সুজয় দাসের বাড়ী পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলায়।২০০৭ সালের প্রলয়ংকারী সাইক্লোন সিডরের ধ্বংসযজ্ঞ তিনি নিজ চোখে দেখেছেন। সিডর-পরবর্তী সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমও তিনি খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছেন।এসব পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি প্রায়োগিক অর্থেই শিখেছেন যে, দুর্যোগাক্রান্ত মানুষের খুব নিবিড় সহায়তার দরকার হয়।প্রলয়ংকারী দুর্যোগে যেহেতু মৌলিক চাহিদাসমূহের যোগান মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়, তাই, দুর্যোগপরবর্তী পরিবেশে দ্রুততম সময়ের মধ্যে যথাস্থানে যথোপযুক্ত ত্রাণ নিয়ে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে যেতে পারার মধ্যেই ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের সাফল্য নির্ভর করে।আর এর জন্য দরকার একটি সুসমন্বিত এবং সুবিন্যস্ত ত্রাণ ও পুনর্বাসন ব্যবস্থা।
ত্রাণ ও পুনর্বাসন একটি বহু-অংশীদারী প্রক্রিয়া। দুর্যোগ পরবর্তী যেকোনত্রাণ কার্যক্রমের সাথে বিভিন্ন সরকারী সংস্থা, বেসরকারী সংস্থা, বহুজাতিক দাতা ও উন্নয়ন সংস্থা, বন্ধু প্রতিম বিভিন্ন রাষ্ট্র ও তাদের বিভিন্ন সংস্থা, বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা, স্থানীয় দাতা ও উন্নয়ন সংস্থা এবংদানশীল ব্যক্তিবর্গসহ বিভিন্নধর্মী অংশীদারগণ যুক্ত থাকেন।এই অংশীদারদের মধ্যে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম চলাকালীন সময়ে তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের নিরিখে স্বত:প্রণোদিতভাবেই একটি নেটওয়ার্ক তৈরি হয়।এই নেটওয়ার্কটি যথোপযুক্তভাবে গড়েউঠলে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম সুসমন্বিত তথা কার্যকর হওয়ার পথ সুগম হয়। নেটওয়ার্কটি যত এলোমেলোভাবে গড়ে ওঠে, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের কার্যকারিতা তত হ্রাস পায়। অতএব, অংশীদারদের মধ্যকার এই নেটওয়ার্কটিকে সময়ের সাথে সাথেকাঙ্ক্ষিত গুণগত বৈশিষ্ট্য সহকারে গড়ে তোলা একটি চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল (সিএসই) বিভাগের স্নাতক ও বর্তমানে একই বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের গবেষক সুজয় দাস খুব কাছ থেকে দেখা এই সমস্যা সমাধানের জন্য তার গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক ড. মো: সাইদুর রহমানের কাছে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার আগ্রহ প্রকাশ করলেন।এই বিষয়ে কার্যকর গবেষণা তখনও তেমন একটা হয়নি।অধ্যাপক ড. মো: সাইদুর রহমান বিশ্বের অন্যতম সেরা গ্রাফ থিওরি বিশেষজ্ঞ।বিভিন্ন সত্ত্বার মধ্যকার আন্ত: ও অন্ত:-সম্পর্কের গাণিতিক ব্যাখা-বিশ্লেষণ এবং বিভিন্ন সত্ত্বার মধ্যেকাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আন্ত: ও অন্ত:-সম্পর্ক গড়ে তোলার নিমিত্ত প্রয়োজনীয় গাণিতিক বিষয়াদিগ্রাফ থিওরিরঅন্যতম অনুষঙ্গ।ড. রহমান সুজয়কে গ্রাফ থিওরি ও নেটওয়ার্ক থিওরির আলোকে সমস্যাটি সমাধানের জন্য দিকনির্দেশনা দিলেন।সুজয় সিডরসহ আরও বিভিন্ন প্রলয়ংকারী দুর্যোগপরবর্তী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের তথ্য সংগ্রহ করে সমস্যাটির স্বরূপ উন্মোচন করলেন। ইতোমধ্যে এই গবেষণা দলে যুক্ত হলেন বুয়েটের সিএসই বিভাগেরসহকারী অধ্যাপক ড: সাদিয়া শারমিন। এই বিভাগের গ্রাফ ড্রইং এন্ড ইনফরমেশন ভিজ্যুয়ালাইজেশন ল্যাবে এবার শুরু হল সমস্যার লাগসই সমাধান বের করার পালা।
অধ্যাপক ড. মো: সাইদুর রহমানের নেতৃত্বাধীন গবেষক দল দুর্যোগ পরবর্তী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের অংশীদারদের মধ্যকার তথ্য প্রবাহ ও যোগাযোগের নেটওয়ার্কটিকে পূর্বপরিকল্পিত উপায়ে কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সুবিন্যস্ত নেটওয়ার্কে পরিণত করার জন্য গ্রাফ থিওরি ও নেটওয়ার্ক থিওরির নিরিখে একটি গাণিতিক মডেল উদ্ভাবন করেন। তাদের এসংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি IEEER10 Humanitarian Technology Conference, 2017-তে Community Needs and Environment Track-এ সেরাগবেষণাপত্রেরস্বীকৃতিপেয়েছে। IEEE হলইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স প্রকৌশলী এবং কম্পিউটার প্রকৌশলীদের একটি বৈশ্বিক সংগঠন। পৃথিবীর ১৬০ টি দেশে এই সংগঠনের প্রায় চার লক্ষ তেইশ হাজার সদস্য রয়েছেন।
গবেষক দলের সদস্য সুজয় দাস জানান, প্রযুক্তিকে সরাসরি ও কার্যকর উপায়ে মানবকল্যাণে ব্যবহারের প্রত্যয় থেকে শুরু হওয়া এ গবেষণাকর্ম হতে প্রাপ্ত গাণিতিক মডেল অনুসরণ করে যেকোন দুর্যোগপরবর্তী পরিবেশে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করার পূর্বেই উক্ত কার্যক্রমের সম্ভাব্য অংশীদারদের মধ্যে পূর্বপরিকল্পিত উপায়ে বিদ্যমান বিধি-বিধান অনুযায়ী তথ্য প্রবাহ ও যোগাযোগের একটি সুবিন্যস্ত নেটওয়ার্ক তৈরি করা সম্ভব যা সময়ের সাথ সাথে আরও পরিমার্জিত এবং অধিকতর কার্যকর হয়। ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরুর পূর্বেই বিগত দিনের তথ্য বিশ্লেষণান্তে এই সুবিন্যস্ত নেটওয়ার্কটি তৈরি করে সেই অনুযায়ী কার্যক্রম চালানো হলে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের কাঙ্ক্ষিত কার্যকারিতা নিশ্চিত করা অনেকাংশেই সহজ হয়।তিনি জানান, তাদের গাণিতিক মডেল অনুযায়ী তৈরিকৃত নেটওয়ার্কটি হবে একটি Complex Network যাতে বিদ্যমান থাকবে Small-World Effect ও High Clustering Coefficient. Complex Network এক বিশেষ ধরণের নেটওয়ার্ক যা মূলত: কাঠামোগত সুরক্ষার অধিকতর নিশ্চয়তা প্রদান করে এবং কয়েকটি মাত্র প্রভাবশালী অংশীদার কে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই সুবিশাল নেটওয়ার্কের পুরোটাকেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। Small-World Effect হল খুব সহজে এবং কম ধাপে কোন অংশীদারের অন্য যেকোন অংশীদারের সাথে সংযুক্ত হতে পারার নিশ্চয়তা এবং অপ্রয়োজনীয় সরাসরি সংযুক্তির সম্ভাবনা কমিয়ে দেওয়া। High Clustering Coefficient হল সমধর্মী অংশীদারদের মধ্যে পারস্পরিক সংযুক্তির অধিকতর সম্ভাবনা। একটি সুসমন্বিত তথা কার্যকর ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম এসব বিষয়ের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল বলে জানান গবেষক দলের সদস্য ড: সাদিয়া শারমিন।
গবেষক দলের সদস্যবৃন্দমনে করেন, এই পৃথিবীতে মানবতাই শেষ কথা। তাদের মতে, নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বিদ্যমান প্রযুক্তি উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত মানবমুক্তির পথ সুগম করা। অসহায় মানুষের পাশে লাগসই প্রযুক্তি নিয়ে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণায় তারা তাদের গবেষণাকর্ম সামনের দিকে আরও এগিয়ে নিতে চান।
লেখক: সুজয় দাস। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর গবেষক।