সিমকার্ডের ইলাবরেশন হলো সাবস্ক্রাইবার আইডেন্টিফিকেশন মডিউল (SIM)। প্রশ্ন হলো, এই সিমকার্ড কে বা কারা প্রথম বানিয়েছিলো? প্রথম সিমকার্ড কে বানিয়েছিলো সেটা বলাটা একটু কঠিনই বটে। কারণ, প্রথম সিমকার্ড তৈরি করে একটি জার্মান কোম্পানি। সেই কোম্পানির কে প্রথম সিমকার্ড বানিয়েছিলো, তা তো আর আলাদা করে বলা যায় না, তাই না? জার্মানির সেই কোম্পানিটির নাম জিসেকে অ্যান্ড ডেভ্রিয়েন্ট, সংক্ষেপে জিঅ্যান্ডডি (Giesecke & Devrient)। কোম্পানিটির হেডকোয়ার্টার জার্মানির মিউনিখ শহরে। ১৯৯১ সালে পৃথিবীর প্রথম সিমকার্ডও সেখানেই বানানো হয়। তবে তাদের বানানো সিমকার্ড প্রথম যে কোম্পানি কেনে, সেটি কোনো জার্মান কোম্পানি নয়। ফিনল্যান্ডের কোম্পানি রেডিওলিনজা ওদের বানানো প্রথম ৩শ’টি সিমকার্ড কিনে নেয়। শুধু তাই নয়, পৃথিবীতে প্রথম এসএমএস (শর্ট মেসেজ সার্ভিস) সেবাও ওরাই প্রথম চালু করে, ১৯৯৩ সালে। প্রথম রিংটোন কিনে ডাউনলোড করার ব্যবস্থাও করে ওরা। সেটা ১৯৯৮ সালে। পৃথিবীর প্রথমদিকের সেই সিমকার্ডগুলো কিন্তু দেখতে এখনকার মতো ছিল না। সে সময়ের একেকটা সিমকার্ড আকৃতিতে ছিলো এখনকার একেকটা ডেবিট/ক্রেডিট কার্ডের সমান!
ক্রেডিট কার্ড আকৃতির সিম
সেটাকে বলা হয় ফুল-সাইজ সিমকার্ড। কার্ডগুলোতে তথ্য ধারণক্ষমতা ছিলো ৩২ থেকে ১২৮ কিলোবাইট পর্যন্ত। যেখানে এসএমএস-এর মেসেজ এবং ফোনবুকের কন্টাক্ট নম্বরগুলো সংরক্ষণ করে রাখা যেত। প্রথমে বের হওয়া এই সিমের মডেলগুলোতে সর্বসাকুল্যে মোটে ৫টি মেসেজ এবং ২০টি কন্টাক্ট নম্বর সংরক্ষণ করা যেতো।
পরে সিমকার্ডের আকৃতি ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসে। আমরা যা ব্যবহার করি, তার নাম মিনি-সিমকার্ড। এর চেয়েও ছোট আকৃতির আরো তিন ধরনের সিমকার্ড আছে- মাইক্রো-সিমকার্ড, ন্যানো-সিমকার্ড আর এমবেডেড-সিমকার্ড।যত দিন গিয়েছে সিমকার্ডের আকার তত ছোট হয়েছে। আসুন এবার দেখা যাক সিমকার্ডগুলোর আকৃতির পরিবর্তনের ধারাটি।
মিনি-সিম :
১৯৯৬ সালে ক্রেডিট কার্ড আকৃতির সিমগুলোর (যেগুলোকে বর্তমানে ‘ফুল-সাইজড’ বা 1FF বলা হয়) জায়গা দখল করে নেয় মিনি-সিম। ১৯৯০ সালের শেষের দিক থেকে পরবর্তী এক যুগ যাদের কাছে মুঠোফোন ছিলো তাদের কাছে মিনি-সিমগুলো ছিলো পরিচিত একটি বস্তু। তখনকার প্রত্যেকটি মুঠোফোনে মিনি-সিম ব্যবহার করার মতো উপযোগী ট্রে থাকতো। মিনি-সিম যে বিশেষ সুবিধা বয়ে এনেছিলো ব্যবহারকারীদের জন্য তা হলো তারা খুব সহজেই অন্য বা নতুন ফোনে নিজেদের সিমকার্ডটি তুলে ব্যবহার করতে পারতেন।
সিমকার্ডের এই বহনযোগ্যতা ঐতিহাসিক এক পরিবর্তনই এনে দেয় বলা চলে। ব্যবহারকারীদের নতুন প্রযুক্তিতে উন্নিত হতে আলাদা কোনো ঝামেলার মুখোমুখিই হতে হতো না। শুধু সিমকার্ডটি তাদের নতুন ডিভাইসে তোলার মাধ্যমেই তারা তাদের পরিচিতি এবং পূর্বের সংরক্ষিত কন্টাক্ট নম্বরগুলোও পার করতে পারতেন। কোনোভাবে ডিভাইসটি ক্ষতিগ্রস্ত বা ব্যবহার অনুপযোগী হলেও ব্যবহারকারী খুব সহজেই সিমকার্ডটি বের করে নতুন ডিভাইসে তা সংযুক্ত করে পুনরায় জিএসএম নেটওয়ার্কে ফিরে আসতে পারতেন।
মাইক্রো-সিম :
স্মার্টফোনের প্রচলন শুরু হওয়ার পর থেকে মাইক্রো-সিমের প্রচলনও শুরু হয়ে যায়। তবে মাইক্রো-সিমের ছডিয়ে পড়ার পেছনে অ্যাপলের ভূমিকাই সবথেকে বেশি। অ্যাপলের তাদের নতুন জেনারেশনের স্মার্টফোনের জন্য ফোনের ভেতরে কিছুটা স্থান ফাঁকা রাখার প্রয়োজন ছিলো। এজন্য অ্যাপল তাদের আইফোন ৪ বের করার পাশাপাশি মিনি-সিম থেকে মাইক্রো-সিমে চলে আসে। তবে মাইক্রো-সিম কিন্তু ২০১০ সালে আবিষ্কার হয়নি। এটি আবিষ্কার হয়েছে তার অনেক আগেই; ২০০৩ সালে।
মাইক্রো-সিম তৈরি করা হয়েছিলো সেসব ক্ষুদ্র ডিভাইসের কথা মাথায় রেখে যেগুলো আকারে ছোট হওয়ায় মিনি-সিম ব্যবহারে উপযোগী ছিলো না। পাশাপাশি এটি ‘ব্যাকওয়ার্ড কম্পাটিবিলিটি’র কথা মাথায় রেখেও ডিজাইন করা হয়েছিলো। অর্থাৎ এটি এর পূর্বের ভার্সন (মিনি-সিম) কর্তৃক প্রদত্ত ইনপুটেও কাজ করতে সক্ষম ছিলো। অবশ্যই এই ছোট আকারের সিমটি পুরো কার্ডের পারফরমেন্সে কোনো প্রভাব ফেলতো না। কার্ডটির মূল ‘কন্টাক্ট এরিয়া’ একই থাকতো শুধু অতিরিক্ত প্লাস্টিকের অংশটুকু কেটে ফেলা লাগতো।
তবে এই সিমকার্ডটি ২০১০ সালের আগপর্যন্ত ব্যবহার করা হয়নি। অ্যাপল তাদের আইফোনে সর্বপ্রথম মাইক্রো-সিম ব্যবহার করা শুরু করার পর থেকে প্রায় সকল স্মার্টফোনেই মাইক্রো-সিম ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়ে যায়।
ন্যানো-সিম :
স্মার্টফোন আবিষ্কারের পর প্রতিবছরই কোম্পানিগুলো তাদের মডেলগুলোর মানোন্নয়ন করে থাকে। অ্যাপল তাদের আইফোন ৫ বের করার সাথে সাথে ফোনটিতে আকারে আরো ছোট সিমকার্ড ব্যবহার করা সিদ্ধান্ত নেয়। যার ফলে সৃষ্টি হয় ন্যানো-সিমকার্ডের। তবে অ্যাপলের এই সিদ্ধান্তে প্রথমদিকে ক্রেতাদের একটু সমস্যার মুখেই পড়তে হয়। কারণ পুরনো আইফোন থেকে নতুন আইফোন ৫-এ আসতে বা অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীদের আইফোন ৫ ব্যবহার করতে ন্যানো-সিমের দরকার ছিলো। এজন্য হয় তাদেরকে নতুন সিম কিনতে হয়েছিলো বা অ্যাডাপটার ব্যবহার করে পুরনো সিম ন্যানো আকৃতিতে কেটে ফেলতে হয়েছিলো।
তবে ২০১৪ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সকল অ্যান্ড্রয়েড এবং অ্যাপল স্মার্টফোন ন্যানো-সিম প্রযুক্তি সমর্থন করে। বর্তমানে এটিই ধরা চলে সিমকার্ডের স্ট্যান্ডার্ড মাপ। তবে সিমকার্ডের ইতিহাস অধিকাংশটাই হলো এর আকৃতির পরিবর্তন। কে জানে হয়তো এই ন্যানো-সিমকার্ড প্রযুক্তিও একদিন পরিবর্তিত হয়ে যাবে!
সিমকার্ডের ভবিষ্যৎ :
বর্তমানে সিমকার্ড ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। এখন ফোনকলের থেকে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রেই বেশি সিমকার্ড ব্যবহার হচ্ছে। যতদিন যাচ্ছে মানুষ যোগাযোগের জন্য ইন্টারনেটের উপরেই নির্ভর হয়ে পড়ছে বেশি। তাই ভবিষ্যতের সিমকার্ডগুলোও ইন্টারনেট নির্ভর প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হবে তা ধারণা করা যায়।
‘ইন্টারন্যাশনাল কার্ড ম্যানুফ্যাকচার অ্যাসোসিয়েশন’ (ICMA)-এর মতে, ২০১৬ সালে পুরো বিশ্বে প্রায় ৫.৪ বিলিয়ন সিমকার্ড প্রস্তুত করা হয়েছিলো। সেই সাথে ৭ বিলিয়ন ডিভাইস সিমকার্ড ব্যবহার করে থাকে বৈশ্বিক বেতার নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে। বিভিন্ন ব্যান্ডউইথডের তারতম্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে টু-জি, থ্রি-জি সিম। যেগুলো কমখরচে সেলুলার নেটওয়ার্কে সংযুক্ত হবার সুবিধা প্রদান করে থাকে। তবে উচ্চ ব্যান্ডউইথ সম্বলিত ফোর-জি সিমও রয়েছে যেগুলো দ্রুত ও বড় ডেটা ট্রান্সফার এবং মাল্টিমিডিয়া মূলক কার্যসিদ্ধিতে যথেষ্ট উপযোগী।
২০২০ সালের মধ্যে ধরা হচ্ছে ৫-জি সবখানে ছড়িয়ে যাবে। তাই ৫-জির কথা মাথায় রেখে সিমকার্ডের পরিবর্তন এবং মানোন্নয়নেও নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন পদ্ধতি। ‘দ্য জিএসএম অ্যাসোসিয়েশন’, যারা মূলত সিমকার্ডের ডিজাইন এবং গবেষণা করে থাকে, তারা ইতোমধ্যে ই-সিম (Embedded SIM) আবিষ্কার করেছে।নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে ই-সিম আসলে ডিভাইসেই স্থায়ীভাবে সংযুক্ত করে দেওয়া হবে।
এগুলো আকারে হবে ন্যানো-সিম থেকেও ক্ষুদ্র। ফলে অনেক ক্ষুদ্র ডিভাইসেও সিমকার্ড প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাবে, যেমন: স্মার্টওয়াচ। ই-সিমের তথ্য পরিবর্তনযোগ্য হবে এবং যেকোনো নেটওয়ার্ক অপারেটরেই সিমটি কাজ করবে। ফলে অপারেটরদের আলাদা করে সিমকার্ড তৈরি করে বাজারজাত করতে হবে না। তারা আগের মতোই দূর থেকে সিমকার্ডটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। ব্যবহারকারীরাও খুব সহজে এক অপারেটর থেকে আরেক অপারেটরের নেটওয়ার্কে চলে আসতে পারবে। এজন্য তাদের আলাদা কোনো সিমকার্ড কিনতে হবেনা বা ফোনেও সংযুক্ত করতে হবেনা।