অবধারিত প্রশ্নটা উঠে আসছেই। লোকাল উদ্যোক্তাদের প্রাধান্য দিতে হবে। দেশীয় কোম্পানির সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগ ছাড়া দেশে ই-কমার্স খাতে কোনো বিদেশি কোম্পানি ব্যবসা করতে পারবে না। আর মোবাইল অপারেটরগুলোকে এ খাতে ব্যবসা করতে হবে নেট নিরপেক্ষতা মেনে। ই-কমার্স বা ডিজিটাল কমার্স নীতিমালার চূড়ান্ত খসড়ায় রয়েছে এসব শর্ত। এই খসড়ায় ই-কমার্স সেক্টরের সার্বিক উন্নয়নে সেন্টার অব এক্সিলেন্স, সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধিদের নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ বা অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল গঠন, ভোক্তাদের জন্য কোড অব কন্ডাক্টসহ বিভিন্ন বিধি-বিধানের কথা এসেছে। গত ১৯ মার্চ সোমবার ডিজিটাল কমার্স নীতিমালার চূড়ান্ত খসড়ার প্রুফ দেখেছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। এই তথ্য উল্লেখ করে ফেইসবুক স্ট্যাটাসে মন্ত্রী জানান, সহসাই সংশোধন হয়ে এটি অনুমোদনের পথে যাত্রা করবে। ই-কমার্স নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তাঁর নির্দেশনায় তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ, ই-ক্যাব ও বেসিস যৌথভাবে খাত সংশ্লিষ্টদের নিয়ে এই নীতিমালা তৈরিতে কাজ শুরু করে ।ই-ক্যাব প্রাথমিক খসড়া তৈরি করে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে জমা দেয়। এরপর তৈরি হয় দ্বিতীয় খসড়া।মন্ত্রী হিসেবে মোস্তাফা জব্বার দায়িত্ব নেয়ার প্রথম মাসেই জানুয়ারিতে ই-কমার্স খাত সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে দিনব্যাপী কর্মশালা করে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। তৈরি হয় তৃতীয় খসড়া। আর তিনি ‘ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা-২০১৮’ নামে ই-কমার্স নীতিমালার নতুন নামকরণ করেন
কি আছে ই-কমার্স নীতিমালায়?
নীতিমালায় দুটি অধ্যায়ের একটিতে নীতিমালার নাম, পরিধি ও সংজ্ঞা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানে সংক্ষিপ্ত শিরোনাম, প্রয়োগ ও প্রবর্তন, নীতিমালায় বিষয় বা প্রসঙ্গের পরিপন্থী কিছু না থাকার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে ।দ্বিতীয় অধ্যায়ে নীতিমালার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলোর রয়েছে। যেখানে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা পদ্ধতি, ডিজিটাল কমার্স ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকরণ, ইলেক্ট্রনিক লেনদেন ও ই-পেমেন্ট, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা, ডিজিটাল কমার্স সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের কার্যক্রম সমন্বয়, আইনি কাঠামো, আইন প্রয়োগ পদ্ধতি, ডিজিটাল কমার্স প্রমোশন ও নীতিমালা পর্যালোচনার বিস্তারিত রয়েছে।কর্মপরিকল্পনায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী ৬০টি করণীয় ঠিক করা হয়েছে। এগুলোকে ১৪টি বিষয়ভিত্তিক উদ্দেশ্যে ভাগ করা করে প্রাথমিক বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও প্রত্যাশিত ফলাফলের উল্লেখ করা হয়েছে নীতিমালার কর্মপরিকল্পনা পরিশিষ্ট-১ এ।
নীতিমালার প্রস্তাবনার বলা হয়েছে, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের মাধ্যমে দেশব্যাপী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অবকাঠামো তৈরি, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ই-গভর্নেন্স প্রতিষ্ঠা এবং আইটি শিল্প বিকাশে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। মোবাইল প্রযুক্তি এক্ষেত্রে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে সারাদেশ ৩-জি নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত এবং ৪-জি নেটওয়ার্ক ইতোমধ্যে চালু হয়েছে। উল্লেখ্য, সারাদেশে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে আইসিটি নেটওয়ার্ক কানেক্টিভিটি এর আওতায় প্রান্তিক বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে ই-সেবা এবং মোবাইল ব্যাংকিং এর আওতাভুক্ত করেছে। ফলে দেশে ডিজিটাল কমার্স অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি, উদ্যোক্তা তৈরি এবং গ্রামীণ ও মফস্বল এলাকার বৃহত্তর বেকার জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দেশের জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি কেন্দ্রীয় সেল গঠন করা হবে। মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সংশ্লিষ্ট এই কেন্দ্রীয় সেল ডিজিটাল কমার্স বা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানসমূহের তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে।
ই-কমার্সে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে এতে বলা হয়েছে, ডিজিটাল কমার্স বা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোভোক্তা অধিকার সংক্রান্ত বিদ্যমান বিধি-বিধান প্রতিপালন করবে, সাইটে বিক্রির জন্য উপস্থাপিত পণ্য সামগ্রী যথাযথ মানসম্মত হবে, ক্রেতার স্বার্থ সংরক্ষণে ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে বিক্রয়যোগ্য পণ্যের যথাযথ বিবরণ এবং এ সংক্রান্ত শর্তাবলী উল্লেখ থাকবে, বিধি অনুযায়ী বিক্রিত পণ্যের ফেরত বা মূল্যফেরত বা প্রতিস্থাপন শর্তাবলী ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করবে এবংভোক্তা অধিকার সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ যেমন, মার্কেটপ্লেস, উদ্যোক্তা, ডেলিভারিসিস্টেম, পেইমেন্ট সিস্টেম ইত্যাদির মধ্যে চুক্তি থাকবে।ডিজিটাল কমার্সের পেইমেন্টের নিরাপত্তার স্বার্থে ‘এসক্রো সার্ভিস’ চালু করার কথা বলা হয়েছে নীতিমালায়। পেইমেন্ট সংক্রন্ত বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে রয়েছেপ্রি-পেইড কার্ড, ভার্চুয়াল কার্ড, ওয়ালেট কার্ডসমূহ এজেন্ট বা ডিজিটাল কমার্স সাইটের মাধ্যমে প্রচারে ব্যবস্থা গ্রহণ, ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিং, প্রি-পেইড কার্ড, ক্রেডিট কার্ডসহ সমস্ত পেইমেন্ট পদ্ধতি ন্যাশনাল পেইমেন্ট সুইচের সাথে সংযুক্ত রেখেরিয়ালটাইম ফান্ড ট্রান্সফারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বৈধ পথে আন্ত:দেশীয় অনলাইন কার্ডভিত্তিক লেনদেন সম্প্রসারণে ট্রাভেলার্সকোটা ওঅনলাইন লেনদেনের কোটা বর্ধিতকরণ ও যুগোপযোগীকরণের ব্যবস্থা নেয়া ও লেনদেনের ক্ষেত্রে ডিজিটাল স্বাক্ষর ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হবে। ই-কমার্স সেক্টরের সার্বিক উন্নয়নে একটি সেন্টার অব এক্সিলেন্স গঠন করা হবে। এছাড়া ডিজিটাল কমার্স সম্পর্কিত বিষয়সমূহে গবেষণা পরিচালনা, তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ, সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে বিদ্যমান ও উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ বা অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল গঠন করার বলা হয়েছে নীতিমালায়।এ খাতে পাইরেসি, হ্যাকিংসহ ডিজিটাল কমার্স খাতসংশ্লিষ্ট সকল সাইবার অপরাধ, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিদ্যমান ও উদ্ভূত ঝুঁকি চিহ্নিতকরণ, ব্যবস্থাপনা ও তদারকি নিশ্চিতকরণে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল ব্যবস্থা নেবে। কোনো অপরাধ চিহ্নিত হলে তা দেশে প্রচলিত সংশ্লিষ্ট আইনে পড়বে।ডিজিটাল কমার্স ব্যবসা পরিচালনা, বিক্রয়কৃত পণ্য সরবরাহ ও আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত নিরাপত্তা, নিয়ন্ত্রণ, তদারকি এবং এ সকল কর্মকাণ্ড হতে উদ্ভূত অসন্তোষ নিরসন ও অপরাধসমূহের বিচার সম্পর্কিত কার্যক্রম পরিচালনায় একটি সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামো প্রণয়ন করার করার কথা উল্লেখ রয়েছে নীতিমালায়।ভোক্তাদের জন্য প্রণয়ন করা হবে একটি সুনির্দিষ্ট কোড অব কন্ডাক্ট। খাতটিতে মোবাইল অপারেটরদের নেট নিরপেক্ষতা বজায় রাখার বিধি-বিধান প্রতিপালন করার কথা বলা হয়েছে। এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিধি-বিধান প্রতিপালন কথা বলা হলেও তবে বিদেশি ডিজিটাল কমার্স ইন্ডাস্ট্রি দেশীয় কোনো ইন্ডাস্ট্রির সাথে যৌথ বিনিয়োগ ব্যতীত এককভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে না। যৌথ বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও দেশীয় ডিজিটাল কমার্স ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থসমূহকে প্রাধান্য দেয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে নীতিমালায়। এসব বিষয় ছাড়াও ডিজিটাল কমার্সের বিভিন্ন বিষয়ে এতে গাইডলাইন দেয়া হয়েছে। তথ্যসূত্র: টেকশহর ডটকম।