কিংবদন্তী আলোকচিত্রশিল্পী, সিনেমাটোগ্রাফার ও মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন এর জীবনভর ধারণকৃত আলোকচিত্র, রচনা, সাক্ষাৎকার-সহ যত বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ রয়েছে তা সংরক্ষণ, প্রচার এবং এর আইনগত দিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ‘আনোয়ার হোসেন ফাউন্ডেশন’ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে আনোয়ার হোসেনের পরিবারের সদস্যগণ। আজ সকাল সাড়ে ১১টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা ভবনের সেমিনার কক্ষে এই সংবাদ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে প্রয়াত আনোয়ার হোসেনের দুই পুত্র আকাশ হোসেন ও মেঘদূত হোসেন ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন আনোয়ার হোসেনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা আলি হোসেন বাবু, বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সংসদকর্মী ও আনোয়ার হোসেনের বাল্যবন্ধু হাশেম সূফী, চলচ্চিত্রকার রাজীবুল হোসেন, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চলচ্চিত্র নির্মাতা বেলায়াত হোসেন মামুন, আইনজীবি সুরাইয়া সুমি ও তরুণ চলচ্চিত্রকার অদ্রি হৃদয়েশ প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে বেলায়াত হোসেন মামুন বলেন, ‘আমরা আনোয়ার হোসেনের আকস্মিক প্রয়াণে শোকগ্রস্ত হয়ে আছি। আপনারা জানেন আনোয়ার ভাইয়ের স্ত্রী মিরিয়াম হোসেন এবং তাঁর দুই পুত্র আকাশ ও মেঘদূত ফ্রান্সের প্যারিসে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আকাশ হোসেনের এখন বয়স ১৮ বছর এবং মেঘদূতের বয়স ১৬ বছর। আকাশ, মেঘদূত বা মিরিয়াম কেউই বাংলাদেশে থাকেন না এবং তাদের পক্ষে ঘণ ঘণ বাংলাদেশে এসে আনোয়ার হোসেনের সারাজীবনের সৃষ্টিকর্মগুলো নিয়ে কাজ করাও সম্ভব নয়। তাই আনোয়ার ভাইয়ের পরিবারের অন্যান্য সদস্য যেমন তাঁর ভাই বোন, মিরিয়াম, আকাশ, মেঘদূতের সাথে আলোচনা করে আনোয়ার ভাইয়ের সকল সৃষ্টিকর্ম সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি ফাউন্ডেশন গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। আজ সেই বিষয়েই আপনাদের বিস্তারিত জানাতে আমরা এখানে একত্র হয়েছি।’
সংবাদ সম্মেলনে আনোয়ার হোসেনের পুত্র আকাশ হোসেন বলেন, আমরা আপনাদের (উপস্থিত সাংবাদিকদের) মাধ্যমে বাংলাদেশের সকলকে জানাতে চাই যে, আপনাদের মধ্যে যাদের কাছে আমার বাবা আনোয়ার হোসেনের ফিল্ম নেগেটিভ, লেখা বই বা রচনা, ডিজিটাল আলোকচিত্র যাই সংরক্ষিত থাকুক তা আমাদের ফাউন্ডেশনের কাছে হস্তান্তর করুন। আপনারা জানেন আমার বাবা একজন শিল্পী ছিলেন। তিনি খুব গুছানো মানুষ ছিলেন না। ফলে তাঁর সৃষ্টিকর্মগুলো সব হয়ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এগুলোকে একত্র করা এবং সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণের জন্য আপনাদের সবার সহযোগিতা চাই। আপনারা আমাদের আনোয়ার হোসেন ফাউন্ডেশনকে সহযোগিতা করুন। আনোয়ার হোসেনের সৃষ্টিকর্মগুলো রক্ষা করার এই কাজে আমাদের পাশে থাকুন।’
আনোয়ার হোসেনের কনিষ্ঠ পুত্র মেঘদূত হোসেন তাঁর বক্তব্যে বলেন, আমার বাবাকে আপনারা যেভাবে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তাতে আমরা আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আপনারা আমাদেরকে সহযোগিতা করুন যাতে আমরা আমাদের বাবার সকল সৃষ্টিকর্মগুলোকে একত্র করে সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারি।
আনোয়ার হোসেনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা আলি হোসেন বাবু বক্তব্য প্রদান করতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, আমার বড় ভাই আনোয়ার হোসেন কখনও বৈষয়িক ছিলেন না। তিনি আপাদমস্তক একজন শিল্পী ছিলেন। তাঁর সারাজীবনের সকল কাজ দেশের মানুষের ও দেশের জন্যই ছিল। আমরা আপনাদের সকলের কাছে আমার ভাইয়ের কাজগুলো সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে এখানে এসেছি। আমরা যে ফাউন্ডেশনটি করছি তা আমার ভাইয়ের কাজগুলো সংরক্ষণ করবে এবং কাজগুলোর অপব্যবহার রোধ করবে। আমরা চাই যে যেখানেই আনোয়ার হোসেনের আলোকচিত্র ব্যবহার করুক তা আমাদের অনুমতি নিয়ে করুক। যে কোনো সৃষ্টিকর্ম ব্যবহারের জন্য যে ন্যুনতম সম্মান ও শ্রদ্ধা আমার ভাইয়ের প্রাপ্য তা আমার ভাইকে দেয়া হোক।’
আনোয়ার হোসেনের বাল্যবন্ধু ও বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সংসদকর্মী হাশেম সূফী বলেন, আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশের একজন মহানশিল্পী ছিলেন। তাঁর সকল কাজকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। এটা আমাদের নৈতিক ও জাতীয় দায়িত্ব। যে ফাউন্ডেশনটি আজ গঠিত হতে যাচ্ছে তা অবশ্যই খুব জরুরি উদ্যোগ। এই ফাউন্ডেশনের আপাতত প্রধান কাজ হবে আনোয়ার হোসেনের বিগত ৫০ বছরের সকল আলোকচিত্র, লেখা, তাঁর প্রকাশিত বই, তাঁর সাক্ষাৎকারসমূহ উদ্ধার ও সংরক্ষণ করা। এসব খুব দ্রুত করতে হবে। কারণ আনোয়ার হোসেনের আলোকচিত্র কেবলমাত্র শৈল্পিক কারণেই সংরক্ষণ করতে হবে তা নয়। আনোয়ার হোসেনের আমাদের জাতির ইতিহাসের উপাদান রেখে গেছেন তাঁর আলোকচিত্রে। এসব যদি হারিয়ে যায় তবে আমাদের জাতির ইতিহাস হারিয়ে যাবে। তাই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে অতি দ্রুত রাষ্ট্রীয়ভাবে এসব উদ্ধার করা উচিত বলে আমি মনে করি।
সংবাদ সম্মেলনের সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নাট্যজন লিয়াকত আলী লাকী বলেন, আমাদের দূর্ভাগ্য যে আমরা আমাদের এই মহানশিল্পীকে এভাবে হারালাম। আমরা ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটির সাথে অনেকদিন ধরেই পরিকল্পনা করছিলাম আনোয়ার ভাইয়ের ৫০ বছরের আলোকচিত্র ও ৪০ বছরের চলচ্চিত্র জীবনের পৃথক প্রদর্শনী ও চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনের। গত প্রায় দেড় বছর ধরে এই পরিকল্পনা এগিয়েছে। এখন যখন এই উৎসব আয়োজনের সময় হয়েছে তখন তাঁকে আমরা এভাবে হারাবো তা আমাদের কল্পনাতেও ছিল না। আনোয়ার ভাইয়ের সারাজীবনের সকল কাজ উদ্ধার, সংরক্ষণ এবং তা নিয়ে প্রদর্শনী বা উৎসব আয়োজনের দায়িত্ব তো আমাদের রাষ্ট্রীয় কাজ। এসব করাটা রাষ্ট্রের জন্যই দরকার। কারণ এই মানুষগুলোই তো এই রাষ্ট্র গঠনে শিল্পীত ভূমিকা রেখেছেন। আমি আনোয়ার ভাইয়ের জন্য যে কোনো কাজ করতে তৈরি আছি। আমরা চাই আনোয়ার হোসেন ফাউন্ডেশন দ্রুত তাঁর কার্যক্রম শুরু করুক এবং আমরা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই তাঁর সৃষ্টিসমূহ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে তৎপর রয়েছি। আনোয়ার হোসেনের ৫০ বছরের আলোকচিত্র প্রদর্শনীর জন্য আমরা কাজ শুরু করেছি এবং তাঁর ৪০ বছরের চলচ্চিত্রজীবনের রেট্রোস্পেক্টিভ আয়োজনেও ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। আশা করি খুব শীঘ্রই এসব আয়োজন আপনাদের দৃষ্টিগোচর হবে। তিনি আরও বলেন, আনোয়ার হোসেন ফাউন্ডেশন অবশ্যই আনোয়ার হোসেনের সকল সৃষ্টিকর্মের কপিরাইট সংরক্ষণ করবে। এ ব্যাপারে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় খুব দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
সংবাদ সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে বেলায়াত হোসেন মামুন জানান, আনোয়ার হোসেন ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি থাকবেন আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী মিরিয়াম হোসেন, তাঁর দুই পুত্র আকাশ হোসেন ও মেঘদূত হোসেন। এই ফাউন্ডেশনের প্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন আনোয়ার হোসেনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা আলি হোসেন বাবু এবং অন্যান্য ট্রাস্টিগণের মধ্যে থাকবেন নাট্যজন লিয়াকত আলী লাকী, চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম, সিনেমাটোগ্রাফার রাশেদ জামান, চলচ্চিত্রকার রাজীবুল হোসেন এবং ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চলচ্চিত্র নির্মাতা বেলায়াত হোসেন মামুন।