দেশের সব মোবাইল ফোন টাওয়ার পরিচালনায় চারটি কোম্পানিকে লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এসব প্রতিষ্ঠান মোবাইল ফোন অপারেটরদের কাছ থেকে টাওয়ারের মালিকানা কিনে নিয়ে সেগুলো পরিচালনা করবে। এ জন্য নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে। শিগগিরই লাইসেন্স দেওয়ার জন্য দরপত্র ডাকা হবে বলে জানা গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত কয়টা প্রতিষ্ঠানের হাতে টাওয়ার পরিচালনার দায়িত্ব যাবে, সেটি নির্ভর করছে দরপত্রের মাধ্যমে কয়টি যোগ্য প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে তার ওপর।
বিটিআরসিতে গতকাল বুধবার অনুষ্ঠিত এক বিশেষ কমিশন সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। টাওয়ার পরিচালনায় যোগ্য প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে ‘বিউটি কনটেস্ট’ পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে বলে জানা গেছে। বিউটি কনটেস্ট প্রক্রিয়ায় একটি কমিটি নির্দিষ্ট কিছু যোগ্যতার ভিত্তিতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে থেকে যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করে। এতে অংশ নেওয়া প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কারিগরি ও আর্থিক সামর্থ্যের বিষয়গুলো নির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই করা হয়।
বিটিআরসির নীতিমালা অনুযায়ী, যে চারটি প্রতিষ্ঠান টাওয়ার পরিচালনার লাইসেন্স পাবে, সেগুলোতে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মালিকানা থাকতে পারবে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ। বাকি ৩০ শতাংশ মালিকানা দেশীয় কোম্পানির হাতে থাকবে। অর্থাৎ এসব কোম্পানিতে দেশি-বিদেশি যৌথ বিনিয়োগ থাকবে। নির্বাচিত টাওয়ার কোম্পানিকে এককালীন লাইসেন্স ফি হিসেবে ২৫ কোটি টাকা দিতে হবে। ১৫ বছর মেয়াদি লাইসেন্সের বার্ষিক নবায়ন ফি হিসেবে ৫ কোটি টাকা দিতে হবে। এ ছাড়া বার্ষিক আয়ের সাড়ে ৫ শতাংশ বিটিআরসিকে দিতে হবে।
তৃতীয় পক্ষের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টাওয়ার ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত প্রথম নেওয়া হয় ২০১৫ সালে। এ জন্য সে সময় একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করা হয়। ওই নীতিমালায় দুটি কোম্পানিকে লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তবে দুটি প্রতিষ্ঠানকে সব টাওয়ার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি বিরোধিতা করে ২০১৬ সালে যৌথভাবে গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংকের মূল বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বিটিআরসিকে একটি চিঠি দেয়। এতে বলা হয়েছিল, এমন উদ্যোগ বাজারে ডুয়োপলি বা দুটি প্রতিষ্ঠানের একচ্ছত্র আধিপত্য ও অদক্ষতা তৈরির সুযোগ করে দেবে। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও কারিগরি সক্ষমতা আছে এমন যেকোনো প্রতিষ্ঠানই যাতে টাওয়ার তৈরি করতে পারে, এমন সুযোগ থাকা উচিত। এতে বাজার সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতাও নিশ্চিত হবে। সর্বশেষ নীতিমালায় তাই চারটি কোম্পানিকে লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিটিআরসি।
এখন পর্যন্ত দুটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান এই লাইসেন্স নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে। একটি হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এটিসি টেলিকম ইনফ্রাস্ট্রাকচার কোম্পানি। অন্যটি হলো মালয়েশিয়ার আজিয়াটা গ্রুপ বারহাদের মালিকানাধীন ইডটকো টাওয়ার কোম্পানি। ইডটকো ইতিমধ্যে বিটিআরসির অনাপত্তিপত্র নিয়ে ২০১৩ সালের ১ জুন থেকে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। ইডটকোতে ৮০ শতাংশ শেয়ার আছে ইডটকো গ্রুপের মালিকানায়, আর ২০ শতাংশ শেয়ার আছে মোবাইল ফোন অপারেটর রবি আজিয়াটার কাছে।
ইডটকোর কাছে বর্তমানে ৯ হাজার ৮০০ মোবাইল ফোন টাওয়ার আছে। এর মধ্যে সরাসরি ইডটকোর অধীনে আছে ৮ হাজার ৩০০ টাওয়ারের মালিকানা। আর বিভিন্ন মোবাইল ফোন অপারেটরের আরও ১ হাজার ৫০০ টাওয়ার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে ইডটকো। গত চার বছরে বাংলাদেশে ২০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তৃতীয় পক্ষের প্রতিষ্ঠানের কাছে টাওয়ার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গেলে মোবাইল ফোন অপারেটররা তাদের মূল ব্যবসায় বেশি মনোযোগ দিতে পারবে। এতে অপারেটরদের মধ্যে ভাগাভাগি করে টাওয়ার ব্যবহার বাড়বে। একটি টাওয়ার যাতে একাধিক মোবাইল ফোন অপারেটর ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে পারে, সে জন্য ২০০৮ সালে ‘টাওয়ার শেয়ারিং’ নামে একটি নীতিমালা চালু করে বিটিআরসি। একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের কাছে টাওয়ার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গেলে দেশে অতিরিক্ত টাওয়ারের সংখ্যা, জমি ও বিদ্যুতের অপচয় কমবে।
মোবাইল ফোন অপারেটরদের দেওয়া হিসাবে, দেশে চারটি মোবাইল ফোন অপারেটরের টাওয়ারের সংখ্যা প্রায় ৩২ হাজার।
বিটিআরসির নীতিমালা অনুযায়ী, লাইসেন্স পাওয়ার ৫ বছরের মধ্যে সব উপজেলায় নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করতে হবে। এর মধ্যে প্রথম বছরে সব বিভাগীয় শহর, দ্বিতীয় বছরে সব জেলা, তৃতীয় বছরে ৩০ শতাংশ উপজেলা, চতুর্থ বছরে ৬০ শতাংশ উপজেলায় নেটওয়ার্ক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।