দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার প্রথম বামপন্থী প্রেসিডেন্ট হিসেবে আজ সোমবার শপথ নিয়েছেন অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। শপথ নিয়ে তিনি রাজনীতিবিদদের প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার করেছেন।
গত শনিবার শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। নির্বাচনে বিপুল বিজয় অর্জন করেন বামপন্থী অনূঢ়া। স্থানীয় সময় গতকাল রোববার রাত ৮টার দিকে দেশটির নির্বাচন কমিশন তাঁকে জয়ী হিসেবে ঘোষণা করে।
নির্বাচনে ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) জোটের নেতা অনূঢ়ার নিকটতম দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিরোধীসঙ্গী জন বালাওয়াগার (এসজেবি) নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা এবং বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে।
আত্মস্বীকৃত মার্ক্সবাদী অনূঢ়া রাজধানী কলম্বোর ঔপনিবেশিক যুগের প্রেসিডেনশিয়াল সচিবালয়ে শপথ নেন। ৫৫ বছর বয়সী অনূঢ়াকে শপথ পড়ান দেশটির প্রধান বিচারপতি। শপথ অনুষ্ঠানে আইনপ্রণেতা, বৌদ্ধ ধর্মযাজক, সামরিক বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
শপথ নেওয়ার পর অনূঢ়া বলেন, ‘রাজনীতিবিদদের প্রতি জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করার জন্য আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।’
এনপিপি জোটভুক্ত দল জনতা বিমুক্তি পেরামুনার (জেভিপি) প্রধান অনূঢ়া বলেন, ‘আমি বাজিকর নই, আমি জাদুকর নই। কিছু জিনিস আছে, যা আমি জানি। কিছু জিনিস আছে, যা আমি জানি না। তবে আমি সর্বোত্তম পরামর্শ চাইব। আমি আমার সেরাটাই করব। এর জন্য আমার সবার সমর্থন প্রয়োজন।’
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধসহ নিত্যপণ্যের তীব্র সংকটের প্রতিবাদে ২০২২ সালে সড়কে নামেন শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ। প্রবল অসন্তোষের মুখে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ হাজারো মানুষ ঢুকে পড়েন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের বাসভবনে। গোতাবায়া দেশ ছেড়ে পালান।
রনিলকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে দেশটির পার্লামেন্ট। এখন নির্বাচনে জয়ী হয়ে শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে অনূঢ়া দেশটির বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রনিলের স্থলাভিষিক্ত হলেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে উত্তরণের আশায় অনূঢ়াকে ভোট দিয়েছেন মানুষ। এখন তাঁর বড় কাজ হবে অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশকে টেনে তোলা।
কে এই অনুঢ়া গণবিক্ষোভের মুখে প্রেসিডেন্ট দেশ ছেড়ে পালানোর দুই বছরের বেশি সময় পর নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট পেল শ্রীলঙ্কা।রোববার রাত আটটার দিকে দেশটির নির্বাচন কমিশন জানায়, শনিবার অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন বামপন্থী অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে।
অনূঢ়া কুমারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষে পরিবারের টানা দেড় দশকের বেশি সময়ের একক আধিপত্যের অবসান ঘটল। ১৯৪৮ সালে শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতার পর থেকে শ্রীলঙ্কা শাসন করেছে দুটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল বা তাদের জোট বা তাদেরই কোনো অংশ। এর মধ্যে একটি রাজাপক্ষে পরিবারের নেতৃত্বাধীন দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি)। দলটি থেকে একাধিকবার প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশত্যাগের আগে সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট ছিলেন তাঁর ছোট ভাই গোতাবায়া রাজাপক্ষে।
নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী, অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে ৪২ দশমিক ৩১ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর নিকটতম দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী দল সঙ্গী জন বালাওয়াগার (এসজেবি) নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা পেয়েছেন ৩২ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভোট। মাত্র ১৭ শতাংশ ভোট পেয়েছেন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রণিল বিক্রমাসিংহে।
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হয় শনিবার। প্রথম দফা ভোট গণনা শেষে দেখা যায়, একজন প্রার্থীও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি। এরপর দ্বিতীয় দফায় ভোট গণনা করে রাতে নির্বাচন কমিশন ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) জোটের নেতা অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকেকে বিজয়ী ঘোষণা করে।
নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা আসার পর এনপিপি জোটের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সোমবার সকালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। প্রেসিডেন্ট সচিবালয়ে তাঁর শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানটি হবে অনাড়ম্বর।
খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধসহ নিত্যপণ্যের তীব্র সংকটের প্রতিবাদে ২০২২ সালে সড়কে নামেন শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ। প্রবল জন–অসন্তোষের মুখে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ গণ–আন্দোলনে রূপ নেয়। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ হাজারো মানুষ ঢুকে পড়েন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের বাসভবনে। গোতাবায়া দেশ ছেড়ে পালান। এরপর রণিল বিক্রমাসিংহকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে দেশটির সংসদ।
জনতা বিমুক্তি পেরামুনার (জেভিপি) প্রধান অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে এবারের নির্বাচনে এনপিপি জোটের প্রার্থী ছিলেন। এই জোট এর আগে কখনো শ্রীলঙ্কার বিরোধী দলও ছিল না। দেশটির ২২৫ সদস্যের পার্লামেন্টে এই জোটের আসন ছিল মাত্র তিনটি।
গণবিক্ষোভের মুখে গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশ ছেড়ে পালানোর পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জেভিপির জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে। সেই গণবিক্ষোভে সক্রিয়া ভূমিকা ছিল দলটির। আন্দোলনের পর জেভিপি বৃহত্তর পরিবর্তনের ডাক দেয়। সামাজিক ন্যায়বিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলটির অনড় অবস্থান নাগরিকদের আকৃষ্ট করেছে। দলের সঙ্গে বেড়েছে অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকের ব্যক্তিগত আবেদন।
গত শতকের সত্তর ও আশির দশকে মার্ক্সবাদে অনুপ্রাণিত দুটি বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিল জেভিপি। রাষ্ট্র এর প্রতিশোধ-পাল্টা প্রতিশোধ নিতে দেরি করেনি। গণগ্রেপ্তার, নির্যাতন, অপহরণ ও গণহত্যায় দলসংশ্লিষ্ট কমপক্ষে ৬০ হাজার মানুষ নিহত হর। এর মধ্যে দলের প্রতিষ্ঠাতা রোহানা উইজেবিরাসহ বেশির ভাগ জ্যেষ্ঠ নেতাও ছিলেন।
অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর দিশানায়েকে দলের পলিটব্যুরো সদস্য হন। দল সহিংসতার পথ ত্যাগ করে। বিশ্লেষকদের মতে, দিশানায়েকে সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে এক বৃহত্তর জোট গড়ে তুলতে পেরেছেন। এটাই তাঁকে জয়ের পথ তৈরি করে দিয়েছে।
অর্থনীতি সামলানোই বড় চ্যালেঞ্জ বিক্ষোভের মুখে গোতাবায়া রাজাপক্ষে পালানোর পর রণিল বিক্রমাসিংহেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে দেশটির পার্লামেন্ট। এরপর দুই বছরের বেশি সময়ে তাঁর নেতৃত্বে অর্থনৈতিক সংকট থেকে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায় দেউলিয়া হওয়া শ্রীলঙ্কা। কিন্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে নেওয়া ঋণের শর্ত অনুযায়ী কর বাড়ানোসহ নানা পদক্ষেপ নেয় সরকার। এর চাপ পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে উত্তরণের আশায় অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকেকে ভোট দিয়েছেন মানুষ। এখন তাঁর বড় কাজ হবে নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশকে টেনে তোলা। ফলে নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরানো। এখন দিশানায়েকে দেশটির মানুষকে কতটা দিশা দেখাতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়।