রোবট বনাম মানুষ নিয়ে তৈরি হয়েছে অসংখ্য কল্পকাহিনি, চলচ্চিত্র। সবই শঙ্কাই কি সত্যি হতে চলেছে? রোবট নিয়ে নিয়েছে বিশ্বের সব কাজের দায়িত্ব। মানুষের নিজের হাতে করার কিছু নেই। কলকারখানা, অফিস, গবেষণা থেকে শুরু করে ঘরের রান্না পর্যন্ত করে দিচ্ছে রোবট—এমনটা আমরা প্রায় পড়ে থাকি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে। এসব নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোয় সিনেমাও হয়েছে প্রচুর। তবে এই যুগে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের ওপর নির্ভরতা, তথা রোবটনির্ভর কর্মক্ষেত্র কেবল গল্প-সিনেমার কাল্পনিক বিষয়বস্তু নয়; বরং পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই নির্ভরতা। ২০১৩ সাল থেকে এই বিষয়ে বিস্তর গবেষণা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই গবেষক কার্ল বেনেডিক্ট ফ্রে ও মাইকেল এ অসবোর্ন। তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, আগামী এক থেকে দুই দশকের মধ্যে ‘কম্পিউটারাইজেশন’-এর কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪৭ শতাংশ কর্মক্ষেত্র ঝুঁকির মুখে পড়বে। তাদের গবেষণায় আরও দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ৭০২ ধরনের কাজ পুরোপুরি মেশিনের হাতে চলে যাবে। দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি এ বিষয়ে গবেষণা করেছে অর্থনৈতিক জোট অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)। মূলত ধনী দেশগুলোর সংগঠন ওইসিডি। সংগঠনটিও অটোমেশনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা কেবল জোটভুক্ত দেশ নয়, অন্য উন্নত দেশগুলোর অবস্থাও পর্যবেক্ষণ করেছে। অবশ্য ওইসিডির গবেষণার ধরন কার্ল বেনেডিক্ট ফ্রে ও মাইকেল এ অসবোর্নের গবেষণার চেয়ে ভিন্ন। ওইসিডির গবেষণায় দেখা গেছে, সামগ্রিকভাবে ৩২টি দেশের ১৪ শতাংশ কর্মসংস্থান ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এসব কর্মসংস্থানের অটোমেশন হয়ে যাবে, সেই আশঙ্কা ৭০ শতাংশ। গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমান কর্মসংস্থানের হার অনুযায়ী ৩২টি দেশের ২১ কোটি কর্মসংস্থান অটোমেশনের ঝুঁকিতে রয়েছে। ওইসিডি একটি সারণির সাহায্যে দেখিয়েছে কোন ধরনের চাকরির ঝুঁকি বেশি। তাতে দেখা গেছে, খাদ্য প্রস্তুতবিষয়ক চাকরিতে অটোমেশনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি, ৬৫ শতাংশের মতো। অবকাঠামোবিষয়ক চাকরির ৬০ শতাংশ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাবিষয়ক চাকরির ৬০ শতাংশ, গাড়ি চালনা, পোশাককর্মী, কৃষিশ্রমিক—এসব ধরনের কাজে অটোমেশনের ঝুঁকি রয়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিতে আছে ব্যবস্থাপনানির্ভর চাকরি ও শিক্ষকতা। তবে সব দেশ একই রকম ঝুঁকিতে নেই। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশভেদে ব্যবধান রয়েছে। যেমন নরওয়ের চেয়ে স্লোভাকিয়ার কর্মসংস্থান দ্বিগুণ ঝুঁকিতে রয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায়, ধনী দেশগুলোর কর্মীরা মধ্যম আয়ের দেশগুলোর তুলনায় কম ঝুঁকিতে আছে। আবার একই রকম আয়ের দেশ হলেও ঝুঁকির পরিমাণ ভিন্ন হতে পারে। একই আয়ের দেশগুলোর ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের কাঠামো ও শিল্পের উৎপাদন পরিকল্পনা ব্যবধান তৈরি করেছে। যেমন দক্ষিণ কোরিয়ার ৩০ শতাংশ কর্মসংস্থান শিল্পনির্ভর, যেখানে কানাডায় এ হার ২২ শতাংশ। ফলে দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মসংস্থানকে অটোমেশনের আওতায় আনা কানাডার চেয়ে কঠিন। দক্ষিণ কোরিয়ার চাকরিদাতারা দুটো মিলিয়েই চাকরির বাজার সৃষ্টি করেন। এতে উৎপাদনশীলতাও কমে না। সত্যি হচ্ছে, দৈনন্দিন কিছু কাজ, সামাজিক ও সৃজনশীল কাজগুলো রোবট দিয়ে হয় না। আসলে যেসব কাজ মেশিন দিয়ে করা সহজ হয়, সেগুলো কোরিয়া ইতিমধ্যে স্বয়ংক্রিয় করে ফেলেছে। এখন যেসব কর্মসংস্থানে মানুষ কাজ করছে, সেগুলো অটোমেশনের আওতায় আনা কঠিন দেশটির জন্য। তাই ঝুঁকির বিষয়টি দেশভেদে ভিন্ন। এর আগে এই বিষয়ে গবেষণা করেন অক্সফোর্ড ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। তাঁদের সমীক্ষায় বেরিয়ে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য। তাঁদের মতে, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে মানুষের নানা ধরনের কাজের নিয়ন্ত্রণ নেবে রোবট। মানে মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে টপকে যাবে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ বা ‘এআই’। প্রধান গবেষক কাটজা গ্রেস জানিয়েছেন, আগামী ১০ বছরের মধ্যে মেকানিক্যাল-সংক্রান্ত সব ধরনের কাজে হাত পাকিয়ে ফেলবে রোবট। তবে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের গভীরতর বিষয়গুলো আত্মস্থ করতে কিছুটা সময় লাগবে তাদের। যেমন বই লেখা কিংবা ভীষণ জটিল কোনো গাণিতিক সমাধান। তবে সবচেয়ে শঙ্কার কথা হলো, গবেষকেরা আগামী ১২০ বছরের মধ্যে মানুষের সব ধরনের চাকরিবাকরি রোবটের দখলে চলে যাওয়ার ৫০ শতাংশ সম্ভাবনা দেখছেন।