সফলদের স্বপ্ন, জীবন সংগ্রাম, পথচলা আর সফলতার গল্প শোনাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে টেডএক্সবুয়েট। বুয়েটের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো আয়োজিত এবারের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র আতিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও আইইইই বাংলাদেশ সেকশনের চেয়ারম্যান ডা. সেলিয়া শাহনাজ, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও জলশিরি আবাসনের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আবু সাঈদ মো. মাসুদ।
আরো উপস্থিত ছিলেন বিসিবি ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির প্রধান ও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান এবং এভারেস্ট জয়ী প্রথম বাংলাদেশী নারী নিশাত মজুমদার।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলকে স্বাগত জানান টেডএক্সবুয়েট এর মডারেটর ডা. মো. সাব্বির মোস্তাফা খান, কো-মডারেটর ডা. সেলিয়া শাহনাজ, জলবায়ু পরিবর্তন গবেষক ও টেডএক্সবুয়েট এর কো-মডারেটর সানিয়া বিনতে মাহতাব, লাইসেন্সী মাফতাহুল ইসলাম, কো-অর্গানাইজার আলিফ আল আরেফিন প্রধান।
টেডএক্সবুয়েট এর অগ্রযাত্রা নিয়ে বক্তৃতাকালে জলবায়ু পরিবর্তন গবেষক ও টেডএক্সবুয়েট এর কো-মডারেটর সানিয়া বিনতে মাহতাব বলেন, 'বিশ্বের সকল সফলদের স্বপ্ন, জীবন সংগ্রাম, পথচলা আর সফলতার গল্প সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে এই ধরনের ইভেন্টের আয়োজন করে আসছে টেডএক্সবুয়েট। বিজ্ঞান থেকে ব্যবসা, ব্যবসা থেকে আলোচিত বিষয় নিয়ে ১০০টিরও বেশি ভাষার বিখ্যাত, আলোচিত, অনুকরনীয় ব্যক্তি নিয়ে কাজ করছি আমরা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশেও বিখ্যাত, আলোচিত, অনুকরনীয় ব্যক্তির অভাব নেই। একটু খুঁজলেই পেয়ে যাব সেই সব ব্যক্তিত্ব যাদের কর্ম, নিষ্ঠা, সততা, সংগ্রাম আমাদের আগামীর পথচলাতে হবে অনুপ্রেরণা। তেমনই পাঁচ ব্যক্তিত্ব নিয়ে সাজানো হয়েছে বুয়েটের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো এবারের আয়োজন। সবাইকে তাদের সফলদের স্বপ্ন, জীবন সংগ্রাম, পথচলা আর সফলতার গল্প শুনতে আহ্বান জানাচ্ছি।
জীবন সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, পড়ালেখা শেষ করে কি করব চিন্তা করতে করতে বেইলি রোডে কোন আইসক্রিমের দোকান দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু পরে তা আর হয়নি। মায়ের ইচ্ছা ছিল বিসিএস নয়তো সেনাবাহিনী।
কিন্তু আমার স্বপ্ন তৈরি হলো ব্যবসা নিয়ে। গার্মেন্টস নিয়ে স্বপ্নটা দেখতে শুরু করি। ধার দেনা করে ২০টা নতুন আর ২০টা পুরান মেশিন কিনে নিজেদের বাসায় তৈরি করলাম কারখানা। শুরু হলো কঠোর পরিশ্রম। সেই পরিশ্রম আজও থামেনি। ব্যবসার শুরুতেই পরাপর দুইবার বড় ধরনের হোঁচট খাই। পরিবারের সহযোগিতায় সেই কঠিন পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠি। হাল ছেড়ে দেইনি। স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে ছিলাম। এরপর আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। কঠোর পরিশ্রম করে গড়ে তুলেছি 'ইসলাম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন সমস্যা উল্লেখ করে তা সমাধানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, 'বিভিন্ন ধরনের সমস্যা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রাণের ঢাকা। কিছু সমস্যা প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হচ্ছে আবার কিছু সমস্যা আমরা নিজেরাই তৈরি করছি। এসব সমস্যা সমাধানে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আসুন একসাথে কাজ করি।
দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের অবস্থান এখানে। ঢাকা উত্তরের সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাথে বসবে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। আলোচনা-পর্যালোচনা ও গবেষণা করে টেকনিক্যাল সমাধান বের করে দিবে বুয়েট। আমরা বাস্তবায়ন করব।
দেশের প্রতিটা নাগরিককে সুনাগরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মেয়র বলেন, 'আসুন আমরা সুনাগরিক হই। আমরা সুনাগারিক হতে পারলে ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশ সুন্দর হয়ে যাবে। বাংলাদেশ একটি সুন্দর দেশ। এটা আরো সুন্দর করে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি করতে সুনাগরিক হওয়ার বিকল্প নেই। যার যার নিজের অবস্থান থেকে দেশটা ভালোবেসে সুনাগরিক হতে হবে।' বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও আইইইই বাংলাদেশ সেকশনের চেয়ারম্যান ডাঃ সেলিয়া শাহনাজ বলেন, ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ালেখায় আগ্রহী মেয়েদের সংখ্যা খুবই কম। কঠিন বিষয় ভেবে হয়তো এদিকে অনেকেই পা বাড়াতে চান না। কিন্তু বিষয়টা মোটেই কঠিন না, আমি তা দেখিয়ে দিয়েছি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রকৌশল পেশাদারদের সংগঠন ইনস্টিটিউট অব ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্সের বাংলাদেশ সেকশনের সভাপতি হয়ে প্রমাণ করেছি যে, মনের মধ্যে স্বপ্ন থাকলে সব করা যায়। স্বপ্ন দেখতে হবে আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। পরিশ্রম ছাড়া কোন কিছুই অর্জন করা সম্ভব না। আজকাল অনেক ছাত্র-ছাত্রী সহজ পদ্ধতিতে পড়ালেখা
করে বড় অর্জন করতে চায়। কিন্তু সেটা সম্ভব না। আমার অর্জনের পেছনে রয়েছে পরিশ্রম, মনোবল আর নিষ্ঠা।
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও জলশিরি আবাসনের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আবু সাঈদ মো. মাসুদ বলেন, রাজধানীর মিরপুর টু এয়ারপোর্ট রোড ফ্লাইওভার, হাতিরঝিল প্রকল্প, বাড্ডা রোডে ইউলুপ, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের মতো দেশের অনেকগুলো প্রকল্প আমার হাত দিয়েই বাস্তাবায়ন হয়েছে, কিছু প্রকল্প চলমান। এসব প্রকল্প হাতে নেয়া সহজ কাজ ছিল না। প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি আমাকে এগিয়ে নিয়েছে। সবার পরামর্শ আর নিজের ইচ্ছাশক্তি নিয়ে যখন কাজ শুরু করেছি তখন কঠিন কাজ সহজ হয়ে গেছে। কঠোর পরিশ্রম করেছি। কোন কিছু অর্জনের পেছনে কঠোর পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই।
বিসিবি ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির প্রধান ও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান বলেন, ১৯৯৪ সালের আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের হতাশাব্যঞ্জক ফলাফলের পরেই অধিনায়কের দায়িত্ব নেই আমি। কিভাবে কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। সেই সময়ে বোর্ডর সিনিয়র-জুনিয়র সবাই আমাকে সাহস দিয়েছিলেন। আমার মধ্যে একটা স্বপ্ন তৈরি করে দিয়েছিলেন। স্বপ্নটা নিয়ে মায়ের কাছে যাই, মা আমাকে সাহস দিয়েছিলেন। আমার এই পর্যায়ে আসার পেছনে আমার পরিবার অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। জীবনে বড় হওয়ার পেছনে পরিবারের অবদান অনেক বড় ব্যাপার।
যে পরিবার ত্যাগ স্বীকার করতে পারে না সেই পরিবারে বড় অর্জন আসে না। নিজেকে এই অবস্থানে আনার পেছনে আমার পেছনে কাজ করেছে আমার স্বপ্ন, আর স্বপ্নকে অর্জন করতে করেছি কঠোর পরিশ্রম। সেই পরিশ্রমেই বের হয়ে এসেছে আজকের সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিম। নিজের জীবন আর স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে এভারেস্ট জয়ী প্রথম বাংলাদেশী নারী নিশাত মজুমদার বলেন, সেই ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি আমাকে খুব টানতো। আমার জন্ম লক্ষ্মীপুরে। বড় হয়েছি ঢাকায়। গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে এলেও প্রকৃতির সাথে প্রেম বদলে যায়নি। পাহাড় আমাকে খুব টানতো। পাহাড়ে ওঠা আমার স্বপ্ন ছিল।
সেই স্বপ্ন নিয়েই ২০০৩ সালে এভারেস্ট বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের আয়োজনে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া (৩,১৭২ ফুট) কেওক্রাডং জয় করি। এরপর ২০০৬ সালের মার্চে বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে বিএমটিসি আয়োজিত বাংলাদেশের নারী অভিযাত্রী দলের সঙ্গে ফের কেওক্রাডং চূড়ায় উঠি। সেই বছরের আবার সেপ্টেম্বরে বিএমটিসি আয়োজিত নারী অভিযাত্রী দলের সঙ্গে এভারেস্ট বেস ক্যাম্প (১৭ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতা) ট্র্যাকিংয়ে অংশ
নিয়েছিলাম। এরপর ২০০৭ সালের মে মাসে বিএমটিসির অর্থায়নে দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে মৌলিক পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে হিমালয়ের মেরা পর্বতশৃঙ্গ (২১ হাজার ৮৩০ ফুট) জয় করি। এভারেস্ট অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে ২০০৮ সালে মে মাসে হিমালয়ের সিঙ্গুচুলি পর্বতশৃঙ্গে (২১ হাজার ৩২৮ ফুট) উঠি। এরপর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ অভিযানে ভারতের উত্তর কাশীর গঙ্গোত্রী হিমালয়ের গঙ্গোত্রী- ১ পর্বতশৃঙ্গে (২১ হাজার ফুট) উঠি। এরপর ২০০৯ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ অভিযানে পৃথিবীর ৫ম উচ্চতম শৃঙ্গ মাকালুতে (২৭ হাজার ৮৬৫ ফুট) উঠি। অবশেষে ২০১২ সালের ১৯ মে শনিবার সকাল নয়টা ৩০ মিনিটে প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট জয় করি। এসব অর্জন করার পথে বহু বাধা এসেছে, আমি থেমে যাইনি। 'আমি জয় করতে পারব' এমন মনোবল নিয়ে এগিয়ে গেছি। আসলে স্বপ্নকে জয় করতে দরকার সততা, নিষ্ঠা আর মনোবল। তবেই স্বপ্ন বাস্তবে ধরা দিবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) অডিটোরিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। প্রসঙ্গত, টেডএক্সবুয়েট একটি অলাভজক উদ্যোগ। এটি একটি বার্ষিক ইভেন্ট যেখানে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় চিন্তাবিদ এবং কর্মীদের তাদের স্বপ্ন, জীবন সংগ্রাম, পথচলা আর সফলতার গল্প শোনাতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেসব স্বপ্ন, চিন্তা, ভাবনা ভিডিও আকারে ধারন করা হয় ১৮ মিনিট। প্রযুক্তি, বিনোদন এবং নকশা- এই তিনটি বিষয় নিয়ে সাজানো হয় টেডএক্সবুয়েট। বিজ্ঞান থেকে ব্যবসা, ব্যবসা থেকে বিশ্বের বিভিন্ন আলোচিত বিষয় নিয়ে ১০০টিরও বেশি ভাষার বিখ্যাত, আলোচিত, অনুকরনীয় ব্যক্তি নিয়ে কাজ করছে টেডএক্সবুয়েট। খুব ছোট থেকে সংগ্রাম করে বড় হওয়ার গল্পগুলো বিশ্বব্যাপী সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কাজ করছে এই উদ্যোগ। দেশ বিদেশের বিভিন্ন খাতের সফলদের স্বপ্ন, জীবন সংগ্রাম, পথচলা আর সফলতার গল্প সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতেই ১৯৮৪ এর সাথে পথ চলা।