এবার ‘সূর্য ছোঁয়ার’ ঐতিহাসিক মিশনের চূড়ান্ত পর্বে নেমেছে নাসা। সূর্যকে ছুঁতে এই প্রথম রওনা হল সভ্যতা। চাঁদের মাটিতে পা দেওয়ার ৪৯ বছর পর। রোববার দুপুরে ফ্লোরিডায় নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী ‘ডেল্টা ফোর হেভি রকেট’-এর কাঁধে চেপে মহাকাশে পাড়ি জমালো ‘সূর্যমুখী’ মহাকাশযান ‘পার্কার সোলার প্রোব’। গতকাল শনিবারই তার রওনা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রযুক্তিগত ব্যাপারে গতকাল নাসার পরীক্ষায় ডেল্টা ফোর রকেট ১০০ শতাংশ নম্বর না পাওয়ায় পিছিয়ে যায় উৎক্ষেপণ।
কোন রুটে সূর্যের মুলুকে পৌঁছবে পার্কার মহাকাশযান?
পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করতে করতে পার্কার সোলার প্রোব শুক্র গ্রহে (ভেনাস) পৌঁছবে আজ থেকে দেড় মাস পর, অক্টোবরে। তারপর আরও অনেক অনেক পথ পেরোতে হবে ওই মহাকাশযানকে সূর্যের মুলুকে পৌঁছতে। আর সেই পথ পেরোতে সময় লাগবে কম করে ২ থেকে ৪ বছর।
যার মানে, ২০২০ সালের অগস্টের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম সৌর মুলুকে ‘পা’ ছোঁয়াবে পার্কার মহাকাশযান। তারপর তা আরও এগিয়ে সূর্যের বায়ুমণ্ডলের একেবারে বাইরের স্তর বা করোনায় ঢুকে পড়বে ২০২২ সালের মাঝামাঝি।
সূর্যের ‘পাড়া’য় ঢুকে পড়ার পর টানা ৭ বছর ধরে বিভিন্ন কক্ষপথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবে নাসার এই মহাকাশযান। সেই প্রদক্ষিণের সময় কখনও তা কাছে আসবে সূর্যের, কখনও কিছুটা দূরে চলে যাবে। নাসার মহাকাশযানটি যখন সবচেয়ে কাছে চলে যাবে সূর্যের, তখন সূর্যের পিঠ (সারফেস) থেকে তার দূরত্ব হবে মাত্র ৩৮ লাখ ৩০ হাজার মাইল।
এর আগে সৌর মুলুকের উদ্দেশে বিভিন্ন দেশ প্রায় গোটা পঞ্চাশেক মহাকাশযান পাঠালেও, পার্কার সোলার প্রোবই প্রথম কোনও মহাকাশযান, যা এত কাছাকাছি পৌঁছতে চলেছে সূর্যের। আর তা কার্যত ছুঁতেই চলেছে সূর্যকে! কারণ পার্কার সোলার প্রোবই প্রথম মহাকাশযান, যা ঢুকে পড়বে সূর্যের বায়ুমণ্ডলের একেবারে বাইরের স্তর বা করোনায়।
বিশিষ্ট সৌরপদার্থবিজ্ঞানী ইউজিন নিউম্যান পার্কারের নামেই এই মহাকাশযানের নামকরণ করেছে নাসা। পার্কারই প্রথম কোনও বিজ্ঞানী, জীবিত থাকা অবস্থায় যার নামে কোনও মহাকাশযানের নামকরণ করল নাসা।
কী কী কাজ করবে নাসার এই মহাকাশযান?
নাসার তরফে জানানো হয়েছে, সৌরবায়ু, সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্র, চৌম্বক ঝড়ের কারণ আর তাদের আচার-আচরণ জানতে-বুঝতে জীবনের বিভিন্ন সময়ে যে সব তাত্ত্বিক পূর্বাভাস দিয়েছিলেন পার্কার, তার ভিত্তিতে পার্কার সোলার প্রোবসহ মোট ৩৫টি অভিযান করেছে নাসা। এখনও পর্যন্ত আর কোনও বিজ্ঞানীর তাত্ত্বিক পূর্বাভাসের ভিত্তিতে এত বেশি সংখ্যায় অভিযান পাঠায়নি নাসা।
সৌরপদার্থবিজ্ঞানী, ভারতের আসন্ন সৌর অভিযান ‘আদিত্য-এল-ওয়ান’ প্রকল্পের অন্যতম অধ্যাপক দিব্যেন্দু নন্দী বলছেন, ‘শুধুই সূর্য নয়, আর কোনও তারা বা নক্ষত্রেরই এত কাছাকাছি আমরা এক দিন পৌঁছতে পারিনি। সূর্যের বায়ুমণ্ডলে যে গতিবেগে ঢুকে পড়বে পার্কার সোলার প্রোব, সেই ঘণ্টায় ৭ লাখ কিলোমিটার গতিবেগে মহাকাশে এর আগে ছোটেনি কোনও মহাকাশযান।’
করোনার তাপমাত্রা কত? সৌরবায়ু কী জিনিস?
পার্কার মহাকাশযান সূর্যের বায়ুমণ্ডলের একেবারে বাইরের স্তর বা ‘করোনা’য় পৌঁছাবে। সূর্যের করোনার তাপমাত্রা গড়ে ১০ লাখ বা তার কিছু বেশি ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সূর্যের পিঠের তাপমাত্রা মাত্র ৬ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে করোনার তাপমাত্রা সর্বত্র সমান নয়। তা বাড়া-কমা করে। করোনায় রয়েছে প্লাজমা। যা ইলেকট্রন আর প্রোটন কণিকায় ভরা।
আর ওই দু’টি কণার ছোটাছুটি থেকেই সোলার উইন্ড বা সৌরবায়ুর জন্ম হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানী পার্কারই প্রথম সেই সৌরবায়ুর পূর্বাভাস দিয়েছিলেন তার তাত্ত্বিক গবেষণাপত্রে। সূর্য থেকে বেরিয়ে আসা শক্তিশালী কণা ওর চৌম্বক ক্ষেত্রগুলোকে নিয়ে সৌরবায়ু বেরিয়ে আসে সূর্যের থেকে। আর তা ছড়িয়ে পড়ে আমাদের সৌরমণ্ডলের একেবারে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। ধেয়ে আসে পৃথিবীর দিকেও। সাধারণত, সৌরবায়ুর গতিবেগ হতে পারে সেকেন্ডে ৫০০ কিলোমিটার। তবে নাসা জানাচ্ছে, তার গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় ১৮ লাখ মাইলও!
কী কী ক্ষতি হতে পারে সৌরবায়ু থেকে?
বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের অধ্যাপক দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও কলকাতার ‘আইসার’-এর অধ্যাপক দিব্যেন্দু নন্দী জানাচ্ছেন, সৌরবায়ুর মধ্যে থাকা চৌম্বক ক্ষেত্র ও শক্তিশালী কণাদের জন্য পৃথিবীর যাবতীয় টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা এবং জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম)) নেটওয়ার্কে বড় ধরনের গোলযোগ হতে পারে। আর সেই সৌরবায়ুর সঙ্গে যদি হাত মেলায় সৌর চৌম্বক ঝড় (সোলার ম্যাগনেটিক স্টর্ম), তাহলে তা আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে আমাদের পক্ষে। কারণ তা বিশ্বের পাওয়ার গ্রিড তো নষ্ট করে দেয়ই, নষ্ট করে দিতে পারে বিভিন্ন কক্ষপথে থাকা কয়েক হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ (স্যাটেলাইট)-কেও।
৬০ বছর আগে এই সৌরবায়ুর কথা আমাদের জানা ছিল না। পার্কারই প্রথম তার তাত্ত্বিক গবেষণাপত্রে ওই সৌরবায়ুর অস্তিত্বের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন।
কোন কোন ক্ষেত্রে দিশা দেখাতে পারে পার্কার সোলার প্রোব?
দিব্যেন্দু ও দীপঙ্কর বলছেন, ‘এই মহাকাশযানের দৌলতে সভ্যতা এই প্রথম সূর্যের এত কাছাকাছি পৌঁছাতে পারছে বলে এই প্রথম অনেক বেশি নিখুঁতভাবে মাপা সম্ভব হবে সৌরবায়ুর মধ্যে থাকা চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তি, ঘনত্ব ও শক্তিশালী কণাদের গতিবেগ।’
দিব্যেন্দু জানাচ্ছেন, তাপগতিবিজ্ঞানের যাবতীয় নিয়ম উপেক্ষা করে কেন সূর্যের পিঠের (যার তাপমাত্রা বড়জোড় ৬ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস) চেয়ে পিঠ থেকে বহু বহু দূরে থাকা সূর্যের করোনার তাপমাত্রা অত বেশি (১০ লাখ বা তার বেশি ডিগ্রি সেলসিয়াস) হয়, তা নিয়ে এখনও যে সংশয় রয়েছে, পার্কার সোলার মিশনের পাঠানো তথ্য তা দূর করতে পারে। জানা যাবে কেমনভাবে জন্ম হয় সৌরঝড়ের। কীভাবে সূর্যের বায়ুমণ্ডলের একেবারে বাইরের স্তর (করোনা) থেকে বেরিয়ে আসে সৌরবায়ু।
দু’বছর পর ‘আদিত্য-এল-ওয়ান’
২০২০ সালে সূর্যের মুলুকে যাবে ইসরোর পাঠানো প্রথম কোনও মহাকাশযান। যার নাম- ‘আদিত্য-এল-ওয়ান’। ওই মহাকাশযান পৌঁছবে পৃথিবী আর সূর্যের মধ্যে ল্যাগরাঞ্জে-১ পয়েন্ট পর্যন্ত।
তবে ভারতের ‘আদিত্য-এল-ওয়ান’ প্রকল্পের অন্যতম বিজ্ঞানী দেশের বিশিষ্ট সৌরপদার্থবিদ দিব্যেন্দু নন্দী বলছেন, ‘পার্কার সোলার প্রোব সূর্য আর পৃথিবীর মধ্যে যতটা দূরত্ব পেরোবে, আমাদের আদিত্য-এল-ওয়ান পেরোবে তার মাত্র এক শতাংশ দূরত্ব।’
তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার