দেশে যখন আসল ব্র্যান্ড পিসি বিক্রি হয় ১ লাখ ৫১ হাজার ২০০টি সেখানে ক্লোন পিসি ১ লাখ ৭৪ হাজার ৭২০টি আমদানি করা হয়। ২০১৫ সালের তথ্য এটি। এখনকার কি অবস্থা? পুরো পিসির বাজার আর ব্যবহারকারীর কথা জানতে মন চাইছে নিশ্চয়ই!
পিসি আমদানিকারক, বাজার, ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত এবং জরিপের মাধ্যমে এই পরিসংখ্যান করেছে মাসিক কমপিউটার জগৎ। বর্তমানে দেশে মোট জনস্যংখ্যার মাত্র ৬ শতাংশ পিসি (পার্সোনাল কম্পিউটার) ব্যবহার করছেন। ২০১৭ সালে দেশে মোট কম্পিউটার ব্যবহারকারী ছিলো ৯৪ লাখ ২ হাজার ৫৭৬ জন। এর মধ্যে ল্যাপটপ ব্যবহারকারী ৪৯ লাখ ৫৩ হাজার ৫৫২ জন, ব্র্যান্ড পিসি ব্যবহারকারী ২০ লাখ ৬৩ হাজার ৯৮০ জন এবং ক্লোন পিসি ব্যবহারকারী ২৩ লাখ ৪৪ হাজার ৪৪ জন।
পিসি আমদানিকারক, বাজার, ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত এবং জরিপের মাধ্যমে এই পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর গবেষণা সেল থেকে তৈরি এই প্রতিবেদন নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের কাছে পিসি সহজলভ্য না হওয়া এবং গত ৫ বছরে উদ্ভাবনী কোনো মার্কেটিং টুল তৈরি না হওয়ায় পিসি’র বাজার প্রবৃদ্ধি এখনও তলানিতে পড়ে রয়েছে।
কমপিউটার জগৎ গবেষণা সেলের এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালে দেশে সর্বমোট ৬ লাখ ৮৮ হাজার ৮০০টি কম্পিউটার বাংলাদেশে আমদানি করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয় ল্যাপটপ, যা সংখ্যায় ৩ লাখ ৬২ হাজার ৮৮০টি।
এছাড়া ব্র্যান্ড পিসি ১ লাখ ৫১ হাজার ২০০টি এবং ক্লোন পিসি ১ লাখ ৭৪ হাজার ৭২০টি আমদানি করা হয়। আর একই সময়ে বাংলাদেশে মোট কম্পিউটার ব্যবহারকারীর ছিল ৬৩ লাখ ১৮ হাজার ৫৩১ জন। এর মধ্যে ল্যাপটপ ব্যবহারকারী ৩৩ লাখ ২৮ হাজার ৭৮৭ জন, ব্র্যান্ড পিসি ব্যবহারকারী ১৩ লাখ ৮৬ হাজার ৯৯৫ জন এবং ক্লোন পিসি ব্যবহারকারী ১৬ লাখ ২ হাজার ৭৪৯জন।
অপরদিকে ২০১৬ সালে সর্বমোট ৮ লাখ ২০ হাজার কম্পিউটার আমদানি করা হয়। এগুলোর মধ্যে ল্যাপটপ ৪ লাখ ৩২ হাজার, ব্র্যান্ড পিসি ১ লাখ ৮০ হাজার এবং ক্লোন পিসি ছিল ২ লাখ ৮ হাজার। ২০১৭ সালে সর্বমোট ১০ লাখ ২৫ হাজার কম্পিউটার আমদানি করা হয়।
ওই সময়ে বাংলাদেশে কম্পিউটার ব্যবহারকারী ছিল ৭৫ লাখ ২২ হাজার ৬১ জন। এর মধ্যে ল্যাপটপ ব্যবহারকারী ৩৯ লাখ ৬২ হাজার ৮৪২ জন, ব্র্যান্ড পিসি ব্যবহারকারী ১৬ লাখ ৫১ হাজার ১৮৪ জন এবং ক্লোন পিসি ব্যবহারকারী ১৯ লাখ ৮ হাজার ৩৫ জন।
আর সবশেষ ২০১৭ সালে দেশে মোট ১০ লাখ ২৫ হাজার কম্পিউটার আমদানি হয়। এর মধ্যে ৫ লাখ ৪০ হাজার ল্যাপটপ, ২ লাখ ২৫ হাজার ব্র্যান্ড পিসি এবং ২ লাখ ৬০ হাজার ক্লোন পিসি আমদানি করা হয়। এর মধ্যে সরকার ক্রয় করে প্রায় ১ লাখ ইউনিট।
পুরনো ব্যবহারকারীদের মধ্য থেকে নতুন ইউনিট ক্রয় করা হয় প্রায় ৩ লাখ। কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার ফলে স্কুল ও কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিক্রি হয়েছে প্রায় ৩ লাখ ইউনিট। আর অফিস এবং সাধারণ নতুন ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিক্রি হয়েছে প্রায় ৩ লাখ ২৫ হাজার ইউনিট।
পক্ষান্তরে, ২০১৭ সাল শেষে দেশে কম্পিউটার ব্যবহারকারী ছিল ৯৪ লাখ ২ হাজার ৫৭৬ জন। এর মধ্যে ল্যাপটপ ব্যবহারকারী ৪৯ লাখ ৫৩ হাজার ৫৫২ জন, ব্র্যান্ড পিসি ব্যবহারকারী ২০ লাখ ৬৩ হাজার ৯৮০ জন এবং ক্লোন পিসি ব্যবহারকারী ২৩ লাখ ৪৪ হাজার ৪৪ জন। অর্থাৎ ১৬ কোটির এই ডিজিটাল বাংলাদেশে মাত্র ৬ শতাংশ মানুষ কম্পিউটার ব্যবহার করছে।
আমদানি ও বিক্রির এই হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, দেশে ডেস্কটপের চেয়ে ল্যাপটপের ব্যবহার বেড়েছে। ২০১৭ সালে দেশে মোট পিসি ব্যবহারকারী ছিল ৯৪ লাখ ২ হাজার ৫৭৬ জন। এর আগের বছর এই অঙ্কটা ছিল ৭৫ লাখ ২২ হাজার ৬১। আর ২০১৫ সালে মোট পিসি ব্যবহারকারী ছিল ৬৩ লাখ ১৮ হাজার ৫৩১। মোট পিসি ব্যবহারকারীর মধ্যে ল্যাপটপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। ১৬ থেকে ১৭ সালে ল্যাপটপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ লাখের মতো বেড়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালে দেশে কম্পিউটার আমদানির প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ শতাংশ। ২০১৭ সালে এই হার মাত্র ৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ২০ শতাংশ। কিন্তু বাজার চাহিদা ও আকার অনুযায়ী প্রবৃদ্ধির এই হার হতাশাজনক। কেননা মেধাভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার অন্যতম হাতিয়ার পার্সোনাল পিসি বা ব্যক্তিগত কম্পিউটার তথা ডেস্কটপ ও ল্যাপটপ। উপরন্তু বর্তমান সরকার শিক্ষার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করলেও এই বাজার কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী বাড়েনি।
সূত্রমতে, দেশে ২০১৭ সালের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৭ লাখ ৮৬ হাজার ৬১৩ জন। এই সংখ্যাটা ২০১৬ সালের চেয়ে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৯০ জন বেশি। আবার ২০১৭ সালে সব শিক্ষা বোর্ডে এইচএসসিতে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১১ লাখ ৮৩ হাজার ৬৮৬ জন।
২০১৬ সালে এই সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ১৮ হাজার ৬২৮। অর্থাৎ শুধু এসএসসি ও এইচএসসি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল মোট ২৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৯৯ জন। কিন্তু একই সময়ে দেশে আমদানিকৃত পিসির সংখ্যা থেকে দেখা যায় বাজারে বিক্রি হওয়া মোট পিসির সংখ্যা এসএসসি ও এইচএসসি শিক্ষার্থী সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ।
এই শিক্ষার্থীদের এক-চতুর্থাংশের হাতেও যদি কম্পিউটার পৌঁছে দেয়া যেত, তাহলে এই বাজার প্রবৃদ্ধি সহজেই ২৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যেত। দেশে কম্পিউটার ব্যবহারকারীর সংখ্যা ডাবল ডিজিট ছুঁতে পারত। বাজার পরিস্থিতির উন্নয়নে দেশে মোট জনসংখ্যার সাথে আনুপাতিক হারে কম্পিউটার ব্যবহারকারী বাড়াতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে সবাইকে কম্পিউটার ব্যবহারের আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন এ খাত-সংশ্লিষ্টরা।
তাদের ভাষায় যিনি কম্পিউটার জানেন এবং নিজের একটি পিসি ব্যবহার করেন কয়েক বছর পর দেখা যায় ওই একই ব্যক্তি পুরনো পিসি বদল করে নতুন পিসি কিনছেন। এতে আপাতদৃষ্টিতে কম্পিউটার বিক্রি হলো ঠিকই কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যবহারকারী বাড়ল না। দেশের লাখ লাখ শিক্ষিত বেকারকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কম্পিউটারসহ অন্যান্য প্রযুক্তিপণ্য সহজ শর্তে দেয়া যেতে পারে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি (বিসিএস) সভাপতি সুব্রত সরকার বলেন, কম্পিউটার ব্যবহারকারী সচেতনতা উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি কোনো দিক থেকেই এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগ না নেয়ার কারণে জনমিতি অনুসারে আমাদের পিসি ব্যবহারকারী কম। গ্রামে-গঞ্জে অনেকেই আছেন যারা ভয়ে কম্পিউটার কেনেন না।
অনেক অভিভাবকই মনে করেন তার কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ের কম্পিউটার ব্যবহারের বয়স হয়নি। আবার ইন্টারনেট বলতেই অনেকে নেতিবাচক বিষয়টিকে আগে দেখেন। কিন্তু পিসিতে যে ইন্টারনেটের খারাপ বিষয়টি সহজেই বেঁধে রাখা যায় সেই বিষয়টি সম্পর্কে তারা অবহিত নন।
বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা এখন পর্যন্ত কেবল পিসি চালানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। কিন্তু পিসির যুৎসই ব্যবহারের ক্ষেত্র বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যবহারকারী বাড়ানোর বিষয়ে মোটেই মনোযোগ দেইনি। সংশ্লিষ্টরা যদি এই জায়গাটায় একটু বিনিয়োগ করেন, তবে এই বাজারটা কিন্তু খুব সহজেই বদলে যাবে। এর সাথে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পড়ে থাকা ব্রডব্যান্ড সংযোগগুলো বেগবান হবে। এতে করে শিক্ষার আন্তর্জাতিকরণের পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতির ভিতও মজবুত হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিএস) মহাসচিব মোশাররফ হোসেন সুমন বলেন, আমাদের অনেক শিক্ষার্থীর হাতেই একটি করে মোবাইল থাকে। কিন্তু একটি বাসার পিসির ব্যবহার করেন কয়েকজন মিলে। সেই অর্থে বিক্রীত পিসির চেয়ে কিন্তু এর ব্যবহারকারী কয়েক গুণ।
আবার বিভিন্ন অ্যাপ উপযোগিতার কারণে মোবাইলের পেনিট্রেশনও বেশি। সঙ্গত কারণে দেশে এই মুহূর্তে পিসির বাজার চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। যদিও পিসির উপযোগিতা কোনো অংশেই কম নয়। বিশেষ করে ভারী কাজের ক্ষেত্রে এবং অবশ্যই শিক্ষার্থীদের জন্য।
এই বিষয়টি মাথায় নিয়ে ইতোমধ্যেই সরকারি উদ্যোগে স্কুলে স্কুলে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। আমরা আশা করছি, এর ফলে খুব শিগগিরই দেশে পিসির ব্যবহার বাড়বে। বিসিএসও প্রশিক্ষণ প্রকল্পের মাধ্যমে এর ৮টি শাখা থেকে শিক্ষার্থী ও বেকার যুবসমাজকে হার্ডওয়্যার প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের মধ্যে পিসির ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
পিসি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান স্মার্ট টেকনোলজি বিডি লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার (মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস) মুজাহিদ আল বেরুনী সুজন বলেন, গত কয়েক বছর ধরে সরকার কিছু ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। এর ফলে পিসি ব্যবহারকারী বাড়ছে। তবে পারিবারিক পর্যায়ে সচেতনতার অভাব ও আর্থিক সঙ্গতির কারণে এখনও এই প্রবৃদ্ধির হারটি ধীর।
প্রান্তিক পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সহজপ্রাপ্য ও সুলভ ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা গেলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই চিত্র পাল্টে যাবে। সচেতনতা বাড়াতে আমরা স্কুল পর্যায়ে বিভিন্ন প্রোগ্রাম করছি। লেখাপড়া, খেলা ও বিনোদনের জন্য এখন কম দামের ডেস্কটপ ও ল্যাপটপ বাজারে রয়েছে। তাছাড়া আমাদের সাথে যদি সফটওয়্যার খাত পিসিনির্ভর কনটেন্ট উন্নয়নে অগ্রসর হয়, তবে স্মার্টফোন-ফেসবুকে বুঁদ না হয়ে আজকের প্রজন্ম সহজেই পিসিমুখী হবে।
শিক্ষার্থী পর্যায়ে পিসির ব্যবহার বিষয়ে কথা হয় রাজবাড়ী জেলা শিক্ষা অফিসার শিক্ষাবিদ সৈয়দ সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ আছে। অভিভাবকরাও কিন্তু সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। কিন্তু সিস্টেমের কারণেই শিক্ষার্থীরা স্মার্টফোন ব্যবহার করলেও পিসি সেভাবে করে না। এর পেছনে তিনটি কারণ রয়েছে। স্কুলগুলোতে ডিজিটাল ল্যাবের অভাব রয়েছে।
দেশে পিসির বাজারের কি অবস্থা? আসল পিসি কত আর কত ক্লোন?
previous post