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। নাড়ির স্পন্দন, শ্বাসপ্রশ্বাসকে ব্রেইন ডেথ বা মস্তিষ্কের মৃত্যুর নির্ণায়ক হিসেবে ধরা হয়, এর কোনো বিকল্প নেই। ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর বায়োএথিসিস্ট (আধুনিক জীববিজ্ঞান ও ওষুধবিষয়ক নীতিশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ) ও চিকিৎসক লাইনি রসের মতে, ‘একজন ব্যক্তিকে কেউ কেউ মৃত বলে মনে করবেন আর বাকিরা তাকে জীবিত ভাববেন, এটি সম্ভব নয়।’ শালমের ঘটনায় যেমন তাঁকে মৃত ঘোষণা করা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। শালমকে গত বছর প্রথমবার যখন মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল ওই সময়ের মৃত্যু সনদ বাতিল করা হবে, নাকি এই বছর তাঁর মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে নতুন সনদ দেওয়া হবে—সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেননি ওন্টারিওর আদালত। জাপানের এক আইনজীবী ও বায়োএথিসিস্ট রিহিতো কিমুরার মতে, ‘মৃত্যুর সংজ্ঞা সাংস্কৃতিক, দার্শনিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়।’ এটায় এখন পরিবর্তন আসছে। মস্তিষ্ককে মৃত্যুর মুখ্য বিষয় বলা হলেও বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। প্রায়ই তা ধর্মবিশ্বাসের বিরোধিতায় পড়ে। আগে একজন ইহুদি মারা গেলে রাব্বি (ইহুদি ধর্মীয় নেতা) ওই ব্যক্তির নাকের সামনে পালক বা আয়না ধরে শ্বাস চলছে কি না, পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতেন মৃত্যুর বিষয়ে। যদিও এখন বেশির ভাগ ইহুদি মস্তিষ্কের মৃত্যুকে মেনে নিয়েছেন। মুসলিমদের মধ্যেও একই ধরনের বিশ্বাস রয়েছে। কানাডায় খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী তাকিশা ম্যাককিটি মারা যাওয়ার পর তাঁর পরিবার মানতে চায়নি। তাঁর পরিবার বলেছিল, তাকিশার বিশ্বাস ছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত হৃৎপিণ্ড কাজ করে, ততক্ষণ পর্যন্ত আত্মা সেখানে উপস্থিত থাকে। যদি মেডিকেল যন্ত্রপাতির কারণে হৃৎপিণ্ড চলে, তাও আত্মা উপস্থিত থাকে। শালম আর তাকিশা দুই পরিবারেরই আইনজীবী ছিলেন হাগ স্কের। তিনি আদালতের কাছে তুলে ধরেছিলেন, কানাডার আইন অনুসারে, মৃত্যুর সংজ্ঞা দেশটির ধর্ম স্বাধীনতাকে লঙ্ঘন করছে। তার বিপরীতে যুক্তি দেখানো হয়েছিল যে শুধু জীবিত ব্যক্তিদের সেই অধিকার রয়েছে। তবে হাগ স্কেরের যুক্তির পক্ষে কিছু সমর্থনও পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য নিউ জার্সিতে ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে গেলে চিকিৎসকের কোনো ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ২০০৮ সালে ইসরায়েল মস্তিষ্কের মৃত্যুকে মানদণ্ড ধরলেও সেখানে রোগীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। মস্তিষ্কের মৃত্যু অথবা হৃৎপিণ্ড-শ্বাসতন্ত্রের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু—এ দুটির মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে সেখানে। ১৩ বছরের মার্কিন কিশোরী জাহি ম্যাকম্যাথকে ‘মৃত ঘোষণার’ ঘটনাটি আলোচিত ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। টনসিল অস্ত্রোপচারের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়া জাহিকে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর মৃত ঘোষণা করেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের চিকিৎসকেরা। তবে চিকিৎসকের এ সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যান জাহির মা। তাঁর পক্ষে আইনজীবী একাধিক ভিডিও উপস্থাপন করেন, যাতে দেখানো হয় জাহির আঙুল নড়ছে। যদিও হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরও এ ধরনের নড়াচড়া দেখা যায়। এমনকি গায়ে উষ্ণতাও থাকে। তারা ‘মৃত মানুষকে’ লাইফ সাপোর্টে রাখতেও অস্বীকৃতি জানায়। তবে আইনি লড়াই দিয়ে এখনো জাহিকে লাইফ সাপোর্টে রাখতে বাধ্য করেছেন তাঁর মা। আদালতের নির্দেশে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে জাহিকে নিয়ে তাঁর মা নিউ জার্সিতে চলে যান। কারণ, একমাত্র নিউ জার্সিতেই ধর্মীয় বিশ্বাসের বাইরে কাউকে মস্তিষ্কের মৃত্যুর জন্য মৃত ঘোষণা করার নিয়ম নেই। সেখানের একটি অ্যাপার্টমেন্টে এখনো লাইফ সাপোর্টে রয়েছে জাহি। কেন মৃত ঘোষণা করা হয়? নাড়ির স্পন্দন বা হৃৎস্পন্দন ও শ্বাসপ্রশ্বাস-প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়া মানেই মৃত্যু—প্রচলিত এই ধারণায় ১৯৫০ ও ১৯৬০ দশকে পরিবর্তন আসে। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার কারণে প্রচলিত ওই ভাবনায় পরিবর্তন আসে। প্রথমবারের মতো যন্ত্রের মাধ্যমে একজন মানুষের ধমনি ও শিরায় রক্তপ্রবাহ সচল রাখা সম্ভব হয়। অকেজো ফুসফুসকেও সচল রাখা হয়। একই সময়ে প্রতিটি অঙ্গের কার্যকারিতা থেমে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এভাবে মৃত্যুর প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করা গিয়েছিল। ১৯৬৮ সালে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের এক কমিটি মস্তিষ্কের মৃত্যুকে মৃত্যুর সঠিক সংজ্ঞা হিসেবে উল্লেখ করে এবং এটা পরিমাপে কিছু মানদণ্ড নির্ধারণ করে। ১৯৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র দেশটির মৃত্যু নির্ণয়সংক্রান্ত আইনে কমিটির সুপারিশ সংযুক্ত করে। এতে মস্তিষ্কের মৃত্যুকে মৃত্যুর সংজ্ঞা হিসেবে নেওয়া হয়। এর পাশাপাশি হয় হৃৎস্পন্দন ও শ্বাসপ্রশ্বাস-প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া অথবা পুরো মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি হওয়াকে মৃত্যুর সংজ্ঞা হিসেবে এতে উল্লেখ করা হয়। পশ্চিম বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ এটাই অনুসরণ করে। তিনটি কারণে নীতিনির্ধারক ও চিকিৎসকেরা মস্তিষ্কের ওপর এত মনোনিবেশ করেছেন। এর একটি হলো পশ্চিমা দর্শনে মন ও দেহকে স্বতন্ত্র হিসেবে দেখা হয়। যেখানে অন্য সংস্কৃতিতে হৃৎপিণ্ডকে মানবদেহের কেন্দ্রীয় অঙ্গ বলে ধরা হয়। পশ্চিমা বিজ্ঞান মনের ওপর বেশি জোর দেয়, যেখানে মস্তিষ্ককে মনের পরিবর্তিত অবস্থা রূপে দেখা হয়। বায়োএথিসিস্টদের মতে, মস্তিষ্কের মৃত্যুই মানুষের মৃত্যুর সঠিক সংজ্ঞা। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, লাইফ সাপোর্টে কাউকে রাখার ক্ষেত্রে ব্যয়। সংকুচিত স্বাস্থ্যসেবার কারণে এ খাতে দেশগুলো এত ব্যয় করতে চায় না। আদালত শালমকে লাইফ সাপোর্টে রাখার নির্দেশ দেওয়ার পর তাঁর জন্য হাসপাতালে চার লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় ৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা) ব্যয় করতে হয়েছে। তৃতীয় কারণ হচ্ছে, অঙ্গ প্রতিস্থাপন। ব্রিটেনে ২০১৬ সালে ১ হাজার ৩৩২ জন মানুষ মারা গেছে অঙ্গদাতার অভাবে। যুক্তরাষ্ট্রে এ সংখ্যা সাত হাজারের বেশি। অনেক অঙ্গ মৃত ব্যক্তিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। কিছু দেশ অঙ্গ প্রতিস্থাপনে উদাসীন। তারা আশঙ্কা করে, প্রতিস্থাপনের জন্য যকৃৎ, কিডনি ও হৃৎপিণ্ড পাওয়ার জন্য মৃত ঘোষণায় উৎসাহ থাকবে বেশি। তাড়াহুড়ো করে মস্তিষ্কের মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে মৃত ঘোষণা করা হবে। আর এ কারণে জাপান মৃত ঘোষণার ক্ষেত্রে হৃৎপিণ্ড ও শ্বাসতন্ত্রের ওপর নির্ভর করে। জাপানের সাপ্পোরোতে ১৯৬৮ সালে প্রথমবারের মতো কোনো ব্যক্তির হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হয়। তবে হৃৎপিণ্ডদাতাকে নিয়ে ওই অস্ত্রোপচার এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ওই অস্ত্রোপচারকে ওই সময় সাধুবাদ জানানো হয়েছিল। তবে হৃৎপিণ্ড পাওয়ার জন্য হৃৎপিণ্ডদাতাকে আগেভাগেই মস্তিষ্কের মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল বলে প্রশ্ন ওঠে পরবর্তী সময়ে। সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় আসে কোল হার্টম্যান নামের এক মার্কিন শিশুর মৃত্যুর পর অঙ্গদানের ঘটনা। আট বছর বয়সী শিশুটি ছিল প্রতিবন্ধী। ২০১৩ সালে বাড়িতে ওয়াশিং মেশিন চালু থাকা অবস্থায় মাথা ঢুকিয়ে দেয় কোল। পানিতে মাথা ডুবে থাকা অবস্থায় তাঁর বাবা জেরেমি হার্টম্যান তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে কৃত্রিমভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পরে চিকিৎসক কোলের পরিবারকে জানায়, শিশুটির মস্তিষ্কের মৃত্যু না হলেও তার মস্তিষ্ক আর কাজ করবে না, সে কখনো জেগে উঠবে না। পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুসারে, তার শরীর থেকে লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়। এর ২৩ মিনিট পর কোলকে মৃত ঘোষণা করা হয়। কোলের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ দান করে দিয়েছিল তার পরিবার। কোলকে মৃত ঘোষণার সময় সেখানে অপেক্ষায় ছিল অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচারের দল। এ ঘটনার চার বছর পর ২০১৭ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশ কোলের মৃত্যু নিয়ে তদন্ত শুরু করে। পুলিশের ধারণা, অঙ্গ নেওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করে মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল কোলকে। তার মৃত্যু ত্বরান্বিত করার জন্য মাত্রাতিরিক্ত ফেন্টানিল (ব্যথা কমানো ও অচেতন করার জন্য ব্যবহৃত ওষুধ) প্রয়োগ করেছিলেন চিকিৎসক। জাপান ১৯৯৭ সালে এক আইন কার্যকর করে যে যাঁরা অঙ্গ দানের সম্মতি দিয়ে গেছেন, তাঁদের মস্তিষ্কের মৃত্যুর পর তা নেওয়া যাবে। ভারতের অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন ১৯৯৪ অনুসারে, ব্রেইন স্টেমের মৃত্যুকে মৃত্যু হিসেবে ধরা হবে। তবে অঙ্গ দান করতে চান না—এমন ব্যক্তিদের মৃত্যুর সংজ্ঞা সেখানে স্পষ্ট করা নেই। অনেক উন্নয়নশীল দেশে হৃৎপিণ্ড-শ্বাসতন্ত্রের প্রক্রিয়া থেমে যাওয়াকে মৃত্যুর সংজ্ঞা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। আফ্রিকায় প্রচলিত ধারণা, যেকোনোভাবেই হোক দীর্ঘজীবী হতে হবে। অনেক আফ্রিকান মনে করেন, জীবন তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে না গেলে তাঁরা আধ্যাত্মিক জগতে পূজনীয় হতে পারবেন। কেনিয়ার চিকিৎসক ডাফনে নুগুনজিরি বলেন, বিষয়টি শুধু ধর্মীয় নয়। অনেক দেশে একজন মস্তিষ্ক মৃত মানুষকে মেডিকেল যন্ত্রপাতি দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস চালু রাখার মতো যন্ত্রপাতি তাদের নেই। তাই তারা হৃৎপিণ্ড-শ্বাসতন্ত্রের প্রক্রিয়া থেমে যাওয়াকে মৃত্যু হিসেবে ধরে নেয়। সূত্র: ইকোনমিস্ট, সিএনএন ও লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস