দেশীয় ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদন শিল্পের স্বার্থ রক্ষায় আমদানি নীতি পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ রেফ্রিজারেটর ম্যানুফ্যাকচারাস অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন (বিআরএমইএ)। পাশাপাশি দেশীয় শিল্পের বিকাশে বিদ্যমান নানান বাধা দূরীকরণে এএসআরও জারীর আবেদন জানিয়েছে সংগঠনটি। একই সঙ্গে সরকারি কেনাকাটায় দেশীয় উৎপাদনকারীদের অগ্রাধিকার দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে বিআরএমইএ। যৌক্তিক এ দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন ব্যবসায়িক সংগঠনের নেতারা। শিল্প সচিব জানিয়েছেন ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বরবার এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দিয়েছে বিআরএমইএ। অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যার অনুলিপি পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা, মন্ত্রীপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মূখ্যসচিব, ইআরডি, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব ও মহাপরিচালকদের।
বিআরএমইএ সভাপতি স্বাক্ষরিত ওই আবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান সরকারের সার্বিক সহযোগিতা ও দেশীয় উদ্যেক্তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশ এখন এয়ারকন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার, কম্প্রেসর, টেলিভিশন, এলিভেটর বা লিফট, সুইচ-সকেট, ফ্যান, এলইডি লাইট বাল্ব, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও কম্পিউটার, হোম অ্যান্ড কিচেন অ্যাপ্লায়েন্সসহ বিভিন্ন ইলেকট্রিক্যাল, ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও দামে সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব এসব পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হচ্ছে। এমন অবস্থায় কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে উচ্চমূল্যে এসব পণ্য আমদানি নিরর্থক ও অপচয় মাত্র। সেই সঙ্গে ওইমতো আমদানি দেশীয় শিল্প বিকাশ ও স্বার্থের পরিপন্থি। তাই দেশীয় শিল্প বিকাশ ও কর্মসংস্থানে আমদানি নীতি পরিবর্তন সময়ের দাবি।
উল্লেখ্য, দেশীয় উৎপাদন শিল্পের সুরক্ষা দিতে এবং অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে বিশ্বের বহু দেশ তাদের আমদানি নীতি পরিবর্তন করেছে। সম্প্রতি স্থানীয় শিল্প বিকাশের স্বার্থে প্রতিবেশী ভারত রেফ্রিজারেন্টসহ এয়ার কন্ডিশনার, টেলিভিশন ইত্যাদি পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। যা বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের জন্য বেশ বড়সর ধাক্কা। কারণ সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে নতুন পণ্য হিসেবে ভারতে এসি ও ফ্রিজ রপ্তানি শুরু হয়েছিল। করোনা মহামারির মধ্যেও চলতি ২০২০-২১ অর্থ বছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে বাংলাদেশ থেকে ৩১৩,৬৩৬ মার্কিন ডলারের এসি ভারতে রপ্তানি হয়েছে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। সুতরাং এ নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশে তৈরি ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তিপণ্যের জন্য ভারতের মতো বিশাল সম্ভাবনাময় একটি রপ্তানি বাজার হুমকির মুখে পড়লো।
ভারতের এমন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের চলমান রপ্তানিতে বাধা হলেও দেশটির স্থানীয় শিল্প সুরক্ষার জন্য প্রশংসনীয় উদ্যোগ বলে অভিহিত করে বিআরএমইএ। বাংলাদেশের স্থানীয় শিল্প সুরক্ষার জন্য আমদানি নীতিতে পরিবর্তন এনে একই রকম পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে জানায় সংগঠনটি।
বিআরএমইএ’র চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, দেশীয় উৎপাদনকারীদের ক্ষেত্রে বিএসটিআইয়ের মান নিয়ন্ত্রণ সনদ বাধ্যতামূলক। বিদেশে কোনো পণ্য রপ্তানি করতে গেলে সংশ্লিষ্ট দেশের মান নিয়ন্ত্রণ সনদ নেয়াও বাধ্যতামূলক। রয়েছে বিপুল শুল্ক বাধা। অথচ বিদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে বিএসটিআইয়ের মান নিয়ন্ত্রণ সনদের বালাই নেই। যে যেভাবে পারছে আমদানি করছে। পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রেই আমদানিতে নামমাত্র শুল্ক থাকায় নিম্নমানের পণ্যে দেশ সয়লাব হচ্ছে। এতে বিপুল অর্থের অপচয় ও পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। তাই আমদানি পর্যায়ে বিদেশি ব্র্যান্ডের পণ্যের ক্ষেত্রে বিএসটিআইয়ের মান নিয়ন্ত্রণ সনদ বাধ্যতামূলক করার দাবি জানিয়েছে বিআরএমইএ।
এদিকে, সরকারি সংস্থার অভ্যন্তরীণ কেনাকাটায় উপেক্ষিত হচ্ছে দেশীয় উৎপাদকদের তৈরি পণ্য। প্রায় সব সরকারি দরপত্রে বেশি দামের আমদানিকৃত পণ্যের ব্যান্ড বা দেশের নাম সরাসরি উল্লেখ থাকে। ফলে দেশীয় ব্র্যান্ড বা উৎপাদনকারীরা কম মূল্য প্রস্তাব করেও কৌশলে বাদ পড়ে যায়। ফলে সুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে দেশীয় উৎপাদনকারীরা বঞ্চিত হচ্ছে। আবার দরপত্রে আমদানিকৃত পণ্যের ব্র্যান্ড বা দেশের নাম সরাসরি উল্লেখ পিপিআর-২০০৮ বিধি ২৯(৩) এর সরাসরি পরিপন্থি।
বাংলাদেশ রেফ্রিজারেটর ম্যানুফ্যাকচারাস অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন-এর মহাসচিব জাহিদুল আলম বলেন, পৃথিবীর সচেতন দেশগুলো নিজস্ব শিল্প রক্ষায় আমদানি নিষিদ্ধ করছে। বাংলাদেশেরও এখন সে পথে হাঁটা উচিত। বাংলাদেশে তৈরি আন্তর্জাতিক মানের ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তিপণ্য ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বহু উন্নত দেশে রপ্তানি হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে তৈরি বলে এসব সমমানের পণ্য বি গ্রেড বা সেকেন্ড/থার্ড গ্রেড বিবেচনা করে অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি সংস্থার কেনাকাটায় অনীহা প্রকাশ বা কৌশলে বাধা সৃষ্টি করা হয়। যার ফলে দেশীয় শিল্পের বিকাশ ব্যাহত হয়। উদ্যেক্তারাও বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হন। তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে আমাদের আবেদন, যেন স্থানীয় কেনাকাটায় দেশীয় উৎপাদকের প্রাধান্য দেয়া হয়। এতে সবদিক দিয়ে দেশ লাভবান হবে।
তিনি স্থানীয় উৎপাদনকারীদের স্বার্থে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে আমদানি নীতিতে পরিবর্তন আনার দাবি জানান। একই সঙ্গে সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত, আধা-স্বায়ত্বশাসিত এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটায় দেশীয় উৎপাদকদের অগ্রাধিকার দেয়ার আহ্বান জানান। পাশাপাশি দরপত্রে বিদেশি ব্র্যান্ড বা দেশের নাম উল্লেখ না করার বিষয়ে এসআরও জারির আবেদন করেন।
এ প্রসঙ্গে শিল্প সচিব কে এম আলী আজম বলেন, দেশীয় শিল্পরক্ষায় ইতোমধ্যে নতুন নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছি। স্থানীয় শিল্পে উৎপাদিত সমজাতীয় পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করতে আমদানি শুল্ক বাড়ানোর বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। আমদানি নিষিদ্ধ করা যায় কি না তাও ভেবে দেখা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, দেশীয় শিল্প সুরক্ষা ও বিকাশ ত্বরান্বিত করার স্বার্থে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটায় দেশীয় পণ্যকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেটি বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সিনিয়র সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বিগত কয়েক বছরে দেশে ইলেকট্রনিক্স, ওষুধ শিল্পসহ সম্ভাবনাময় কয়েকটি নতুন শিল্পখাতের বিকাশ ঘটেছে। নতুন এই শিল্পখাতগুলোর উৎপাদিত উচ্চ গুণগতমানের পণ্য বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে রপ্তানি হচ্ছে।
তার মতে, দেশীয় শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের আমদানি দ্রুত কমিয়ে আনতে হবে। আমদানি যত দ্রুত কমানো যাবে, দেশীয় শিল্পখাতের টেকসই বিকাশের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতির গতি ততো ত্বরান্বিত হবে। তাই, দেশীয় শিল্পসুরক্ষা সহায়ক নীতিমালা খুবই জরুরি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য আইআইটি অনুবিভাগ) মো. হাফিজুর রহমান বলেন, সরকার দেশীয় পণ্যের বিকাশ এবং উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে সবসময়ই আন্তরিক। যে বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছে- তা আমরা বিবেচনায় রেখেছি।