চলতি সপ্তাহে ১০ ঘণ্টার শুনানিতে অন্তত ১০০ জন কংগ্রেস সদস্যকে মোকাবিলা করেছেন ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ। যাঁদের মধ্যে অনেকেই ফেডারেল ট্রেড কমিশনের (এফটিসি) প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে আসেন। সাহস নিয়ে ঠান্ডা মাথায় জবাবদিহি করেছেন জাকারবার্গ। তবে এখনো মাথার ওপর থেকে ফাঁড়া কাটেনি ফেসবুকের। তাদের মোকাবিলা করতে হবে এফটিসিকে। ফেসবুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে লাখ লাখ কোটি ডলার জরিমানা গুনতে হতে পারে ফেসবুককে। সম্প্রতি এ বিষয়ে মার্কিন সাময়িকী টাইমে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
গত সপ্তাহে ফেসবুক থেকে যুক্তরাজ্যের নির্বাচনী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা তথ্য হাতানোর কেলেঙ্কারির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটরদের সামনে নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় জাকারবার্গকে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ৮ কোটি ৭০ লাখ তথ্য ফেসবুক থেকে হাতিয়ে নিয়েছে—এমন তথ্য জানাজানি হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের কয়েকটি যৌথ কমিটির সামনে শুনানিতে হাজির হতে হয় জাকারবার্গকে। অভিযোগ ওঠে, এসব তথ্য পরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারের কাজে ব্যবহার করা হয়। তবে কংগ্রেস শুনানি বেশ ভালোভাবে মোকাবিলা করলেও এখন জাকারবার্গকে মোকাবিলা করতে হবে ঘটনার তদন্তকারী সংস্থা এফটিসিকে। যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের অধিকার রক্ষায় স্বাধীন সংস্থা হিসেবে কাজ করে এফটিসি।
আইন প্রণয়নের চেয়ে আইন প্রয়োগকারী হিসেবে বেশি কঠোর এফটিসি। এই সংস্থা জালিয়াতি ও প্রতারণার বিষয়ে ভোক্তার অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয় না। অভিযোগ উঠেছে, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে অ্যাপ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল ফেসবুক। ওই অ্যাপের মাধ্যমেই কোটি কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। এরপর এফটিসি ঘোষণা করেছে, ফেসবুকের গোপনীয়তা নীতি নিয়ে তদন্ত শুরু করছে তারা।
এফটিসির ব্যুরো অব কনজিউমার প্রোটেকশনের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক টম পাহল এক বিবৃতিতে বলেন, ‘গ্রাহকদের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য সবকিছু করতে তারা দৃঢ়ভাবে এবং সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ সংস্থাটির এই ঘোষণার পর পুঁজিবাজারে ধস নামে ফেসবুকের শেয়ারের।
‘কনসেন্ট ডিক্রি’ বা সম্মতি চুক্তি অনুযায়ী, ব্যাপক গোপনীয়তা প্রতিষ্ঠা এবং তা বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ফেসবুক। এফটিসির সাবেক কমিশনার ও জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব লর অধ্যাপক উইলিয়াম কোভাসিক বলেন, এফটিসি গ্রাহকের নিরাপত্তার বিষয়ে খুবই সিরিয়াস। প্রতারণা দেখেও পদক্ষেপ না নেওয়ার বিষয়টি এজেন্সির নীতিবিরুদ্ধ। কোনো প্রতিষ্ঠান কনসেন্ট ডিগ্রি লঙ্ঘন করলে বড় ধরনের জরিমানা করতে পারে এফটিসি।
এখানে মজার বিষয় হলো, কংগ্রেসকে তো মোকাবিলা করল জাকারবার্গ; কিন্তু এফটিসির জরিমানা কতটুকু এড়াতে পারবে তারা? নিয়ম লঙ্ঘন করা হলে প্রত্যেক ব্যবহারকারীর জন্য প্রতিদিন ৪০ হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানা করারও নিয়ম রয়েছে। এটাকে যদি ৮ কোটি ৭০ লাখ গ্রাহক দিয়ে গুণ করা যায় (৩ লাখ ৪৮ হাজার ডলার), তাহলে তা ফেসবুকের বাজারমূল্যেরও বহুগুণ বেশি হবে। বর্তমানে ফেসবুকের বাজারমূল্য ৪৮ হাজার কোটি ডলার। এফটিসি যদি তার নীতি রক্ষায় খুবই জোর দেয়, তাহলে ফেসবুকের হাঁফ ছেড়ে বসার ফুরসত নেই।
তবে এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো এফটিসিকে প্রমাণ করতে হবে, ফেসবুক নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। এমন প্রমাণ, যার মাধ্যমে বোঝা যাবে, কোম্পানিটি গোপনীয়তার বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি। তবে এফটিসিও বিপদে আছে। যদি নিয়ম লঙ্ঘনের বিষয়টি প্রমাণতি হয়েই যায়, তাহলে এফটিসির যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। অভিযোগ উঠতে পারে, তাদের নিয়ন্ত্রণেও গাফিলতি ছিল। এফটিসির সাবেক এক অ্যাটর্নি এই বিষয়ে বলেছেন, যদি এফটিসি একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে রক্ষা করতে চায়, তাদের ফেসবুকের নিয়ম লঙ্ঘনের বিষয়টি প্রমাণ করতে হবে।
তবে ফেসবুক আসলেই দায়ী কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়। আইনপ্রণেতারা কংগ্রেস শুনানিতে জাকারবার্গকে অনেক অভিযোগ করেন। তবে জাকারবার্গ বারবার বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন, অন্য কোনো বিষয়ে ভুল হলেও ফেসবুক চুক্তিতে আবদ্ধ। কোম্পানির আইনজীবী এ ব্যাপারে খুবই দৃঢ়ভাবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজের ভুল স্বীকার করে জাকারবার্গ বলেছেন, ২০১৫ সালে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা সব তথ্য মুছে ফেলার যে অঙ্গীকার করেছিল, তা বিশ্বাস করা ঠিক হয়নি।
শুনানিতে জাকারবার্গকে প্রশ্ন করা হয়, এটি কীভাবে সম্ভব, অনেক ব্যবহারকারী মনে করছে যে ফেসবুক তাদের বিশ্বাস নষ্ট করেছে অথচ ফেসবুক বলছে চুক্তির কোনো লঙ্ঘন ছিল না? তখন তিনি উত্তর দেন, কৌশলগতভাবে কোনো ‘ডেটা লঙ্ঘন’ ছিল না। ২০১৩ সালে একজন গবেষক শিক্ষাগত গবেষণার জন্য ব্যবহারকারীদের এই তথ্য সংগ্রহ করেন। তারপর তিনি এটি একটি বাণিজ্যিক কোম্পানির কাছে অনৈতিকভাবে বিক্রি করেন। ওই কোম্পানিই ২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শিবিরের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে। ওই গবেষক এমন একটি অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করে নেন, যার সঙ্গে তিন লাখ ব্যবহারকারীর প্রোফাইল যুক্ত হয়। অ্যাপটি তখন সেই ব্যবহারকারীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে এবং ব্যবহারকারীদের শত শত বন্ধুরও তথ্যও সংগ্রহ করে। অর্থাৎ বেলুনের মতো ফুলতে ফুলতে তা শেষমেশ কোটি কোটি গ্রাহকে পরিণত হয়।
ফেসবুক মনে করে, এতে নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়নি। তবে এই ঘটনার জন্য ক্ষমা চান জাকারবার্গ। তিনি ঘোষণা করেন ফেসবুক তাদের হাজার হাজার অ্যাপস পর্যালোচনা করছে, এমন কোনো ঘটনা আর ঘটেছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি মনে করেন, ঘটনাটি ঘটেছে ফেসবুক তৈরির কাঠামোর কারণে। এটি এভাবেই ডিজাইন করা হয়েছে। হয়তো এই ডিজাইন পুরোপুরি ঠিক নয়।
এখন পর্যন্ত এফটিসির অনুসন্ধানে যা দেখা গেছে, তাতে বলা যায়, এই অপকর্মটির দায় কোম্পানির থেকে তৃতীয় পক্ষেরই বেশি। তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে এফটিসি সঠিক তদন্ত না করলে ব্যাপকভাবে সমালোচনার মুখে পড়বে।