কুকুরের প্রভুভক্তির কথা সবার জানা। কোনো জিনিস শনাক্ত করার তীক্ষ্ণ ঘ্রাণশক্তি থাকায় অনুসন্ধানের মতো কাজে কুকুরের ব্যবহারও অনেক দিনের। বিশেষত ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধারকাজে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া মানুষের উপস্থিতি বুঝতে কুকুরের এই তীব্র ঘ্রাণশক্তি ভীষণ সহায়ক হয়ে ওঠে। কিন্তু কখনো কখনো দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতি এমন হয় যে ঘটনাস্থলে রক্ত-মাংসের কুকুর নিয়ে যাওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে উদ্ধারকর্মীদের সহায়তার জন্য বিজ্ঞানীরা এবার হাজির করেছেন ইলেকট্রনিক কুকুর। এই ই-কুকুর আর কিছুই নয়, গন্ধ শনাক্ত করার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সেন্সর। আকারে ক্ষুদ্র ও স্বল্পমূল্যের এই সেন্সর ব্যবহার করে এখন খুব সহজেই উদ্ধার তৎপরতা চালানো যাবে বলে দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা।
ভূমিকম্প বা ভূমিধসের কারণে সৃষ্ট ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া মানুষের অবস্থান শনাক্তে প্রশিক্ষিত কুকুর এখনো উদ্ধারকর্মীদের সবচেয়ে বড় বন্ধু। কিন্তু দুর্ঘটনাস্থলে কুকুর নিয়ে যাওয়াটা কখনো কখনো বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। আবার অন্য যেকোনো জীবিত প্রাণীর মতোই কুকুরেরও বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। ফলে একনাগাড়ে উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন হয়ে পড়ে অনেক সময়। এই সংকট মাথায় রেখেই সুইজারল্যান্ডের ইটিএইচ জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক তৈরি করেছেন ই-কুকুর। প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক সোটিরিস প্র্যাটসিনিসের নেতৃত্বে এই বিশেষ ধরনের যন্ত্রটি তৈরি করেন, যা কুকুরের মতোই ঘ্রাণ শনাক্ত করতে পারে এবং যার কোনো বিশ্রামের প্রয়োজন হয় না। এ-সম্পর্কিত গবেষণা নিবন্ধটি অ্যানালিটিক্যাল কেমিস্ট্রি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
এই উত্তরণ এক দিনে হয়নি। এর আগে বিজ্ঞানীরা একধরনের গ্যাস সেন্সর তৈরি করেছিলেন, যা এসিটোন, অ্যামোনিয়া ও আইসোপ্রিনের মতো কিছু গ্যাসের উপস্থিতি শনাক্ত করতে পারত। মূলত, মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস ও ত্বক থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন রাসায়নিকের শনাক্তের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সেন্সর তৈরিই ছিল মূল লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে সফল হয়ে বিজ্ঞানীরা এই সেন্সরের ক্ষমতা বৃদ্ধি করার দিকে মনোযোগ দেন। একই সঙ্গে এই সেন্সরকে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও জলীয় বাষ্প শনাক্তে সক্ষম সেন্সরের সঙ্গে যুক্ত করে একে একটি পূর্ণ মাত্রা দেন।
কতটা কার্যকর এই ই-কুকুর। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সাইপ্রাস ও অস্ট্রীয় বিজ্ঞানীদের সহযোগিতায় পরীক্ষাগারে বিশেষ এই সেন্সর পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। এতে যে ফল পাওয়া গেছে, তা বেশ সন্তোষজনক। অস্ট্রিয়ার ইনসব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রেথ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাগারে এই সেন্সরের ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়েছে।
পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফল পাওয়া গেছে জানিয়ে অধ্যাপক সোটিরিস প্র্যাটসিনিস সায়েন্স ডেইলিকে বলেন, এই ধরনের সেন্সরের একই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের যৌগ শনাক্তের ক্ষমতা থাকাটা জরুরি। কারণ, কোনো নির্দিষ্ট একটি রাসায়নিকের উৎস মানুষ ছাড়া অন্য কিছুও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ কার্বন ডাই-অক্সাইডের কথা বলা যায়, যা সমাহিত মানুষ কিংবা কোনো অগ্নি উৎস থেকেও আসতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে মানুষের বিপাকক্রিয়া থেকে সৃষ্ট রাসায়নিক, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও জলীয় বাষ্প শনাক্তে সক্ষম এই সেন্সর ধ্বংসস্তূপের নিচে জীবিত মানুষের উপস্থিতি সম্পর্কে উদ্ধারকর্মীদের অনেকটাই নিশ্চিত করতে পারে।
ইটিএইচের বিজ্ঞানীরা যে সেন্সর তৈরি করেছেন, তা একটি কম্পিউটার চিপের মতোই ছোট। এর ক্ষমতা সম্পর্কে প্র্যাটসিনিস বলেন, ‘এটি যেকোনো আয়ন শনাক্তকারী স্পেকট্রোমিটারের মতোই সংবেদনশীল। তফাত হলো এটি অতি ক্ষুদ্র। দামও কম। বিপরীতে স্পেকট্রোমিটারের আকার একটি প্রমাণ সাইজের স্যুটকেসের সমান। পরবর্তী ধাপে আমরা এর সক্ষমতা সত্যিকারের দুর্ঘটনাস্থলে পরীক্ষা করে দেখতে চাই। তারপরই এটি বাজারজাত করার কথা চিন্তা করা হবে।’