এক সময় সাইকেল চালাতেন, বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতেন। পড়ালেখাতেও ছিলেন মেধাবী। ক্লাস এইট পর্যন্ত সব ঠিক ঠাক ছিল ফাহিমের। ২০১২ সালের শেষ দিকে জেএসসি পরীক্ষার ঠিক আগে থেকে বিছানা শয্যা। ধীরে ধীরে পেশি গুলো শুঁকিয়ে যেতে থাকে। তারপর একে বারেই অকেজো হয়ে পড়ে হাত পা থেকে শুরু করে পুরো শরীর। মাগুরা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের এই মেধাবী শিক্ষার্থীর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায় ওই ক্লাস এইটেই।
সব সময় বিছানা শোয়া একটা মানুষ কি বা করতে পারে। দৈনন্দিন প্রতিটি কাজের জন্য যার নির্ভর করতে হয় অন্যের উপর। ফাহিমুল করিমের (২১) স্বপ্নটা স্থবির হয়ে পড়তে পারতো সেখানেই। কিন্তু মাগুরা শহরের এই তরুণ বিশ্বাস করেন শারীরিক অক্ষমতা মানেই মানসিক অক্ষমতা নয়। ডুচেনেমাসকিউলার ডিস্থ্রফি নামে জটিল রোগে আক্রান্ত এই তরুণ এখন আপ ওয়ার্কের টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার। যার হাতের আঙ্গুল ঠিক মতো কাজ করেনা তার আপ ওয়ার্কে প্রতি ঘণ্টায় রেট ৮ ডলার।
মাগুরা শহরের একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার জন্ম ফাহিমের। বাবা রেজাউল করিম একটি বেসরকারি কোম্পানির বিপণন বিভাগে কাজ করেন। মা হাজেরা খাতুন গৃহিণী। ছোট এক বোন নবম শ্রেণীতে পড়ে। সীমিত আয়ে এই চার জনের সংসার চালাতে হিমশিম খান বাবা।
রেজাউল করিম জানান, ফাহিমের সমস্যা প্রথম ধরা পড়ে ২০০৬ সালে। দেশে বেশ জায়গায় চিকিৎসা করানোর পর ২০০৮ সালে নিয়ে যান ভারতের কলকাতায়। সেখানে একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, তার ছেলে ডুচেনেমাসকিউলার ডিস্থ্রফিতে আক্রান্ত। ধীরে ধীরে পেশি দুর্বল হয়ে যাবে। বংশগত রোগটির কোন স্থায়ী চিকিৎসা হয়না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সমস্যা জটিল হতে পারে। সেখান থেকে ফিজিওথেরাপির পরামর্শ ও পুনরায় চিকিৎসার জন্য যেতে বলা হয়। কিন্তু ছেলে অচল হয়ে পড়লেও আর্থিক সংকটের কারণে আর চিকিৎসা করাতে পারেন নি বাবা রেজাউল করিম।
ফাহিমের সাথে কথা হয় মাগুরা শহরের পিটিআই পাড়া তাদের ভাড়া বাসায়। বিছানায় বসে ল্যাপটপের সামনে বসে আছেন তিনি। তার কাছে শুনতে চাই অসুস্থ্য শরীর নিয়ে টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার হয়ে ওঠার গল্প।
ফাহিম জানান, মাগুরা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তেন তিনি। জেএসসি পরীক্ষার দুই তিন আগে থেকে হাটা চলা বন্ধ হয়ে যায়। অসুস্থ্য শরীর নিয়েই পরীক্ষা দিয়েছিলেন। রেজাল্ট ও হয়েছিল ভালো। কিন্তু ক্লাস নাইনে আর ভর্তি হওয়া হয়নি। হতাশা কাটাতে প্রথমে বাসার পাশের দুইটা ছেলেকে প্রাইভেট পড়াতেন। এভাবে চলে বছর খানেক।
প্রাইভেট পড়ানোর টাকা দিয়ে প্রথমে একটি মোবাইল ফোন কেনেন ফাহিম। তারপর ফেসবুকের মাধ্যমে একদিন জানতে পারেন ঘরে বসে অনলাইনের মাধ্যমে আয় করা যায়। প্রথমে মোবাইল দিয়েই কাজ শেখার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু বেশিদূর এগুতে পারেন নি। দরকার ছিল একটা ল্যাপটপ। মায়ের কাথা শেলাইয়ের জমানো টাকা ও কিছু ব্যাংক লোণ নিয়ে ল্যাপটপ কেনেন ফাহিম।
২০১৬ সালের শেষ দিকে শুরু হয় ফাহিমের গ্রাফিক্স ডিজাইনার হয়ে ওঠার লড়াই। গুগল, ইউটিউব থেকেই মূলত কাজ শিখেছেন তিনি। শুরুর দিকে মাগুরাসহ বিভিন্ন জায়গার অভিজ্ঞদের সহযোগিতা পেয়েছেন তিনি। ২০১৭ সালে প্রথমে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ফাইবারে যোগ দেন তিনি। প্রথম দিনেই কাজ পান। পাঁচ ডলারের কাজ ক্লাইন্ট খুশি হয়ে বোনাস দেয় ১০ ডলার। তারপর আর ফিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে ফাইবারে লেবেল টু সেলার আর আপ ওয়ার্কে টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করছেন ফাহিম। গত দুই বছরে সাড়ে চারশোর বেশি প্রজেক্টে কাজ করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত তার সবমিলিয়ে আয় আট হাজার ডলার।
হাতের আঙুল গুলোও যার ঠিক মতো কাজ করেনা, কিভাবে সে এতো দূর এলো। ফাহিম কে দেখলে যে কারো মনে জাগবে এমন প্রশ্ন। শারীরিক ভাবে এমন অসুস্থ হয়ে পড়লে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েন। কিন্তু সেই হতাশ মানুষ গুলোর দলে নন এই তরুণ। ফাহিম জানান, ‘আমার হতাশ না হওয়ার পেছনে কারন হোল, স্টিফেন হকিংসও আমারমতো ডিজেবল ছিল। আমার মতো মানুষদের জন্য তার একটা কথা ছিল যে, ফিজিক্যালি ডিজেবল হও কিন্তু মানসিক ভাবে ডিজেবল হয়ো না। কারন শারীরিক অক্ষমতা ভালো কিছু করা থেকে আটকে রাখতে পারেনা। ‘ এই কথাটি সব সময় মনে রাখেন ফাহিম।
তরুণ এই ফ্রিল্যান্সার জানেন দীর্ঘদিন এই কাজ তিনি করতে পারবেন না। তাই পরিকল্পনা আছে টাকা জমিয়ে কোন ব্যবসা শুরু করা। যেখানে আরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়। বর্তমানে পরিবারের খরচের বড় একটি অংশের যোগান আসে তার ইনকাম থেকে। ইতিমধ্যে ছেলের উপর্জিত অর্থে শহরে চার শতক জমি কিনেছে পরিবার।
রেজাউল করিমের কাছে জানতে চাই ছেলের চিকিৎসা সম্পর্কে। তিনি ২০০৮ সালে ভারতে ডাক্তার দেখানোর পর বড় পর্যায়ে আর কোন চিকিৎসা হয়নি ফাহিমের। এতদিন অর্থাভাবে বিষয়টি চিন্তাও করতে পারেন নি। এখন ফাহিম যেহেতু উপার্জন করছে তাই বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবছেন। তবে ছেলের ভালোভাবে চিকিৎসা করানোর সক্ষমতা এখনো তার নেই।
হাজেরা খাতুন জানান, রাত জেগে ছেলে কাজ করে। সাথে তাকেও জাগতে হয় কারন, ফাহিম নিজে কিছুই করতে পারেনা। নিজের শরীরের কোন অংশ একটুও সরানোর ক্ষমতা তার নেই। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে সব ধরণের কাজেই তার একজন সহযোগীর প্রয়োজন হয়।
ফ্রিল্যান্সিংয়ের অনেক গ্রুপে মোডারেটর হিসেবে আছেন ফাহিম। মাগুরাসহ দেশের অনেকেই তার কাছে পরামর্শ চায়। ফাহিম জানান, ফ্রিল্যান্সার হতে হলে প্রচুর ধৈর্যের প্রয়োজন। এ কারণে অনেক তরুণ কাজ শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেনা। ফাহিমের মতো শারীরিকভাবে অক্ষম তাদের প্রতি তার আহ্বান হোল, কখনও ভাববেন না আপনি দুর্বল, কখনই ভেঙে পড়া যাবেনা।