সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় আকাশচুম্বী চাহিদা দেখা গিয়েছিল জুম ভিডিও কমিউনিকেশনস ইনকরপোরেশনের তৈরি রিমোট কনফারেন্সিং অ্যাপের। কয়েকদিন আগেও যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হওয়া অ্যাপ ছিল জুম। কিন্তু তথ্যনিরাপত্তা ইস্যুর কারণে বড় ধরনের পটপরিবর্তন হতে চলেছে। মার্কিন সিনেটরদের অ্যাপটি ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরে শিক্ষার্থীদের দূরশিক্ষণ কর্মসূচিতেও অ্যাপটির ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জুম ব্যবহারে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে আরো কয়েকটি দেশ ও প্রতিষ্ঠান। এ অবস্থায় ব্যবহারকারীদের আস্থা ফেরাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অ্যাপটির ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান। খবর ব্লুমবার্গ ও রয়টার্স।
নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বেড়েছে ঘরে বসে কাজ করার প্রবণতা। ভাইরাসটির সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশ্বজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ায় দূরশিক্ষণ পদ্ধতির ব্যবহারও বেড়েছে। আর এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখছে বিভিন্ন ভিডিও কনফারেন্সিং অ্যাপ। লকডাউন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে করপোরেট অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সংস্থা—সবাই এ ধরনের অ্যাপ ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। এমনই একটি সেবা হলো জুম। ভিডিও কনফারেন্সিং অ্যাপ হিসেবে এটি যুক্তরাজ্যে প্রথম ও যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।
জুমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এরিক এস ইউয়ান জানান, আগে প্রতিদিন এক কোটি মানুষ জুমের মাধ্যমে বিভিন্ন বৈঠকে অংশ নিতেন। মার্চ শেষে এ সংখ্যা ২০ কোটির মাইলফলক অতিক্রম করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রেও জুমের ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। গত ২৬ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে দেশটিতে অ্যাপটি ডাউনলোড হয়েছে ৩২ লাখ বার।
কিন্তু তথ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হওয়ায় সেই যুক্তরাষ্ট্রেই ব্যবহারকারীদের আস্থা হারাতে শুরু করেছে জুম। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্কিন সিনেটের পক্ষ থেকে সদস্যদের অ্যাপটি ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। বিষয়টিতে ওয়াকিবহাল একজন জানিয়েছেন, সিনেটরদের ঘরে বসে কাজ করার জন্য বিকল্প প্লাটফর্ম ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।
অনলাইন প্লাটফর্মে তথ্য নিরাপত্তা আসলেই বড় একটি ইস্যু। নীতিনির্ধারকরা রিমোট কনফারেন্সিং সেবার মাধ্যমে কোনো বৈঠকে অংশ নিলে এবং ওই বৈঠকসংশ্লিষ্ট সংবেদনশীল তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে তা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। মার্কিন সিনেট এ বিষয়টিকেই আমলে নিয়েছে।
সিঙ্গাপুরের ইস্যুটি শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তার। লকডাউনের মধ্যে নগররাষ্ট্রটির বিদ্যালয়গুলো বন্ধ। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের বাড়িতে রেখেই পাঠদানের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। আর এর জন্য সহায়তা নেয়া হচ্ছিল জুম অ্যাপের। কিন্তু সম্প্রতি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, হ্যাকাররা পাঠদানের কয়েকটি সেশন হ্যাক করে সেখানে অশ্লীল ছবি আপলোড করে দিয়েছে। এ কারণে দেশটির সরকার দূরশিক্ষণে জুমের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। সিঙ্গাপুরের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষাপ্রযুক্তি বিভাগের ডিভিশনাল ডিরেক্টর অ্যারন লোহ বলেছেন, ‘এগুলো খুবই ভয়াবহ ঘটনা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় হ্যাকিংয়ের ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখছে।’
শুধু যে যুক্তরাষ্ট্র বা সিঙ্গাপুরই জুম অ্যাপ ব্যবহার থেকে সরে আসছে, তা নয়। গত বুধবার তাইওয়ানে সরকারি দাপ্তরিক যোগাযোগ ও রিমোট মিটিংয়ে জুমের ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। অ্যাপটির ব্যবহারে খড়্গহস্ত হয়েছে জার্মানিও। নিউইয়র্ক সিটি ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশন দূরশিক্ষণে জুমের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। বিভিন্ন দেশের সরকার ও নগর কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি নিরাপত্তা শঙ্কায় অ্যাপটির ব্যবহার বন্ধ করেছে কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠানও। গুগল তাদের করপোরেট ল্যাপটপে জুমের ডেক্সটপ সংস্করণের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলোন মাস্কের টেসলা ইনকরপোরেশন ও স্পেসএক্সও জুম ব্যবহার থেকে সরে এসেছে।
বলা যায়, করোনা পরিস্থিতিতে তৈরি হওয়া সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে চলেছে জুম। অবশ্য এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। প্রতিষ্ঠানটি নিরাপত্তা ত্রুটি দূর করার লক্ষ্যে একটি পরামর্শক পর্ষদ গঠন করেছে এবং ফেসবুকের সাবেক সিকিউরিটি চিফ অ্যালেক্স স্ট্যামোসকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।
জুমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এরিক এস ইউয়ান বলেন, আপাতত জুমের নিরাপত্তা সমস্যা সমাধানে ফিচার হালনাগাদ বন্ধ রাখা হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারী ঠেকাতে বিশ্বজুড়ে অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বাসায় থেকে কাজের পরামর্শ দিয়েছে। এতে গত কয়েক সপ্তাহে বিপুলসংখ্যক নতুন জুম ব্যবহারকারী পেয়েছি আমরা। হঠাৎ তৈরি হওয়া এ চাপ সামাল দেয়া আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের কাছে ব্যবহারকারীদের তথ্যের নিরাপত্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আগামী তিন মাসের মধ্যে সমস্যা সমাধানে সফটওয়্যার হালনাগাদ দেয়া হবে। আমরা বুঝতে পারছি, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও তথ্যনিরাপত্তার প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছি। আগামী তিন মাস নতুন ফিচারের পরিবর্তে কেবল তথ্যনিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে কাজ করবে টেকজুম।