TechJano

শর্টেকাডে অভিযোগ ১০ হাজার, ব্যবস্থা শুন্য

দেশে সক্রিয় মোবাইল ফোন সংযোগের সংখ্যা ১৫ কোটি ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের  (বিটিআরসি) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত  মোবাইল ফোন সংযোগ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ কোটি ২ লাখ, যা ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১৪ কোটি ৮৭ লাখ। একই সময়ে দেশে ইন্টারনেট সংযোগ সংখ্যা ১৩ লাখ বেড়ে হয়েছে ৮ কোটি ৪৫লাখ। এ বিপুল মোবাইল গ্রাহকের সেবার বদলে বিভিন্ন অফারের নামে ভোগান্তির একটি বিশদ চিত্র ফুটে উঠেছে। তারা বিটিআরসিতে অভিযোগ জানাচ্ছেন। কিন্তু মোবাইল অপারেটরদের বিরুদ্ধে দৃশ্যত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না কমিশন।

গত ফেব্রুয়ারিতে ফোরজি চালুর আগে থেকেই মোবাইল অপারেটরদের গ্রাহক ঠকানো প্যাকেজ তুমুল আলোচনা শুরু হয়। এ সেবা চালু হওয়ার আগে ২০টি প্রস্তাবনা দেয় বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন। ওই প্রস্তাবগুলোর মধ্যে ছিল টেলিকম খাতে আজ পর্যন্ত কী পরিমাণ লুটপাট হয়েছে তার অডিট রিপোর্ট প্রকাশ ও অপারেটরদের কাছ থেকে যত্রতত্র অফারের মেসেজ ও শর্টকোড নাম্বার থেকে ফোন করা বন্ধ করার বিষয়টি। ফোরজি চালুর পর দেশের মোবাইলফোন, ইন্টারনেটসহ টেলিযোগাযোগ সুবিধা ব্যবহারকারী গ্রাহকদের অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তি করতে ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি নতুন শর্টকোড চালু করে। বিটিআরসির নতুন শর্টকোড নম্বর হচ্ছে ১০০। আর এর মাধ্যমে ২০১৬ সালে থেকে চালু বিদ্যমান ২৮৭২ শর্টকোডটি বাতিল করে কমিশন।

বিটিআরসি সূত্র গণমাধ্যমকে বলেছে, মোবাইল অপারেটররা অফার ও প্যাকেজের নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিষয়ে গ্রাহকের কয়েক হাজার অভিযোগ বিটিআরসিতে জমা পড়েছে। অভিযোগগুলোর বেশিরভাগই সত্য বলে মনে হচ্ছে। বিটিআরসির নতুন শর্টকোড নাম্বার ‘১০০’ তে গত দুই মাসে ১০ হাজারেরও বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কোন অভিযোগের সমাধান দিতে পারেনি বিটিআরসি। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন অভিযোগ জানানোর জন্য বিটিআরসির ব্যবস্থা তাই কোনো কাজেই আসছে না।

অভিযোগ উঠেছে, গ্রাহক স্বার্থের কথা মাথায় রেখে বিটিআরসি (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেও বিটিআরসির অনুমোদন ছাড়াই বিভিন্ন প্যাকেজ ও অফার দিচ্ছে মোবাইল অপারেটররা। দিনের কোন অংশে কত পয়সা মিনিট বা সেকেন্ড, আবার কোন নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা রিচার্জ করলে ‘এত মিনিট ও এত এসএমএস ফ্রি’। এসব অফার পাঠিয়ে গ্রাহকদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলছে। গ্রাহকরা এসব অফার গ্রহণ করে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। একইভাবে ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও অফার দিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। মোবাইল গ্রাহকরা এসব এসএমএসের কারণে এখন অতিষ্ঠ। এরপরও অপারেটররা কাজটি করেই যাচ্ছে। বিটিআরসি অপারেটরদের চিঠি দিয়ে সতর্ক করলেও অফার দিয়েই যাচ্ছে।

দেশে সব গ্রাহকদের কাছ থেকে যদি মোবাইল অপারেটররা এক টাকা করেও হাতিয়ে নেয়, তাহলে প্রতিদিন ১৫ কোটির টাকার বেশি গ্রাহকদের কাছ থেকে চলে যাচ্ছে। প্রকৃত পক্ষে এ হিসাব আরও অনেক বড়। বিটিআরসির একজন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেছেন, প্রতিদিন একজন গ্রাহকের কাছ থেকে কম করে হলে ৫ থেকে ৬ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন অফার ও প্যাকেজের নামে। তাহলে কয় হাজার কোটি টাকা মোবাইল অপারেটরা বিনা সেবায় নিয়ে যাচ্ছে? এগুলো বন্ধ করতে বিটিআরসি যতবার উদ্যোগ নিয়েছে ততবারই কোন না কোনভাবে এ উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। অপারেটরদের শক্তি কোথায় এটা নির্ণয় করা কঠিন। প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধ উপায়ে তারা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে।

বাস্তবতা হচ্ছে, সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত হাজার হাজার অভিযোগ জমা পড়লেও কারোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারছে না বিটিআরসি। বিটিআরসির চালু করা শর্টকোড নাম্বারে ওসব অভিযোগ জমা পড়েছে। গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন অভিযোগ জানানোর জন্য বিটিআরসি নতুন শর্টকোড নাম্বার চালু করে।  কিন্তু ওই শর্টকোড কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।  সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এদেশে কর্মরত মোবাইল অপারেটরদের বিভিন্ন অফার ও ইন্টারনেট প্যাকেজ থেকে শুরু করে কলড্রপ সব কিছু মনিটর করার উদ্যোগ নিয়েছে বিটিআরসি। ইতিমধ্যে অপারেটররা অফার ও ইন্টারনেট প্যাকেজের নামে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিষয়ে গ্রাহকদের কয়েক হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে। সেগুলো আমলে নেয়া হচ্ছে। গতবছরের মার্চে বিটিআরসির বোর্ড মিটিংয়ে মনিটরিং সেল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এবার ফোর জি চালুর পর ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে বিটিআরসি। মনিটরিং সেল যে কোন অপারেটরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তদন্ত করবে। আর তদন্তে প্রতারণার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট অপারেটরকে আইন অনুযায়ী গ্রাহককে বড় অঙ্কের টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। মোবাইল অপারেটরগুলোকে এ বিষয়ে বিটিআরসি কয়েক দফা চিঠি দিয়ে সতর্ক করলেও অপারেটররা তাতে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। এবার বিটিআরসি নিজ উদ্যোগে ব্যবস্থা নেবে।

গ্রাহকদের স্বার্থের মাথায় রেখেই বিটিআরসি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাতে গ্রাহক স্বার্থ রক্ষাসহ অপারেটরদের ব্যবসা পরিচালনার বিষয়টিও মাথায় রাখা হয়েছে। কোন প্রকার অনিয়ম মেনে নেয়া হবে না। গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অভিযোগ সমাধান ও এ সংক্রান্ত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য কমিশনে গঠনকৃত ‘এক কমপ্লেন ম্যানেজমেন্ট টাক্সফোর্স’ সামগ্রিক বিষয়টি তদারকি করবে। কলসেন্টার থেকে বিভিন্ন অভিযোগের সমাধান করা হবে। টেলিযোগাযোগ অপারেটরদের অনিষ্পত্তিকৃত অভিযোগ বিটিআরসির কলসেন্টার আমলে নেবে। কলসেন্টার থেকে প্রাপ্ত অভিযোগ বিটিআরসির অভিযোগ ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কর্তৃক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট অপারেটরের কাছে পাঠানো হবে। অপারেটর থেকে অভিযোগের সমাধান বিটিআরসিকে জানানোর পর তা গ্রাহকদের জানানো হবে। বর্তমানে বিটিআরসি থেকে টেলিযোগাযোগ সেবার জন্য মোট লাইসেন্স সংখ্যা ২ হাজার ২৫টি। ওই বিপুল সংখ্যক লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের সেবাগ্রহীতারা বিভিন্ন সময় নানা বিড়ম্বনার শিকার হন। গ্রাহকদের ওই বিড়ম্বনার হাত থেকে রক্ষা করতে বিটিআরসি এমন উদ্যোগ নিয়েছে।

বিটিআরসি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সাধারণ গ্রাহক কোন না কোনভাবে প্রতারিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে (ন্যূনতম সম্ভবনা) বা আশঙ্কা রয়েছে এমন কোন প্যাকেজ বা অফার অনুমোদন দেয়া হবে না। গ্রাহকদের ফিটব্যাক ব্যবস্থা রাখতে হবে। কোন প্যাকেজ বা অফারের মেয়াদ সর্বনিম্ন ৭ দিন হতে হবে। তবে ঈদ, পূজা, বড়দিন ও নববর্ষ এসব ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা আলাদাভাবে স্বল্প সময়ের জন্য (ন্যূনতম তিনদিন) অনুমোদন দেয়া হবে। যদি কোন অপারেটর বিশেষ দিনগুলোতে নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে কম অফার দেয় তাহলে ওই অপারেটরের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোন অফার বা প্যাকেজ গ্রাহকের অনুমোদন ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হবে না। কোন অফার শেষ হওয়ার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মাসিক অফার হতে হবে ন্যূনতম ৩০ দিন। মাসিক অফার ৩০ দিনের এক ঘণ্টা কম হলেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। যেসব গ্রাহক বিটিআরসিতে অভিযোগ দিয়েছেন, তারা সমাজের সচেতন ও শিক্ষিত মানুষ। তারা বিটিআরসি পর্যন্ত আসার মতো সুযোগ তাদের রয়েছে। যারা খুব সাধারণ গ্রাহক তারা নানাভাবে প্রতারণার শিকার হলেও বিটিআরসি পর্যন্ত আসতে পারছেন না।

এ প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে বিটিআরসির চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ জানান, বর্তমান সরকার রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বিটিআরসি ২০২১ ভিশন বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। দেশে ফোর জি সেবা চালু করা হয়েছে। ফোর জি সেবার মধ্য দিয়ে দেশ টেলিযোগাযোগ খাতে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে। তবে প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বিপদ বাড়ছে। সাইবার ক্রাইমের ঝুঁকিও বেড়েছে। সেজন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিটিআরসিও সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।

Exit mobile version