স্টিফেন হকিংকে চেনেন তো? অনেকেই চেনেন না। ওই যে কম্পিউটারের সাহায্যে যিনি সব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেছিলেন। তাঁর কম্পিউটার সম্পর্কে চলুন জেনে আসি। চেহারায় স্থায়ী বিষাদের ছাপ। যেন হাসতে জানেন না। ৭৬ বছরের বিশদ জীবনে বিষাদ হয়তো ছিল, তবে সে ছাপের মূল কারণ শরীরের টিস্যুগুলো তিনি সহজে নড়াতে পারতেন না। মুখের কঠিন বলিরেখা নরম করতে রীতিমতো কসরত করেছেন। সেই ২১ বছর বয়সে শরীরের শক্তি হারাতে শুরু করেন। ৪৩ বছরে বিকল হয়ে পড়ে কণ্ঠ। এরপর দিন যত গড়িয়েছে, বাড়িয়েছেন মনের জোর। সে জোরেই আমৃত্যু সরব ছিলেন ব্রিটিশ জ্যোতিঃপদার্থবিদ স্টিফেন হকিং। হাত না বাড়িয়েই লিখেছেন। মুখ না নাড়িয়েই বলেছেন। আর তা তিনি করেছেন প্রযুক্তির সাহায্যে। ১৯৯৭ সাল থেকে মাইক্রো-প্রসেসর উৎপাদনকারী ইনটেল হকিংয়ের যান্ত্রিক কণ্ঠস্বরের জন্য নিয়মিত কারিগরি সহায়তা দিয়ে এসেছে। সে বছর এক সম্মেলনে ইনটেলের সহপ্রতিষ্ঠাতা গর্ডন মুরের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় তাঁর। মুর দেখলেন যোগাযোগের জন্য হকিং যে কম্পিউটার ব্যবহার করেন, তাতে প্রতিদ্বন্দ্বী এএমডির তৈরি প্রসেসর। এতে হয়তো তাঁর আঁতে ঘা লেগেছিল। এরপর থেকে দুই বছর অন্তর হকিংকে ইনটেলের প্রসেসরযুক্ত কম্পিউটার দিয়েছেন গর্ডন মুর। হকিং অবশ্য তার আগেই যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর পেয়েছিলেন। ১৯৮৫ সালে ইউরোপের পদার্থবিজ্ঞান গবেষণাগার সার্নে যাওয়ার পথে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। অবস্থা ভয়াবহ। ডাক্তাররা একপর্যায়ে তৎকালীন স্ত্রী জেনকে বলেই বসেন, লাইফ সাপোর্ট বন্ধ করে দেবেন কি না। প্রবল প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন জেন। এরপর হকিংকে নিয়ে আসা হয় কেমব্রিজে। সেখানে চিকিৎসায় তাঁর ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। তবে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করতে শ্বাসনালিতে ছিদ্র করতে হয়। নিজের মুখে কথা বলার সে-ই শেষ। সে সময়ে অক্ষর-কার্ডের সাহায্যে যোগাযোগ শুরু করেন হকিং। একের পর এক অক্ষর দেখানো হতো। ভুরু নাড়িয়ে সায় জানাতেন তিনি। এভাবে অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে শব্দ এবং শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে বাক্য তৈরি করতেন। সে সময়ে নতুন যোগাযোগব্যবস্থা তৈরি করতে মার্টিন কিং নামের এক পদার্থবিদ হকিংয়ের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ড প্লাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন মার্টিন। ইকুয়ালাইজার নামে কম্পিউটার সফটওয়্যার ছিল তাদের। এই সফটওয়্যারে আঙুল নাড়িয়ে শব্দ নির্বাচন করা যেত, কম্পিউটারে কাজের নির্দেশ দেওয়া যেত। প্রথমে অ্যাপল টু কম্পিউটারে চালানো হয় ইকুয়ালাইজার। সে কম্পিউটারে যুক্ত ছিল স্পিস সিনথেসাইজার। পুরো সিস্টেম হকিংয়ের হুইলচেয়ারের হাতলে যোগ করেন ডেভিড ম্যাসন। তিনি হকিংয়ের এক নার্সের স্বামী। নতুন এই পদ্ধতিতে মিনিটে ১৫ শব্দ লিখতে এবং স্পিস সিনথেসাইজারের সাহায্যে বলতে শুরু করেন হকিং। তবে হকিংয়ের শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হতে থাকে। ২০০৮ সালে শব্দ নির্বাচনের জন্য আঙুল নাড়ানোর ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন। এক ছাত্র তখন চশমার সঙ্গে খুদে এক যন্ত্র জুড়ে দেন। এটি ইনফ্রারেড রশ্মির সাহায্যে হকিংয়ের গালের পেশির সামান্য নড়াচড়াও শনাক্ত করতে পারত। এরপরেই হকিং কম্পিউটারে দ্রুত ই-মেইল বা বই লেখা, ওয়েবসাইট দেখা এবং শুধু এক পেশির সাহায্যে বলতে শুরু করেন। ২০১১ সালে গিয়ে দেখা গেল তিনি মিনিটে একটি, বড়জোর দুটি শব্দের বেশি বলতে পারেন না। গর্ডন মুরের কাছে আবারও চিঠি পাঠিয়ে হকিং জানতে চান, ইনটেল এ ব্যাপারে তাঁকে কোনো সাহায্য করতে পারে কি না। মুর দায়িত্ব দেন ইনটেলের তৎকালীন প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা জাস্টিন র্যাটনারকে। ইনটেল ল্যাবসের গবেষকদের নিয়ে হকিংয়ের জন্য দল গঠন করেন র্যাটনার। হকিংয়ের ৭০তম জন্মদিনের কয়েক সপ্তাহ পর ইনটেলের দলটি তাঁর সঙ্গে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা করে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ অধ্যাপক দলটিকে স্বাগত জানান। হকিং কথা বলেন ২০ মিনিট পরে। এই ২০ মিনিট ধরে তিনি ইনটেলের দলটিকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য ৩০ শব্দ লিখতে পেরেছিলেন। জাস্টিন র্যাটনার বুঝলেন, সমস্যা গুরুতর। ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস ব্যবহার করতে চেয়েছিল ইনটেল। এতে ব্রেইন ওয়েভ বা মস্তিষ্কের সংকেত শনাক্ত করে সে অনুযায়ী কম্পিউটারে নির্দেশ দেওয়া যায়। তবে প্রযুক্তিটি অন্যদের ক্ষেত্রে কাজে দিলেও হকিংয়ের ব্রেইন ওয়েভ নিখুঁতভাবে শনাক্ত করতে পারেনি। শব্দ লেখার ক্ষেত্রে হকিংয়ের বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল ভুল অক্ষর টাইপ করা। যেমন কোনো কারণে যদি হকিং নির্দেশ দিতে সামান্য সময় দেরি করেন, তবে পর্দায় অক্ষরটি চলে যায় এবং পরের অক্ষরটি টাইপ হয়। এতে সে অক্ষর মুছে পুনরায় কি-বোর্ডের বাকি অক্ষরগুলো ঘুরে আসার অপেক্ষা করতে হতো। আর স্টিফেন হকিং ছিলেন পারফেকশনিস্ট। একদম নিখুঁত না হওয়া পর্যন্ত তিনি একই কাজ বারবার করতেন। ইনটেলের দল তাই নতুন প্রযুক্তির বদলে হকিংকে নিয়েই গবেষণা শুরু করেন। কীভাবে তিনি কম্পিউটার ব্যবহার করেন, তাঁর লেখায় কোন শব্দগুলো বারবার থাকে, ইত্যাদি। আর এ জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে হকিংয়ের কম্পিউটার ব্যবহারের ভিডিও ধারণ করে দলটি। পরে সেগুলো বিশ্লেষণ করা হয়, একই ভিডিও বারবার দেখা হয়।
ইনটেল তখন লন্ডনভিত্তিক স্টার্টআপ সুইফটকির সঙ্গে কাজ শুরু করে। সুইফটকির প্রযুক্তিতে একজন ব্যবহারকারী যে শব্দগুলো বারবার লেখেন এবং যে শব্দগুলোর পর যে শব্দগুলো লেখেন, তা বিশ্লেষণ করে। এতে এক শব্দ লিখলে তার ঠিক পরে কোন শব্দ সে ব্যবহারকারী লিখতে পারে, তা দেখায়। সুইফটকির ডেটাবেইসে হকিংয়ের লেকচার, বই এবং প্রকাশিত গবেষণাপত্র ইনপুট দেওয়া হয়। এতে তাঁর লেখার রীতি সম্পর্কে একটা ধারণা পায় সুইফটকি। কোন শব্দের পরে কোন শব্দ লিখবেন, তা অনেকটা আন্দাজ করতে পারে। এই প্রযুক্তি হকিংয়ের জন্য বেশ কাজে দেয়। লেখা বা বলার গতি বেড়ে যায়। আর এভাবেই তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। স্টিফেন হকিংয়ের ওয়েবসাইটে তাঁর সর্বশেষ ব্যবহার করা কম্পিউটার সরঞ্জামের একটা তালিকা দেওয়া আছে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশসহ স্টিফেন হকিংয়ের দুটি হুইলচেয়ার ছিল। এর মধ্যে পুরো প্রযুক্তি বাস্তবায়ন এবং অ্যাকাট (ACAT) সফটওয়্যার ও ডিজিটাল ব্লিংক সুইচ তৈরি করেছে ইনটেল। চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি থেকে র্যাস্পবেরি পাই থ্রি কম্পিউটারে পিটার বেনির তৈরি সফটওয়্যার স্পিচ এমুলেটর ব্যাবহার করতেন হকিং। হকিংয়ের ল্যাপটপ দিয়েছে লেনোভো। ইয়োগা ২৬০ মডেলের ল্যাপটপ ব্যবহার করতেন তিনি। উইন্ডোজ ১০ অপারেটিং সিস্টেমচালিত সে কম্পিউটারে কোর আই৭ প্রসেসর এবং ৫১২ গিগাবাইট সলিড স্টেট ড্রাইভ ছিল। তথ্যসূত্র: প্রথম আলো।